আসমাউল হুসনা – আল-কাবীর
আল-কাবীর (ُاَلْكَبِيْر)
অর্থ: সর্বোত্তম
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ছয়টি উপলক্ষে নিজেকে আল-কাবীর — সর্বশ্রেষ্ঠ, মহান — বলেছেন। তিনিই অকল্পনীয়ভাবে মহান ও নিখুঁত। আল-কাবীর সব ধরনের মহত্ত্বকে আলিঙ্গন করেন – পদমর্যাদা, বিশালতা, আভিজাত্য এবং জ্ঞান থেকে রহমত পর্যন্ত। এই নাম থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি কোন কিছুই তাঁর মত ছিল না, হতে পারে না, এবং হবে না।
আল্লাহ মহান এবং অন্য যেকোনো কিছু থেকে মহত্তর। কবীর ك-ب-ر এর মূল থেকে এসেছে, যা পাঁচটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথমটি হল পদমর্যাদা ও আভিজাত্যে মহান হওয়া, এবং দ্বিতীয়টি আকারে মহান হওয়া, তৃতীয় প্রধান অর্থ হল বয়সে মহান হওয়া এবং চতুর্থ অর্থ বিদ্যা ও জ্ঞানে মহান হওয়া। পঞ্চম অর্থ হল অন্য সকলের উপরে অধিকার থাকা।
এই মূলটি আঠারোটি উদ্ভূত রূপে কুরআনে ১৬১ বার উপস্থিত হয়েছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল کَبُرَ – কাবুরা (“মহান” বা “কঠিন”), فَكَبِّرْ – ফাকাব্বির (“মহৎ/শক্তিশালী”), مُتَكَبِّرِين – মুতাকাব্বিরীন (“অহংকারী)”, أَكْبَرُ – আকবারু (“বৃহত্তর”), كِبَرُ – কিবারু (“বৃদ্ধ বয়স”), এবং كَبُرَ – কুবরা, كَبِير – কাবির (“মহান”)।
ভাষাগত দিক থেকে, কিবরিয়াহ মহত্বের ধারণাকে নির্দেশ করে। কাবীর গুনটি এমন একজনের জন্য প্রযোজ্য যিনি পদমর্যাদা বা দক্ষতায় মহান। আল্লাহ হলেন আল-কাবীর-সর্বমহান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ; তাঁর প্রতিটি গুণের জন্য তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ।
আল-কাবীর নিজেই বলেছেন –
فَالۡحُکۡمُ لِلّٰهِ الۡعَلِیِّ الۡکَبِیۡرِ
হুকুম দেয়ার মালিক আল্লাহ- যিনি সর্বোচ্চ, সর্বশ্রেষ্ঠ।
[সূরা-গাফির-৪০:১৩]
اَنَّ اللّٰهَ هُوَ الۡعَلِیُّ الۡکَبِیۡرُ
আর নিশ্চয় আল্লাহ তো সমুচ্চ, সুমহান।
[আল-হাজ্জ-২২:৬২]
اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیًّا کَبِیۡرًا
নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান।
[সূরা আন-নিসা-৪:৩৪]
দুনিয়া ও আখেরাতের মর্যাদা:
স্বাভাবিকভাবেই যারা সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে বাগ্মী, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে উদার, সবচেয়ে করুণাময় ইত্যাদি …… তাদের প্রশংসা করার প্রবণতা আমাদের রয়েছে।
اُنۡظُرۡ کَیۡفَ فَضَّلۡنَا بَعۡضَهُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ وَ لَلۡاٰخِرَۃُ اَکۡبَرُ دَرَجٰتٍ وَّ اَکۡبَرُ تَفۡضِیۡلًا
ভেবে দেখ, আমি তাদের কতককে কতকের উপর কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। আর আখিরাত নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহান এবং শ্রেষ্ঠত্বে বৃহত্তর।
[সূরা আন-নামাল-২৭:২১]
এই পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব লোকও আখেরাতে সবচেয়ে ধনী হতে পারে; এটা এমন একটি বিষয় যা নির্ভর করে আল্লাহ আল-কাবীর এর সঙ্গে আপনার পদমর্যাদার ভিত্তিতে।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
বেশি বেশি তাকবীর বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রচুর তাকবীর – ‘আল্লাহু আকবার‘ বলে রাসুলের (ﷺ) সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করুন।
ইবনু উমার (রা.) বলেন, একদিন আমরা রাসুলের (ﷺ) সাথে নামায পড়ছিলাম। সে সময় সমাগত লোকদের মাঝে হতে এক লোক বলল –
اللَّهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا وَسُبْحَانَ اللَّهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً
আল্লাহু আকবার কাবিরা, ওয়াল হামদুলিল্লাহি কাছিরা, ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতাও ওয়া আসিলা’
অর্থ: আল্লাহ মহান, অতি মহান, আল্লাহ তা’আলার জন্য অনেক অনেক প্রশংসা এবং সকাল-সন্ধ্যা আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।
তখন রাসুল (ﷺ) জিজ্ঞাস করলেন কে বলল এসব কথা? তখন উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে লোকটি বলল, আমি, হে আল্লাহর রাসূল, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রাসুল (ﷺ) বললেন, কথাটি আমাকে আশান্বিত করেছে। এ কথার কারণে আসমানের দরজাসমূহ খুলে গেছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, রাসুলের (ﷺ) কণ্ঠে এরূপ কথা শোনার পর থেকে আমি ঐ বাক্যগুলো (কখনও) বলতে ছাড়িনি।
[মুসনাদে আহমদ, মুসলিম, তাবরানি]
আল-কাবীরের কাছে
আনন্দ এবং সুখ খুঁজে নিন। স্বভাবগতভাবেই মানুষ ভালোবাসা এবং পরিপূর্ণতা অন্বেষণ করে। আল্লাহ আল-কবীর সমস্ত পরিপূর্ণতার উৎস। প্রকৃতপক্ষে, আপনি যত বেশি তাঁর সম্পর্কে, তাঁর নামগুলি এবং তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে জানতে পারবেন, তত বেশি আপনি সত্যিকারের ভালবাসা এবং ভক্তির সাথে তাঁর দিকে ফিরে আসবেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে নিরাপদ এবং প্রশান্তি বোধ করবেন।
আল-কাবীর এর মহত্বকে সঠিক উপায়ে মূল্যায়ন করুন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছেন:
وَ رَبَّکَ فَکَبِّرۡ
আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।
[সূরা আল-মুদ্দাসসির-৭৪:৩]
যে শব্দগুলো দ্বারা আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা করা হয় সেই শব্দগুলো যেমন -তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) এবং তাকবীর (আল্লাহু আকবার) বেশি বেশি পড়ুন। এই শব্দগুলোর অর্থ অনেক ব্যাপক, শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ নিয়ে চিন্তা করুন, এবং এগুলোর অপব্যবহার না করার বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
মূল উৎস থেকে পরিপূর্ণতার সন্ধান করুন। অন্যদের মাঝে পরিপূর্ণতা খুঁজে হতাশ হতে যাবেন না। যাদের সম্পদ এবং মর্যাদা আছে, কিন্তু ঈমান নেই – এমন লোকের প্রশংসা করে সময় নষ্ট করবেন না। আপনার প্রভুর প্রশংসা করুন, এবং তাঁর উপর নির্ভর করুন। তিনি কখনোই আপনাকে হতাশ করবেন না, বরং ছোট কাজের বিনিময়ে বিশাল পুরস্কার দিয়ে তিনি আপনাকে বিস্মিত করবেন।
কখনো অহংকারী হবেন না। নিজেকে অহংকার (কিবর) থেকে রক্ষা করুন। অন্যদের কখনই অবজ্ঞার চোখে দেখবেন না; আল-কাবীরের সাথে তাদের পদমর্যাদা কি রকম তা কিন্তু আপনি জানেন না। আল্লাহর আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার আচরণেও অহংকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।
ইবলীসের পাপ লক্ষ্য করুন; অহংকার বশত সে মাথা নত করতে অস্বীকার করে। নিজেকে আল্লাহর আদেশের অবাধ্যতা থেকে দূরে রাখার জন্য একটি ভাল টিপস হল আপনি যে মুহূর্তে কোন অন্যায় করতে যাচ্ছেন, সেই মুহূর্তে উপরের দিকে তাকান এবং কল্পনা করুন যে আল-কবীর আপনাকে দেখছেন- আপনি কি তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁকে “না” বলার সাহস করবেন?
আল-কাবীরের কাছে উচ্চ পদ লাভের জন্য চেষ্টা করুন। আল-কাবীরের দৃষ্টিতে মহান হওয়ার জন্য একমাত্র তাঁরই মহিমা ঘোষণা করুন এবং নম্র হন। যদি আল্লাহ আল-কবীর আপনাকে জ্ঞানে, চাকরির অবস্থানে বা অন্য কোনো দক্ষতায় এই পৃথিবীতে কাবীর হওয়ার আশীর্বাদ দান করেন, তাহলে অন্যদের উপকার করুন এবং পরকালে তাঁর দৃষ্টিতে সত্যিকারের কাবীর হয়ে উঠুন।
আল-কাবীরকে ডাকুন।এই নামটি ব্যবহার করে দু’আ করুন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন যেন তিনি আপনাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেয়ে উত্তম মর্যাদা বা অর্জন আর কিছুই হতে পারে না। আল-কাবীর বলেছেন –
اِنَّ اِلَیۡنَاۤ اِیَابَهُمۡ
নিশ্চয় আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন।
[সূরা আল গাশিয়াহ-৮৮:২৫]
ثُمَّ اِنَّ عَلَیۡنَا حِسَابَهُمۡ
তারপর নিশ্চয় তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই দায়িত্বে।
[সূরা আল গাশিয়াহ-৮৮:২৫]
সর্বদা আপনার প্রার্থনায় উচ্চ লক্ষ্য স্থির করুন – হিসাব ছাড়াই জান্নাতুল
ফেরদাউস, সর্বোচ্চ জান্নাতের জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন।
আপনার প্রভুকে নিয়ে, আপনার দ্বীন, এবং এর আদেশ এবং নিষেধাজ্ঞা নিয়ে গর্বিত হন। আল্লাহর দ্বীন বা আদেশের জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত নয়। যখন কোন অনুষ্ঠানে আপনাকে মদ্যপান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন ক্ষমা চাইবেন না, এবং অজুহাত দেখাবেন না এই বলে যে –
“দুঃখিত! আমার পেটে ব্যথা করছে”, বরং আপনার গর্ব করে বলা উচিত, “আমি মদ্যপান করি না, কারণ এটি ইসলাম ধর্মে হারাম।”
আপনি যদি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ আল-কাবীর, তাহলে যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো স্থানে এবং যেকোনো সমাবেশে আপনার প্রভুর প্রতি, এবং তাঁর আদেশ নিষেধের প্রতি আপনার গর্ববোধ করা উচিত।
আপনার তাকবীর অনুভব করার চেষ্টা করুন। আপনার জীবনে আকবর আসলে কি?
রাসুল (ﷺ) আপনাকে আপনার সালাতের শুরুতে এবং পুরো সালাত জুড়ে বিভিন্ন সময়ে আল্লাহু আকবার বলতে শিখিয়েছেন। যখনই আপনি আজানে এবং নামাযে আল্লাহু আকবার বলেন বা শুনেন, তখনই এর অর্থ উপলব্ধি করুন। জেনে রাখুন যে আল-কাবীর আপনি যা কল্পনা করতে বা ভাবতে পারেন তার চেয়ে অনেক বড়। আপনি যখন প্রার্থনা শুরু করার জন্য আপনার হাত তুলেন, তখন কল্পনা করুন — আপনি পুরো বিশ্বকে পিছনে ফেলে দিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছেন।
হে আল্লাহ আল-কাবীর আমরা জানি যে আপনি মহত্বের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ, নিখুঁত, এবং পরিপূর্ণ। আপনার মহত্বকে অনুভব করে যেন আমরা আপনার আদেশ মেনে চলতে পারি সে ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করুন। সঠিক উপায়ে আপনার মহিমা ঘোষণা করতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করুন। ইসলামের গৌরবে আমাদের সুসজ্জিত করুন, অহংকার থেকে আমাদের রক্ষা করুন, আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। আল্লাহুম্মা আমীন।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।