আসমাউল হুসনা – আল-মুহসী
আল-মুহসী (اَلْمُحْصِي)
অর্থঃ সকল সৃষ্টির ব্যপারে অবগত, গণনাকারী
আল- মুহসী মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু অনুধাবন করেন এবং প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি পরিবর্তনের বিবরণ জানেন। তিনি মানুষের প্রতিটি কর্ম সম্পর্কে অবগত এবং তিনি ফেরেশতাদের দ্বারা তা লিপিবদ্ধ করেন।
মুহসী শব্দটি এসেছে ح-ص-ي এর মূল থেকে যার বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে, যেমন- গণনা করা, হিসাব করা, সমষ্টিগতভাবে কোন কিছু গণনা করার জন্য নিবন্ধন করা, কোন কিছু হিসাব নেওয়ার জন্য নথিভুক্ত করা। এই মূল থেকে উদ্ভূত কুরআনে ব্যবহৃত কিছু শব্দ হলো – أَحۡصَىٰ – সঠিক হিসাব করেছিল, أَحۡصَيۡنَٰهُ – আমরা তা সংরক্ষণ করেছি, وَأَحۡصُواْ – তোমরা গণনা করো।
আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে ৮১টি নাম সুস্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকি ১৮টি নামের ব্যাপারে আলেমরা একমত হতে পারেননি। আল্লাহর আল-মুহসী নামটি ইবনে উসাইমিন, ইবনে হাযম এবং ইবনে হাজার আসমাউল হুসনার তালিকায় এই নামটি রাখেননি। যাইহোক, অন্য অনেক আলেম যেমন ইবনে আরাবী, ইমাম আল-বায়হাকী, এবং আল-গাজ্জালী, তাদের তালিকায় এই নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহর নিরানব্বইটি নাম রয়েছে; যে ব্যক্তি এগুলোকে স্মরণে রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
[মিশকাত: ২২৮৭]
إِنَّ لِلَّهِ تَعَالَى تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلَّا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ
আল্লাহ বিজোড় (তিনি এক, এবং এটি একটি বিজোড় সংখ্যা), এবং তিনি বিজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। এবং ইবনে উমরের বর্ণনায়, “যে তাদের গণনা করেছে।” হাদিসে, এটি একই মূল থেকে أَحْصَا শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ গণনা করা।
আল্লাহ সর্ব-গণনাকারী- এই নামটি আসলে কি ইঙ্গিত করে?
এটি তাঁর জ্ঞানের একটি গুণ, অনেকটা আল-আলিম (সব-জ্ঞানী), আশ-শহীদ (সাক্ষী), বা আল-খাবির (সর্বজ্ঞ) এর গুণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পার্থক্য হল আল-মুহসিকে প্রায়শই আরও বিশ্লেষণাত্মকভাবে বর্ণনা করা হয়। তিনি সব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, প্রতিটি পৃথক বিষয় বিবেচনায় রাখেন, এবং তাঁর খাতায় সংরক্ষণ করেন। প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতিটি পাতার ঝরে পড়া, এবং প্রতিটি পরমাণুর গতিবিধির হিসাব তিনি রাখেন। আল্লাহর জ্ঞান অসীম, তিনি প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খানু জ্ঞান রাখেন। তিনি যে কেবল সবকিছু জানেন তা নয়, প্রতিটি সম্ভাবনা এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কেও তিনি অবজ্ঞাত।
لِّيَعۡلَمَ أَن قَدۡ أَبۡلَغُواْ رِسَٰلَٰتِ رَبِّهِمۡ وَأَحَاطَ بِمَا لَدَيۡهِمۡ وَأَحۡصَىٰ كُلَّ شَىۡءٍ عَدَدًۢا যাতে তিনি এটা জানতে পারেন যে, তারা (রসূলগণ) তাদের রবের রিসালাত পৌঁছিয়েছে কিনা। আর তাদের কাছে যা রয়েছে, তা তিনি পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তিনি প্রতিটি বস্তু গুণে গুণে হিসাব করে রেখেছেন। [সূরা আল-জিন:২৮]
وَكُلَّ شَىۡءٍ أَحۡصَيۡنَٰهُ كِتَٰبًا
আর সব কিছুই আমি লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছি।
[সূরা আন-নাবা:২৯]
وَوُضِعَ ٱلۡكِتَٰبُ فَتَرَى ٱلۡمُجۡرِمِينَ مُشۡفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَٰوَيۡلَتَنَا مَالِ هَٰذَا ٱلۡكِتَٰبِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّآ أَحۡصَىٰهَاۚ وَوَجَدُواْ مَا عَمِلُواْ حَاضِرًاۗ وَلَا يَظۡلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا আর আমলনামা রাখা হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখতে পাবে ভীত, তাতে যা রয়েছে তার কারণে। আর তারা বলবে, ‘হায় ধ্বংস আমাদের! কী হল এ কিতাবের! তা ছোট-বড় কিছুই ছাড়ে না, শুধু সংরক্ষণ করে’ এবং তারা যা করেছে, তা হাযির পাবে। আর তোমার রব কারো প্রতি যুলম করেন না। [সূরা আল-কাহাফ:৪৯]
وَءَاتَىٰكُم مِّن كُلِّ مَا سَأَلۡتُمُوهُۚ وَإِن تَعُدُّواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ لَا تُحۡصُوهَآۗ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ
আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদের দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অধিক অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ।
[সূরা ইব্রাহীম:৩৪]
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহর নেয়ামত আমাদের বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে। আল্লাহর নেয়ামত গুনে আমরা কখনো শেষ করতে পারবো না, আর প্রতিটি নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা চিরকাল তাঁর ক্রমাগত অনুগ্রহ, দয়া এবং করুণার কাছে ঋণী। তিনি তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির ব্যাপারেই অবগত।
إِنَّا نَحۡنُ نُحۡىِ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَنَكۡتُبُ مَا قَدَّمُواْ وَءَاثَٰرَهُمۡۚ وَكُلَّ شَىۡءٍ أَحۡصَيۡنَٰهُ فِىٓ إِمَامٍ مُّبِينٍ
আমিই তো মৃতকে জীবিত করি আর লিখে রাখি যা তারা অগ্রে প্রেরণ করে এবং যা পিছনে রেখে যায়। আর প্রতিটি বস্তুকেই আমি সুস্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষণ করে রেখেছি।
[সূরা ইব্রাহীম:৩৪]
لِّلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلۡأَرۡضِۗ وَإِن تُبۡدُواْ مَا فِىٓ أَنفُسِكُمۡ أَوۡ تُخۡفُوهُ يُحَاسِبۡكُم بِهِ ٱللَّهُۖ فَيَغۡفِرُ لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ قَدِيرٌ
আল্লাহর জন্যই যা রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা রয়েছে যমীনে। আর তোমরা যদি প্রকাশ কর যা তোমাদের অন্তরে রয়েছে অথবা গোপন কর, আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের হিসাব নেবেন। অতঃপর তিনি যাকে চান ক্ষমা করবেন, আর যাকে চান আযাব দেবেন। আর আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
[সূরা আল-বাকারা:২৮৪]
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আল্লাহর এই নামটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তিনি তাঁর সব সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত, তিনি আপনাকে এবং আমাকে – আমাদের সবাইকে জানেন এবং বোঝেন। তাই আপনার যদি নিজেকে কখনো খুব নগণ্য মনে হয়, বা যদি মনে হয় কেউ আপনার কথা শুনছে না, বা আপনাকে বুঝছে না, অথবা আপনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করছে, তবে জেনে রাখুন আল-মুহসী আপনার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। আমরা সকলেই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি আমাদের সব কিছুর হিসাব রাখেন, এবং তিনি আমাদের পথনির্দেশনা দান করেন যাতে আমরা ফলপ্রসু জীবন যাপন করতে পারি। তিনি কাউকেই ভুলেন না, অতীত এবং বর্তমানে যারা এই পৃথিবীতে হেঁটেছেন, বা ভবিষ্যতে যারা হাঁটবেন তিনি তাদের সবাইকেই চেনেন।
আল্লাহর প্রতিটি নামের ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা করতে হবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তাঁর নামের জ্ঞানকে আমরা কিভাবে প্রয়োগ করতে পারি, এবং এই নামের গুনকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে কিভাবে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করতে পারি। আল-মুহসী নামের সচেতনতা আপনার জীবনে একটি অর্থপূর্ণ প্রভাব ফেলতে যথেষ্ট। যখন কোন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হন, আপনাকে চিন্তা করতে হবে আল-মুহসী আপনার সিদ্ধান্তে কতটুকু সন্তুষ্ট হবেন।
আসুন, আল-মুহসী যে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত এবং সবকিছুর হিসাব গণনাকরী – এ বিষয়টি একটু বোঝার চেষ্টা করি। এজন্য আমাদের সীমিত সামাজিক নেটওয়ার্কিং ক্ষমতার প্রতি আলোকপাত করছি। রবার্ট ডানবার নামে একজন নৃতত্ববিদের মতে আমরা মানুষের সাথে যে অর্থপূর্ণ সম্পর্কের সংখ্যা তৈরি করতে পারি তা আমাদের মস্তিষ্কের নিওকর্টেক্সের আকার দ্বারা সীমাবদ্ধ। বন্ধুত্বের সংখ্যার একটি স্বাভাবিক সীমা রয়েছে যা আমরা সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করতে পারি। তার প্রস্তাবিত নম্বরটি “ডানবারের সংখ্যা” হিসাবে পরিচিত। ডানবারের সংখ্যা অনুসারে আমরা একসাথে ১৫০ টি সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি। (এদের সাথে চা-কফি খেতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আপনি অস্বস্তি বোধ করেন না)। আপনাকে মনে রাখতে হবে এর মধ্যে প্রতিটি সম্পর্ক কিন্তু একরকম নয়। এই ১৫০ টি সম্পর্কের মধ্যে হয়তো ৫-১০ জন আপনার কাছের মানুষ, যাদের সাথে আপনি সুখ দুঃখ শেয়ার করেন, এবং একে অন্যের জীবনের ঘটনা বিঘটনা জানেন। এরপরের গ্রুপে হয়তো আরও দশজন আছে যাদের আপনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করেন। এর পরের লোকজনদের সাথে আপনার সম্পর্ক আরো ক্ষীণ। আর এই ১৫০ টি সম্পর্কের বাহিরে আপনি যাদের চেনেন তাদের সাথে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা নিয়মিত যোগাযোগ নেই।
এখন, এই সংখ্যাটি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও, এই সংখ্যা চারশো বা পাঁচশোর উর্ধ্বে নয়। তাহলে এবার, আল্লাহর জ্ঞানের বিশালতা ও ক্ষমতা কল্পনা করুন, যখন তিনি আমাদের বলেন –
وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِى ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚ وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعۡلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِى ظُلُمَٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِى كِتَٰبٍ مُّبِينٍ
আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি অবগত রয়েছেন স্থলে ও সমুদ্রে যা কিছু আছে। আর কোন পাতা ঝরে না, কিন্তু তিনি তা জানেন এবং যমীনের অন্ধকারে কোন দানা পড়ে না, না কোন ভেজা এবং না কোন শুষ্ক কিছু; কিন্তু রয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবে।
[সূরা আল-আন'আম:৫৯]
তিনি আমাদের প্রত্যেককে কেবল নামেই জানেন না, বরং আমাদের প্রার্থনা, আমাদের কাজ এবং আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে যা লুকায়িত, তাও তিনি জানেন এবং মনে রাখেন। এটি আল্লাহর বিশালতা ও সম্পূর্ণ জ্ঞান যা তাঁর আল-মুহসী নামের অর্থের মাধ্যমে প্রকাশিত।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।