আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি উপলক্ষে নিজেকে আল-মুতা’আলি – মহিমান্বিত, সর্বোচ্চ – বলেছেন। তিনি সমগ্র সৃষ্টির উপরে শ্রেষ্ঠ। আল-মুতা’আলি উচ্চতম, মানবজাতির যে কোনও চিন্তা, সীমা এবং আদর্শের ঊর্ধ্বে, তিনি মহৎ এবং তাঁর শক্তি ও পরিপূর্ণতার কারণেই তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে!
মুতা’আলি এসেছে ع-ل-و এর মূল থেকে, যা চারটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল উচ্চতর হওয়া এবং আরোহণ করা। দ্বিতীয় অর্থ হল পরাস্ত করা এবং অভিভূত করা, এবং তৃতীয় অর্থ হল অগ্রসর হওয়া এবং অতিক্রম করা। চতুর্থ প্রধান অর্থ হল বিশিষ্ট হওয়া।
এই মূলটি কুরআনে ৭০ বার চৌদ্দটি উদ্ভূত রূপে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল عَالِيَةٍ – ‘আলিয়াতিন (সুউচ্চ), ٱلۡعَلِىُّ – আল-আলিয়্যু (সমুন্নত), فَتَعَالَيۡنَ – ফাতা’আলায়না (“তবে তোমরা এসো”), ٱلۡعَالِينَ – (“উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন”)।
ভাষাগতভাবে, عُلو উচ্চতার বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে এবং একজন ব্যক্তি عَلِى হয় যখন সে বিশিষ্ট হয়। আল-মুতা’আলি এবং আল-আলী – অর্থাৎ “আল্লাহ সর্বোত্তম, এবং তিনি যে কোনও ত্রুটি এবং অপূর্ণতার ঊর্ধ্বে” – পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আল-মুতা’আলির উচ্চতা যে কোন সীমা অতিক্রম করে। তিনিই সর্বোত্তম ও মহিমান্বিত এবং তিনি তাঁর সত্ত্বা এবং গুণাবলীতে সমস্ত সৃষ্টিকে জয় ও অতিক্রম করেন। তিনি গর্বিত এবং মহান এবং তাঁর মহিমা আমাদের বোধগম্যতার উর্ধ্বে!
আল-মুতা’আলি নিজেই বলেছেন –
عَٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ ٱلۡكَبِيرُ ٱلۡمُتَعَالِ
তিনি গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী, মহান, সর্বোচ্চ।[১৩:৯]
পরম একত্ব :
আমাদের উচিত সমস্ত কাজ, সমস্ত ইবাদত তাঁর জন্য উৎসর্গ করা। মুসলিম হিসেবে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে তাঁর একক প্রভুত্ব (রুবুবিয়্যাহ), ঐশ্বর্য (‘উলূহিয়াহ) এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীর (আল-আসমা’ ওয়াল-সিফাত) কোনো অংশীদার বা সহযোগী নেই।
তাওহীদ আল উলূহিয়্যাহ মানে হল, আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে, কথায় ও কাজে, একমাত্র আল্লাহর (আল মুতা’আলী) জন্য সমস্ত ইবাদত নিবেদন করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর ইবাদত না করা, সে যেই হোক না কেন:
وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡئًا....
তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না।....
[৪:৩৬]
তাওহীদ আল-উলূহিয়্যাহ হল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে আল্লাহর উপাসনা ও ভক্তি করা। আর এই উদ্দেশ্যেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে, এবং আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাই হঠকারীরা ধ্বংস হয়ে যায় এবং মুমিনরা রক্ষা পায়! আমাদের আকাঙ্ক্ষা, গন্তব্য এবং কাজগুলো যেন হয় আল-মুতা’আলির সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
জীবনের অগ্রাধিকার বুঝতে শিখুন। আল্লাহ কি সত্যিই আপনার জীবনে মুতা’আলি?
আপনার প্রাত্যহিক জীবনের তালিকায় যেই কাজগুলো তিনি চান যে আপনি ভালোবাসার সাথে করেন, সেগুলোর অবস্থান আসলে কোথায়? যেমন আপনার সালাত, আপনি কি আপনার প্রাত্যহিক জীবনের ক্রিয়াকলাপে আপনার সালাতকে মানানসই করেন, সেগুলিকে বিলম্বিত করেন, নাকি আপনি আপনার সালাতকে অন্য সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখেন?
আপনি কি প্রথমে আপনার প্রিয় টিভি শো দেখা শেষ করেন এবং তারপর দেখেন আপনার কুরআন তেলাওয়াত জন্য সময় আছে কিনা? আপনি কি আপনার ফোনে মেসেজ চেক করে দিন শুরু করেন নাকি আল-মুতা’আলির কিতাব থেকে তেলাওয়াত করে? আপনার দৈনিক সময়সূচী নীরক্ষন করুন; যদি আপনার জীবনে ইবাদতের অগ্রাধিকার না থাকে, তবে তা পরিবর্তন করুন। এইবার খেয়াল করে দেখুন যে আপনি কতটা আশীর্বাদপূর্ণ, উৎপাদনশীল এবং প্রশান্তিময় বোধ করেন। আল-মুতা’আলির বাণী তেলাওয়াত করে আপনার দিন শুরু করুন এবং শেষ করুন!
নিজেকে অন্যের উপরে স্থান দেবেন না। আপনি আল-মুতা’আলির শক্তি ছাড়া কিছুই করতে পারেন না এবং আপনার যা কিছু আছে তা তাঁর কাছ থেকে এসেছে। আল-মুতা’আলির সাথে আপনার অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারা নির্ধারিত হয়: আপনার তাক্বওয়া এবং ধার্মিকতার স্তর দিয়ে।
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبًا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।[৪৯:১৩] আপনার সম্পদ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, বা আপনার বংশের কারণে নিজেকে কখনই অন্যদের চেয়ে বেশি যোগ্য মনে করবেন না!
অন্যদের আল-মুতা’আলীর দিকে ডাকুন। মানুষ হিসেবে আপনি আল-মুতা’আলীর সবচেয়ে সম্মানিত সৃষ্টি; শুধুমাত্র নিজে ইবাদত করলেই হবে না, অন্যদেরও তাঁর প্রতি আহ্বান জানান। সফল হওয়ার জন্য দাওয়ার কাজ করুন!
وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٌ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ
আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।[৩:১০৪]
জেনে রাখুন যে তিনি উচ্চ, তবুও তিনি নিকটে। কখনও কখনও আপনি মানসিক চাপ বা দুঃখে এতটাই নিমগ্ন থাকেন যে আপনি আল-মুতাআ’লিকে ভুলে যান, তিনি আপনার সবচেয়ে কাছের যদিও তিনি সবকিছুর থেকে উর্ধ্বে।
وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ وَنَعۡلَمُ مَا تُوَسۡوِسُ بِهِۦ نَفۡسُهُۥۖ وَنَحۡنُ أَقۡرَبُ إِلَيۡهِ مِنۡ حَبۡلِ ٱلۡوَرِيدِ
আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি। আর আমি তার গলার ধমনী হতেও অধিক কাছে।[৫০:১৬]
জীবনের দুঃখ কষ্টের সময় জেনে রাখুন যে তিনি সিংহাসনের উপরে সর্বোচ্চ, কিন্তু একমাত্র তিনিই জানেন যে আপনি ঠিক কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাই আপনার সকল সমস্যা এবং অনুভূতির কথা তাঁকেই বলুন এবং আপনার জীবন সংগ্রামে তাঁর কাছেই সাহায্য চান।
কখনো হতাশ হবেন না। আমাদের কখনোই আল-মুতা’আলির রহমতে হতাশ হওয়া উচিত নয়, তবে শয়তান প্রায়শই আমাদেরকে হতাশার দিকে পরিচালনা করে: যেমন নিজের ব্যাপারে হতাশা; আপনি কি কখনও বলেছেন বা ভেবেছেন: “আমি কখনই নিজেকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবো না” বা “আমি কখনই এই কাজ সম্পন্ন করতে পারবো না, তাহলে শুরুই বা করব কেন?”
আবার হতাশা কাজ করতে পারে অন্যের ব্যাপারে; অন্য কারো সম্পর্কে কি কখনো বলেছেন: “তারা কখনই পরিবর্তিত হবে না”?
এই ক্ষেত্রে আপনি কিন্তু পরোক্ষভাবে আল-মুতা’আলির ক্ষমতায় হতাশ!
আপনি যখন বলেন “আল্লাহ আমাকে কখনই ক্ষমা করবেন না, কারণ আমি অনেক খারাপ কাজ করছি”, আপনি আসলে তাঁকে নত করছেন, তাঁর ক্ষমতাকে ছোট করে দেখছেন। তিনি মানুষের ক্ষমার মানদণ্ড থেকে অনেক ঊর্ধ্বে! তাই পরের বার যখন আপনি অনুভব করবেন যে আপনি একটি নির্দিষ্ট অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারছেন না, বা আপনি একই পাপের পুনরাবৃত্তি করছেন, তখন আল-মুতাআ’লির কাছে প্রার্থনা করুন এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চান তাঁর উচ্চতা এবং ক্ষমতার প্রতি অটল বিশ্বাসের সাথে।
আল-মুতা’আলীর কাছে প্রার্থনা করুন। জান্নাতের সাতটি স্তর রয়েছে; সর্বোচ্চটি হল ফিরদাউস-আল-আলা, এবং এটি আল-মুতা’আলির সিংহাসনের নীচে। রাসুল (ﷺ) বলেছেন: যখন তুমি আল্লাহর কাছে চাও, তখন তাঁর কাছে আল-ফিরদাউস চাইবে, কারণ এটি জান্নাতের মাঝখানে অবস্থিত এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ অংশ, এর উপরে রয়েছে পরম করুণাময়ের আরশ, এবং তা থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত। [আল-বুখারী, মুসলিম]
হে আল্লাহ, আল-মুতা’আলি, আমরা জানি আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। আমাদের এমন জ্ঞান দান করুন এবং এমন ভাবে পরিচালিত করুন যাতে যে কাজগুলোতে আপনি সন্তুষ্ট হন সেই কাজগুলোকে জীবনে অগ্রাধিকার দিতে পারি। অন্যদের যেন আপনার প্রতি আহ্বান জানাতে পারি সেজন্য আমাদের সাহায্য করুন। আপনার সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশ্বাসে আমাদের সুশোভিত করুন এবং বিনা হিসাব-নিকাশে আমাদেরকে সর্বোচ্চ জান্নাতে প্রবেশ করান,
আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আল-মুতা’আলি