আল-মানী – ٱلْمَانِعُ
রক্ষাকারী, প্রতিরোধক।
আল্লাহ سُبْحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ হলেন আল-মানী (ٱلْمَانِعُ)। তিনি যা প্রতিরোধ করেন তা দেওয়ার কেউ নেই, আবার তিনি যা দেন তা প্রতিরোধ করার কেউ নেই। তিনি ক্ষতিকারক পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রক্ষা করেন এবং অবাঞ্ছিত ক্রিয়াকলাপ প্রতিরোধ করেন।
আল-মানী এসেছে م-ن-ع এর মূল থেকে যার বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে: প্রতিরোধ করা, বাধা দেওয়া, আটকে রাখা, সংযত করা, অস্বীকার করা, নিষেধ করা, প্রত্যাখ্যান করা, এবং রক্ষা করা।
আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে ৮১টি নাম সুস্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, বাকি ১৮টি নামের ব্যাপারে আলেমরা একমত হতে পারেননি। আল-মানী সেই নামগুলির মধ্যে একটি যা নির্দিষ্ট কিছু আলেমদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই তালিকায় ইবনুল উজির, ইবন হাযম এবং ইবনুল উসাইমীন প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত। তবে ইবনে আরাবী, ইমাম আল-বায়হাকী, এবং আল-গাজ্জালী, তাদের তালিকায় এই নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আল-মানী হলেন যিনি দেন এবং প্রতিরোধ করেন। তিনি যখন দান করেন, তখন কোন কিছুই বাধা দিতে পারে না, আর যদি তিনি কোন কিছু স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তবে কেউ তা দিতে সক্ষম নয়। অর্থের দিক থেকে আল্লাহর নাম আল-হাফিজ (রক্ষক) এবং আল-ক্ববিদ (প্রতিরোধক) এই নামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল-ক্ববিদ হলেন তিনি যিনি প্রতিরোধ করেন। অত:এব, সমস্ত কল্যাণ ও উপকারীতা একমাত্র তাঁরই থেকে, তাঁর কাছেই কল্যাণ প্রত্যাশা করা হয়, তিনি তাঁর হিকমত ও রহমত অনুসারে যাকে ইচ্ছা দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা দান করা থেকে বিরত থাকেন। কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা বিচার করা আমাদের দায়িত্ব নয়। তাঁর ক্ষমতা অসীম। কাজেই তাঁর এই গুণবাচক নামটি তাঁর ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের বৈশিষ্ট্যকে ইঙ্গিত করে।
অর্থের দিক থেকে আল-মানী (প্রতিরোধকারী) নামটি আল-ওয়াহহাব (উপহার প্রদানকারী) নামের বিপরীত। যাইহোক, আল-মানী নামটি তাঁর অসীম জ্ঞান, বিচার এবং করুণার মাধ্যমে ইতিবাচক প্রতিরোধকেও বোঝাতে পারে। তার প্রতিরোধ একটি প্রতিরক্ষা বা ঢাল যা আমরা জানি না।
আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়াজল যখন কোন কিছু রোধ করেন তা ভালোর জন্যই করেন, আবার যখন কোন কিছু দিয়ে থাকেন তাও আমাদের ভালোর জন্যই। কখনও কখনও আমাদের বক্ষ সংকুচিত হয় এবং আমাদের ঈমান নিচু হয়। আমাদের হৃদয়ের এই সীমাবদ্ধতা আমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে আনতে পারে যদি আমরা সচেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
আর আল্লাহ যখন আপনার রিজিক প্রতিহত করেন, হতে পারে তা আপনার সংশোধনের জন্য অথবা সুরক্ষার জন্য। আল্লাহ বলেন –
وَ لَوۡ بَسَطَ اللّٰهُ الرِّزۡقَ لِعِبَادِهٖ لَبَغَوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ یُّنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا یَشَآءُ ؕ اِنَّهٗ بِعِبَادِهٖ خَبِیۡرٌۢ بَصِیۡرٌ
আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবনোপকরণের প্রাচুর্য দিলে তারা পৃথিবীতে অবশ্যই বিপর্যয় সৃষ্টি করত; কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছা মত সঠিক পরিমানেই দিয়ে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে সম্যক জানেন ও দেখেন।
[সূরা আশ-শুরা:২৭]
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
مَاۤ اَفَآءَ اللّٰهُ عَلٰی رَسُوۡلِهٖ مِنۡ اَهۡلِ الۡقُرٰی فَلِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوۡلِ وَ لِذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ۙ کَیۡ لَا یَکُوۡنَ دُوۡلَۃًۢ بَیۡنَ الۡاَغۡنِیَآءِ مِنۡکُمۡ ؕ وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ ٭ وَ مَا نَهٰىکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ
যে ধন-সম্পদ আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে নিয়ে তাঁর রসূলকে দিলেন তা আল্লাহর জন্য তাঁর রসূলের জন্য আর রসূলের আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও পথিকদের জন্য যাতে তা তোমাদের মধ্যকার সম্পদশালীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর তোমাদেরকে যাত্থেকে নিষেধ করে তাত্থেকে বিরত থাক, আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।
[সূরা আল-হাশরঃ৭]
إِنَّ ٱللَّهَ يُدَٰفِعُ عَنِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ
নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদেরকে রক্ষা করেন এবং কোন বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।
[সূরা আল হজ্জ:৩৮]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দু’য়াটি প্রতিদিন পাড়ার অভ্যাস করুন।
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ اللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ
অর্থ: “আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসা তাঁরই, তিনি সব কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান হে আল্লাহ! তুমি যা দিয়েছ তা কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না, এবং তুমি যা প্রতিরোধ করেছ তা কেউ দিতে পারবে না, এবং কোন সংগ্রামীর প্রচেষ্টা তোমার বিরুদ্ধে লাভবান হতে পারে না”
আল-মানী তাঁর এই প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে নিজেই বলেছেন –
أَمَّنۡ هَٰذَا ٱلَّذِى يَرۡزُقُكُمۡ إِنۡ أَمۡسَكَ رِزۡقَهُۥۚ بَل لَّجُّواْ فِى عُتُوٍّ وَنُفُورٍ
অথবা এমন কে আছে, যে তোমাদেরকে রিয্ক দান করবে যদি আল্লাহ তাঁর রিয্ক বন্ধ করে দেন? বরং তারা অহমিকা ও অনীহায় নিমজ্জিত হয়ে আছে।
[সূরা আল-মূলক:২১]
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আমাদেরকে বুঝতে হবে যে আল্লাহর কাছে আমাদের চাওয়া পাওয়ার দাবি সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। ঠিক যেমন একজন বাবা বা মা তার সন্তানের কাছ থেকে কিছু জিনিস প্রতিহত করেন, এবং সহানুভূতি এবং প্রজ্ঞার সাথেই তা করেন।
আপনার চারপাশে প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করুন। আল্লাহ কিছু লোকের কাছ থেকে মেঘ আটকে রাখেন এবং অন্যদের তা প্রদান করেন এবং কিছু জায়গায় অন্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি হয়। এর অর্থ হল, আল্লাহ কারো কাছ থেকে বৃষ্টি রোধ করেন এবং কারো জন্য তা প্রদান করেন। তিনিই দিবালোক রোধ করেন (গোপন করেন) এবং তারপর আবার তা ফিরিয়ে আনেন। আল্লাহ বলেন –
ثُمَّ قَبَضۡنٰهُ اِلَیۡنَا قَبۡضًا یَّسِیۡرًا
তারপর আমি এটাকে (দিবালোক) ধীরে ধীরে আমার দিকে গুটিয়ে আনি।
[সূরা আল-ফুরকান:৪৬]
প্রতিবার যখন আপনি এগুলি অবলোকন করেন তখন এই আল্লাহর এই নামটি সম্পর্কে চিন্তা করুন!
একটু মনোনিবেশ করলেই আমরা আল-খালিক (স্রষ্টা), আল-ওয়াহাব (উপহার দানকারী) এবং আর-রাজ্জাক (রিজিক দানকারী) এর প্রদত্ত অনেক আর্শীবাদ আমাদের জীবনে দেখতে পাই। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, জীবন উপহার দিয়েছেন এবং প্রতি মুহূর্তে রিযিক দিয়ে চলেছেন। মৃত্যুতে, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন “আমরা আল্লাহরই এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।” আমরা আমাদের কর্ম ও দায়িত্বে স্বাধীন হতে পারি, কিন্তু আমরা আল্লাহর, তাঁর কর্তৃত্ব ও শাসনের অধীন।
আল্লাহ কেন আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন?
যাতে আমরা তাঁকে জানতে পারি! কেন তিনি আমাদের খাঁটি আদি মানব প্রকৃতি প্রদান করেছেন? যাতে আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারি! আমাদের চেতনা দিয়ে আমরা আমাদের প্রভুকে চিনি; আমাদের বিশুদ্ধ আদি মানব প্রকৃতির কারণে আমরা ভুল করার পর হতাশা এবং বিষন্নতায় ভূগি, আর এভাবেই আমরা ভুলগুলোকে ভুল হিসেবে চিনে নেই। কাজেই ভুলের মধ্যে জীবন অতিবাহিত না করে আমাদের উচিত উঠে দাঁড়ানো, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, এবং খারাপ কাজকে ভালো কাজ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা।
জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করুন। আল্লাহ আমাদের জীবন দান করেন এবং তিনি আত্মাকে কব্জা করেন এবং তাদের মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ বলেন –
تَبٰرَکَ الَّذِیۡ بِیَدِهِ الۡمُلۡکُ ۫ وَ هُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡ
বরকতময় তিনি যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।
[সূরা আল-মূলক:০১]
الَّذِیۡ خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَ الۡحَیٰوۃَ لِیَبۡلُوَکُمۡ اَیُّکُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا ؕ وَ هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفُوۡرُ ۙ
যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।
[সূরা আল-মূলক:০২]
* জীবনের কঠিন সময়ে, ধৈর্য অনুশীলন করুন, কারণ আল্লাহ আপনাকে প্রতিদান দিবেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আপনি কিভাবে সাড়া দিয়েছেন তার উপর ভিত্তি করে। নিজেকে সব সময় একটি সহজ প্রশ্ন করতে পারেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পরিস্থিতিতে কিরকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন?’
কাজেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী, তাঁর বাণী এবং শিক্ষাগুলো অধ্যয়ন করুন, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো কোন ঘটনায় কিরকম প্রতিক্রিয়া আমাদের জানানো উচিত, এবং আমরা সেভাবে চেষ্টা করতে পারব। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে একজন মুমিনের পুরস্কার রয়েছে সর্বাবস্থায়।
আল্লাহর নাম নিয়ে ঘুমাতে যান। আপনি যখন ঘুমান তখন একে ছোট মৃত্যু বলা হয়। আল্লাহ কারো কারো আত্মাকে আটকে রাখেন এবং তারা কখনো জাগবে না, এবং তিনি অন্যদের আত্মা ফিরিয়ে দেন এবং তারা জেগে ওঠে। তাই আপনার ঘুমানোর সময় দুআ করা খুবই জরুরী: –
اَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
মোটামুটি উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনারই নামে মারা যাই আবার আপনারই নামে জীবন লাভ করি।
হে আল্লাহ, আল-মানী, এই জীবনে এবং পরবর্তী জীবনে আমাদের জন্য যা কিছু ক্ষতিকর তা প্রতিরোধ করার মাধ্যমে আমাদের হৃদয়কে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমাদেরকে এই দৃঢ় বিশ্বাসের উপর রাখুন যে আমাদের জীবনে যা কিছু হয় তা আপনার পক্ষ থেকে, এবং তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর। চারপাশের প্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবার তৌফিক আমাদের দান করুন। হে আল্লাহ আপনি আমাদের উপর অনুগ্রহ করুন যেন জীবন, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের কথা স্মরণ করে আমরা আপনার নিখুঁত শক্তিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।