আল-মুযিল্ল (ٱلْمُذِلُّ)
অর্থ:সম্মান হরণকারী/অপমানকারী
আল্লাহ হলেন আল-মুযিল্ল (ٱلْمُذِلُّ), তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন; আর তিনি যাদের সম্মান দান করেন তাদের হেয় করার কেউ নেই। তিনি যাকে ইচ্ছা হেয় করেন; আর তিনি যাদের অবনমিত করেন তাদের সম্মান দেওয়ার কেউ নেই। মানুষ যদি কখনো লাঞ্ছিত হয়, আল্লাহর হুকুম ছাড়া সে কখনো সম্মানিত হতে পারে না।
মুযিল্লু শব্দটি এসেছে আযাল্লা থেকে যার অর্থ হল: নীচু বা তুচ্ছ করা, লাঞ্ছিত বা অসম্মানিত করা।
আল-মুই’জ এবং আল-মুযিল্ল আল্লাহর এই নাম দুটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এই নামগুলোর বৈশিষ্ট্য মানুষকে আধিপত্য বা সার্বভৌমত্ব প্রদান এবং তা কেড়ে নেওয়ার সাথে জড়িত।
আল-মুযিল্ল নামটি এসেছে ذ-ل-ل এর মূল থেকে। এই মূল থেকে কুরআনের ব্যবহৃত কিছু শব্দ হলো وَتُذِلُّ (আপনি লাঞ্ছিত করেন), أَذِلَّةً (পদস্থ), ٱلذُّلِّ (দুর্বলতা), ذَلُولًا (অধীন)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর এই নামটি সরাসরি না আসলেও, অনেক আয়াত এই নামের গুণাবলীকে ইঙ্গিত করে।
আল-মুযিল্ল তাঁর অবাধ্য, অপরাধী ও শত্রুদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান হরণকারী, অপমানকারী, লাঞ্ছনাকারী। আল্লাহর অবাধ্য ব্যক্তি যদিও প্রকাশ্যে সম্মান-মর্যাদা প্রদর্শন করে, কিন্তু তার অন্তর অপমান, লাঞ্ছনা ও অমর্যাদায় ভরপুর; যদিও সে প্রবৃত্তির লালসায় লিপ্ত থাকার কারণে এটি বুঝতে পারে না। কেননা আল্লাহর অনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে সর্বপ্রকারের সম্মান আর তার অবাধ্যতায় রয়েছে সব ধরণের অপমান। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-
وَمَن يُهِنِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِن مُّكۡرِمٍۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يَشَآءُ
আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।1
قُلِ ٱللَّهُمَّ مَٰلِكَ ٱلۡمُلۡكِ تُؤۡتِى ٱلۡمُلۡكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلۡمُلۡكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُۖ بِيَدِكَ ٱلۡخَيۡرُۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ قَدِيرٌ
বল, ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’।2
فَأَذَاقَهُمُ ٱللَّهُ ٱلۡخِزۡىَ فِى ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَعَذَابُ ٱلۡأٓخِرَةِ أَكۡبَرُۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ
ফলে তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা আস্বাদন করালেন, আর আখিরাতের আযাব নিশ্চয় আরো বড়, যদি তারা জানত।3
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বারবার জানিয়েছেন যে, তিনি মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছা, বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই সে তার বিচারবুদ্ধি দিয়ে যে কর্ম করবে তার ফল ভোগ করবে। তবে তার কর্ম আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে সংঘটিত হয়। আবু লাহাব, ইবলিস এবং ফিরাউনের গল্পগুলি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিচের আয়াত দুটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিচারের দিন মুনাফিকরাও লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
يُنَادُونَهُمۡ أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡۖ قَالُواْ بَلَىٰ وَلَٰكِنَّكُمۡ فَتَنتُمۡ أَنفُسَكُمۡ وَتَرَبَّصۡتُمۡ وَٱرۡتَبۡتُمۡ وَغَرَّتۡكُمُ ٱلۡأَمَانِىُّ حَتَّىٰ جَآءَ أَمۡرُ ٱللَّهِ وَغَرَّكُم بِٱللَّهِ ٱلۡغَرُورُ
মুনাফিকরা মুমিনদেরকে ডেকে বলবে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? তারা বলবে ‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছ। আর তোমরা অপেক্ষা করেছিলে (আমাদের অমঙ্গলের) এবং সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং আকাঙ্ক্ষা তোমাদেরকে প্রতারিত করেছিল, অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ এসে গেল। আর মহা প্রতারক (শয়তান) তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছিল।4
فَٱلۡيَوۡمَ لَا يُؤۡخَذُ مِنكُمۡ فِدۡيَةٌ وَلَا مِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْۚ مَأۡوَىٰكُمُ ٱلنَّارُۖ هِىَ مَوۡلَىٰكُمۡۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ
সুতরাং আজ তোমাদের কাছ থেকে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা কুফরী করেছিল তাদের কাছ থেকেও না। জাহান্নামই তোমাদের আবাসস্থল। সেটাই তোমাদের উপযুক্ত স্থান। আর কতই না নিকৃষ্ট সেই গন্তব্যস্থল!5
এসব কিছু মহান আল্লাহর ন্যায়পরায়নতা, প্রজ্ঞা ও প্রশংসনীয় কাজের অনুগামী। কেননা কারো মর্যাদা কমানো, কাউকে অপমানিত করা ও কাউকে কিছু থেকে বঞ্চিত করতে এসব কাজে আল্লাহর হিকমত রয়েছে। তবে আল্লাহর এসব কাজের ব্যাপারে কারো কোন জবাব দিহিতার অধিকার নেই। এমনিভাবে কারো মর্যাদা বৃদ্ধি, কাউকে কিছু দান করা ও কারো কল্যাণ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহর রয়েছে সূক্ষ্ম হিকমত।
আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর প্রজ্ঞার উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখা। প্রত্যেকেই যার যার কর্ম অনুযায়ী প্রতিদান প্রাপ্ত হয়। সৌভাগ্যবান লোকদের জন্য ভালো কাজকে সহজ করে দেওয়া হয় আর দুর্ভাগা লোকদের জন্য মন্দ কাজকে সহজ করে দেওয়া হয়। বান্দার উপর দায়িত্ব হলো আল্লাহর তাওহীদ যথার্থভাবে কায়েম করা, তাঁর রবের উপর সবকাজে নির্ভরশীল হওয়া, উপকারী কাজে সাধ্যমত প্রচেষ্টা করা।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আমাদের উপলব্ধি করতে হবে আল্লাহ আসলে কাদের লাঞ্ছিত এবং অবনমিত করেন? ফেরাউনের ঘটনা থেকে স্পষ্টতই প্রতিমান যে অত্যাচারী এবং অহংকারীদের আল-মুযিল্ল অপমানিত এবং লাঞ্ছিত করেন, বিশ্বাসী এবং নিপীড়িতদের পাশে তিনি সব সময় থাকেন। ফেরাউন এবং মুসার (আ:) মা দুজনের সাথে তিনি দুই রকম আচরণ করেছেন।
হাদিসে বর্ণিত রাসূলের (সা:) এই দু’য়াটি আমরা প্রতিদিন করতে পারি-
اَللهُمَّ زِدْنَا وَلاَ تَنْقُصْنَا،وَأَكْرِمْنَا وَلاَ تُهِنَّا،وَأَعْطِنَا وَلاَ تَحْرِمْنَا،وَآثِرْنَا وَلاَ تُؤْثِرْ عَلَيْنَا،وَارْضِنَا وَارْضَ عَنَّا
জীবনে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, যে পরিস্থিতিতেই আমরা থাকি না কেন আল্লাহর হিকমতের উপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ভালো-মন্দ দুই অবস্থাতেই আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করতে পারেন।
فَأَمَّا ٱلۡإِنسَٰنُ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ رَبُّهُۥ فَأَكۡرَمَهُۥ وَنَعَّمَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّىٓ أَكۡرَمَنِ
وَأَمَّآ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ فَقَدَرَ عَلَيۡهِ رِزۡقَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّىٓ أَهَٰنَنِ
আর মানুষ তো এমন যে, যখন তার রব তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মান দান করেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার উপর তার রিয্ককে সঙ্কুচিত করে দেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন’7
আল্লাহ্ তা’আলা যখন কাউকে জীবনোপকরণে সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য, ধন-সম্পদ ও সুস্বাস্থ্য দান করেন, তখন শয়তান তাকে বিভিন্ন ভাবে ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত করে- সে মনে করতে থাকে যে, এটা আমার ব্যক্তিগত প্রতিভা, গুণ-গরিমা ও কর্ম প্রচেষ্টারই ফল, যা আমার লাভ করাই সঙ্গত। আমি এর যোগ্য পাত্ৰ। সে আরও মনে করে যে, সে আল্লাহর কাছেও প্রিয় পাত্র। সে ভাবে যদি আমি প্রত্যাখ্যাত হতাম, তবে তিনি আমাকে এসব নেয়ামত দান করতেন না। এমনিভাবে কেউ অভাব-অনটন ও দারিদ্রের সম্মুখীন হলে একে আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দলীল মনে করে।
আবার, যখন আল্লাহ তাকে (রুযী-রোযগারের) সংকীর্ণতায় ফেলে পরীক্ষা করেন, তখন সে তাঁর ব্যাপারে কুধারণা প্রকাশ করে থাকে।
কাজেই এ ধরনের মন মানসিকতা থেকে আমাদেরকে মুক্ত হতে হবে। মনে রাখতে হবে যে জাগতিক সাফল্যই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য নয়, আমাদের প্রচেষ্টা করে যেতে হবে আখিরাতের সাফল্যের জন্য। পার্থিব সাফল্যে আমরা যেন অহংকারী এবং আকৃতজ্ঞ না হয়ে যাই।
দারিদ্র্যতার সময় আমাদের পরীক্ষাও ভিন্ন হয়ে থাকে। হতে পারে তা ধৈর্যের পরীক্ষা, অল্পে তুষ্ট থাকার পরীক্ষা, এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার পরীক্ষা। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে দারিদ্রতার সময় আমাদের ঈমান কি কমে যাবে? আমরা কি আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হবো? আল্লাহর বিধি বিধান অমান্য করে অনৈতিক উপায় অবলম্বন করব?
আসুন এই হাদিসটি আরো একবার স্মরণ করি। সালামা ইবনে উবায়দুল্লাহ ইবনে মিহসান আল-আনসারী (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সুস্থদেহে দিনাতিপাত করে, পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে সকালে উপনীত হয় এবং তার নিকট যদি সারা দিনের খোরাকী থাকে, তাহলে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াই একত্র করা হলো।8
হে আল্লাহ – আল-মুযিল্ল, আমরা জানি যে আপনি আপনার অবাধ্য বান্দাদের অপমানকারী। আপনি আমাদের বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন, এবং জীবনের সকল পরিস্থিতিতে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে সহায়তা করুন। সুখের সময় আমরা যেন আপনার প্রতি শুকরিয়া আদায় করি, এবং দুঃসময়ে যেন আপনার সাহায্য কামনা করতে পারি, আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন। হে আল-মুযিল্ল আপনি আমাদেরকে এই পৃথিবীর এবং হাশরের দিনের লাঞ্চনা এবং অপমান থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।