আসমাউল হুসনা – আল-কারিম

আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে দুইবার নিজেকে আল কারীম – উদার, সম্মানিত, দয়াময় বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আল-কারিম, সমস্ত গুণ এবং সম্মানের উৎস। তিনি তাঁর সৃষ্টির সাথে তাঁর আচরণে আল-কারিম। তিনি ক্ষমা করেন, তাঁর ক্রমাগত সবচেয়ে মূল্যবান অনুদানগুলি আমাদের সবার সমস্ত প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়!

সবচেয়ে উদার, সর্বাধিক সম্মানিত এবং দয়াময়:
করিম (ْكَرِيم), আকরাম (ْاَكْرَم) এবং ইকরাম (ْاِكْرَم) মূল ك-ر-م থেকে এসেছে, যা প্রধানত দুটি অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থটি হল উদার, দানশীল এবং উপকারী। একই মূলের দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে অত্যন্ত সম্মানিত এবং মূল্যবান। এই মূলটি কুরআনে ৪৭ বার আবির্ভূত হয়েছে আটটি রূপে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল: ْ

আরবি ভাষায় ‘কারিম‘ এর অর্থ শুধু উদার নয় বরং এই শব্দটি অনেক অর্থ বহন করে। ‘করিম’ অর্থ সহনশীল, দয়ালু, ভদ্র, ধৈর্যশীল, মহৎ, বিশুদ্ধ এবং উপকারী। অন্য কথায় বলতে গেলে যা কিছু প্রশংসনীয় তাই ‘কারিম’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। উদাহরণ হল একটি ‘কারিম’ পাথর অর্থাৎ মূল্যবান পাথর। উপকারী হিসাবেও ‘কারিম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় এবং একজন মহৎ, সুদর্শন, ব্যক্তিও ‘করিম’ ব্যক্তি।

সূরা আল ইনফিতার এ আল্লাহর নাম ٱلْكَرِيمِ এসেছে এভাবে –
يَٰٓأَيُّهَا ٱلْإِنسَٰنُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ ٱلْكَرِيمِ * ٱلَّذِى خَلَقَكَ فَسَوَّىٰكَ فَعَدَلَكَ * فِىٓ أَىِّ صُورَةٍ مَّا شَآءَ رَكَّبَكَ
হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহান (ٱلْكَرِيمِ) রব সম্পর্কে ধোঁকা দিয়েছে? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তোমাকে সুঠাম করেছেন, তারপর তোমাকে সুসমঞ্জস করেছেন, যে আকৃতিতে তিনি চেয়েছেন সেইভাবে তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।
[সুরা আল ইনফিতার (৮২): আয়াত ৬-৮]

সূরা আল আলাক এ আল্লাহর নাম ٱلْأَكْرَمُ এসেছে এভাবে-

ٱقْرَأْ وَرَبُّكَ ٱلْأَكْرَمُ
পড়ো! আর তোমার প্রভু মহাসম্মানিত।
[সুরা আল আলাক: ৩]

এখন আলোচনা করব আল্লাহর আল-কারিম নামটি অন্যান্য নামের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত। আল-কারীম নামটি দ্বারা সম্মানিত, ভাল এবং ন্যায় পরায়ণ সবই বোঝায় এবং সেই কারণে আল্লাহ আজ্জা ওয়াজালের অন্যান্য আসমা ওয়াস-সিফার (নাম এবং গুণাবলী) সাথে আল কারিম নামটি দৃঢ় ভাবে সম্পর্কিত।

আল-কারিম আল-ওয়াহহাব (দাতা) এবং আর-রাজ্জাক (প্রদানকারী) এর সাথে সম্পর্কিত এই অর্থে যে তিনি তাঁর দাসদের প্রতি আশাতীত অনুগ্রহ প্রদান করে থাকেন। আল-কারিম আপনাকে অস্তিত্ব দিয়েছেন যদিও তিনি তা করতে বাধ্য ছিলেন না। আল-কারিম আমাদের পুরো পৃথিবী দিয়েছেন, যেমন তিনি আমাদের বলেছেন:

هُوَ ٱلَّذِى خَلَقَ لَكُم مَّا فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًا
তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত।
[সুরা বাকারা: ২৯]

আমাদের গ্রন্থ কুরআন, শুধুমাত্র একটি নির্দেশনা নয়, এটি একটি নিরাময়ও বটে। আমাদের প্রার্থনা শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং বহুবিধ পুরস্কারের ধনভান্ডার। আমাদের খাবার শুধু এক ধরনের নয়, বরং স্বাদ, গঠন এবং ঘ্রানের এক আশ্চর্য বৈচিত্র্যের সমারোহ; এ সবই আল কারিমের দান!

আল্লাহর আল-কারিম নামটি আল-আফুউ (ক্ষমাশীল) এর সাথে সম্পর্কিত কারণ এমনকি আপনি যখন পাপ করেন এবং তা ভুলেও যান, আল্লাহ আপনার সাথে উদার আচরণ করেন এবং আপনাকে আরামদায়ক জীবনযাপন করতে দেন। তিনিই আপনার পাপগুলিকে ঢেকে দেন এবং যখন আপনি তাঁর অসীম দয়ায় তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি কেবল আপনাকে ক্ষমাই করেন না বরং আপনার খারাপ কাজগুলিকে সম্পূর্ণরূপে মুছে দেন এবং উপরন্তু সেগুলিকে ভাল কাজে পরিণত করেন। তিনি আত-তাওয়াব। কতই না উদার প্রভু!

আল্লাহর আল কারিম নামটি আশ-শাকুরের (প্রশংসাকারী) সাথে সম্পর্কিত, আল-করিম আপনাকে উদারভাবে পুরস্কৃত করেন যখন আপনি আন্তরিকভাবে কেবলমাত্র তাঁর ইবাদত করেন, যদিও তা হয় সামান্য। এর চূড়ান্ত উদাহরণ হলো জান্নাত – এ জীবনে বছর কয়েক ইবাদতের বিনিময়ে চিরন্তন আনন্দ! (জান্নাত)

আল্লাহর আল-কারিম নামটি আল-হালিমের (সহনশীল) সাথেও সম্পর্কিত, যখনই তিনি দান করেন, তিনি সবচেয়ে উদারভাবে দান করেন এবং যখন আমরা আল-কারিমের অবাধ্য হই এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি তিনি সবচেয়ে সহনশীলতার সাথে আমাদের ক্ষমা করেন, সুবহানাল্লাহ! সবচেয়ে উদার এবং করুণাময় উপায়ে তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন।

আল্লাহর আল-কারিম নামটি আল-ওয়াদুদ (প্রেমময়) এর সাথেও সম্পর্কিত। আমাদের প্রতি তাঁর এই স্বর্গীয় ভালোবাসার স্বীকৃতি আমাদের অবশ্যই দিতে হবে। আল-কারিম বলেছেন –

إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ ٱلرَّحْمَٰنُ وُدًّا
নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, পরম করুণাময় তাদেরকে ভালোবাসা দান করবেন।
[ সুরা মারইয়াম: ৯৬]

এ তো গেলো আল-কারিম নামটি আল্লাহর অন্যান্য নামের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত। এখন আমরা আলোচনা করব আল্লাহর গুণবাচক এই নাম – আল-কারিমকে আমরা কিভাবে নিজেদের জীবনে ধারণ করতে পারি। প্রথমত আল কারিম এর নিকটবর্তী হতে হলে আমাদের উদার হতে হবে।

আল্লাহর নাম ও গুণাবলী দুই প্রকার – যেগুলি কেবলমাত্র তাঁর (যেমন আল-খালিক, স্রষ্টা) জন্য প্রযোজ্য, এবং যেগুলি আমাদের নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করতে পারি এবং করা উচিত; তাদের মধ্যে একটি হলো আল-করিম। আমাদের জিনিসপত্র, সময় এবং এমনকি আমাদের কথার মাধ্যমে আমরা উদার হতে পারি। হাদীসে এসেছে রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘দাতা আল্লাহর কাছে প্রিয়, মানুষের কাছে সম্মানিত, জান্নাতেরও নিকটতম; জাহান্নাম থেকে দূরে অবস্থিত। একজন সাধারণ দাতা একজন কৃপণ আবেদ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।’
[তিরমিজি শরিফ]

প্রথমত, আমরা কুরআনুল কারীমের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। আল্লাহর কিতাব, কুরআনুল কারীম – এতে রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের দিকনির্দেশনা, এতে কোন ত্রুটি বা বৈপরীত্য নেই। প্রতিদিন অন্তত একবার আল-কুরআন আল-কারিম খুলুন। এমনকি যদি আপনি প্রতিদিন একটি আয়াতও পড়েন এবং তা অনুধাবন করুন, এটি আপনার চরিত্র, মন এবং হৃদয়কে পরিবর্তন করবে এবং আপনাকে আরও কারিম করে তুলবে, ইনশাআল্লাহ!

ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিন।আল-করিম আমাদেরকে মানুষ হিসেবে সম্মানিত করেছেন এবং বিশেষভাবে মুসলমান হিসেবে। বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আল-করিম আপনাকে যে মূল্য দিয়েছেন তা উপলব্ধি করুন এবং উম্মাহর উপকারে ব্যবহার করুন। কুরআনের আয়াত অন্যদের সাথে শেয়ার করুন, অন্য কাউকে শেখান, এমনকি একটি হাদিস হলেও। অমুসলিমদের কাছে সুন্দর, সম্মানজনক উপায়ে ইসলামের বাণী প্রচার করুন।

আল-কারিমের সান্নিধ্য অর্জনের জন্য তাঁর গুণবাচক নামগুলি অধ্যয়ন করুন। সূরা আল ইনফিতার এ আল-কারীম বলেছেন –

یٰۤاَیُّهَا الۡاِنۡسَانُ مَا غَرَّکَ بِرَبِّکَ
হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার রব আল কারীম (দানশীল) সম্পর্কে উদাসীন করে রেখেছে?
[৮২:৬]

আল্লাহ সম্পর্কে অধ্যয়ন করুন, তাঁর নাম এবং গুণাবলী অনুধাবনের চেষ্টা করুন। জেনে রাখুন যে আল কারিম তাদের কখনই নিরাশ করবে না যারা তাঁর আনুগত্য করে। আপনি এই পৃথিবীতে এসেছেন তাঁর জন্য। কাজেই আল-করিম আপনাকে তাঁর সন্তুষ্টি এবং তাঁর দিকে কাজ করার জন্য যে বুদ্ধি এবং দক্ষতা দিয়েছেন তা ব্যবহার করুন, তাহলেই আপনি অর্জন করবেন আল কারিম এর চুড়ান্ত উদারতা – চিরস্থায়ী জান্নাত!

আল-কারিম

Source: understandquran

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version