আসমাউল হুসনা – আল-জামিই
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে জামিই’—সংগ্রাহক, সঞ্চায়ক, একত্রকারী বলেছেন দুইবার। তিনিই সবাইকে সমবেত করেন, পুনর্মিলিত করেন, একত্রিত করেন। আল-জামিই’ সমগ্র মহাবিশ্বকে একত্রিত করেন, হৃদয়ের মিলন ঘটান, তিনি বিপরীত এবং অনুরূপ জিনিসকে সংযুক্ত করেন এবং তিনি তাঁর সামনে দাঁড়ানোর জন্য সকলকে একত্রিত করবেন!
জামিই’ এসেছে ج-م-ع এর মূল থেকে, যা চারটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল একত্রিত করা, বা জমা করা; দ্বিতীয় অর্থ সংযোগ করা করা; তৃতীয় অর্থ হল পুনর্মিলন বা সমাধান করা; এবং চতুর্থ অর্থটি হল সুবিন্যস্ত করা বা রচনা করা।
এই মূলটি কুরআনে ১২৯ বার ১১টি উদ্ভূত রূপে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল يَجْمَعُونَ – ইয়াজমাউ’না (তারা জমা হয়), أَجْمَعِينَ -আজমায়ি’না (একত্রে/একসঙ্গে), الْجَمْعَانِ – আল-জামাআ’নি (দুটি শক্তি/ সৈন্যবাহিনী) এবং جَمِيعٌ -জামা’উ (একত্রিত)।
ভাষাগতভাবে, جمع ধারণাটি শারীরিক সমাবেশ এবং মিলন উভয়কেই বোঝায়, যেমন ইয়াওম উল-জুমুআহ – যেদিন মানুষ একত্রিত হবে এবং আলেমদের মতে اِجْمَعْ – ‘ইজমা আধ্যাত্মিক পুনর্মিলন অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন শত্রুতার পরে মানুষের হৃদয়কে একত্রিত করা।
আল-জামিই’ আমাদের শরীরের সব উপাদানকে একত্রে কাজ করান, তিনি পৃথিবীতে বসবাসকারী সমস্ত বিভিন্ন প্রাণীকে একত্রিত করেন। তিনিই আমাদেরকে বিনাশ করবেন এবং পুনরায় রচনা করবেন যখন বিচার দিবসে সবাইকে একত্রিত করবেন!
আল-জামিই’ নিজেই বলেছেন –
رَبَّنَآ إِنَّكَ جَامِعُ ٱلنَّاسِ لِيَوۡمٍ لَّا رَيۡبَ فِيهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُخۡلِفُ ٱلۡمِيعَادَ
হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি মানুষকে সমবেত করবেন এমন একদিন, যাতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।1
....إِنَّكُمۡ إِذًا مِّثۡلُهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ جَامِعُ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡكَٰفِرِينَ فِى جَهَنَّمَ جَمِيعًا
....নিশ্চয়ই তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের সকলকে জাহান্নামে একত্রকারী।2
সমাবেশের দিন:
শুক্রবার, বা আল-জুমুআ’র দিন – আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’ প্রদত্ত মুমিনদের জন্য একটি আশীর্বাদ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমাদের পূর্বে যারা এসেছিল আল্লাহ তাদেরকে আল-জুমুআ (জমায়েতের দিন/শুক্রবার দিন) থেকে বিভ্রান্ত করেছেন। সুতরাং ইহুদীরা ইয়াওমুস-সাবত (শনিবার) এবং খ্রিস্টানরা ইয়াওমুল-আহাদ (রবিবার) এর দিকে পরিচালিত হয়েছিল। অতঃপর, আল্লাহ আমাদেরকে আল-জুমুআহর দিকে পরিচালিত করলেন। অধিকন্তু, তারা আমাদেরকে ইয়াওমুল-কিয়ামাহ অর্থাৎ দাঁড়িয়ে হিসাব গ্রহণের দিনে অনুসরণ করবে। আমরাই আহলুদ-দুনিয়ার (এই জীবনের মানুষ) মধ্যে সর্বশেষ এবং ইয়াওমুল-কিয়ামাহর মধ্যে সর্বপ্রথম মানুষ।3
পুনরুত্থান দিবসকে একত্রিত হওয়ার দিনও বলা হয়, কারণ সেদিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে তাদের চূড়ান্ত বিচারের জন্য একত্র করবেন। এটাই সেই মহান সমাবেশ। আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল আমাদেরকে ইয়াওমুল জামিই’ (সমাবেশের দিন) সম্পর্কে বলেন –
يَوۡمَ يَجۡمَعُكُمۡ لِيَوۡمِ ٱلۡجَمۡعِۖ ذَٰلِكَ يَوۡمُ ٱلتَّغَابُنِۗ وَمَن يُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ وَيَعۡمَلۡ صَٰلِحًا يُكَفِّرۡ عَنۡهُ سَيِّئَاتِهِۦ وَيُدۡخِلۡهُ جَنَّٰتٍ تَجۡرِى مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ
স্মরণ কর, যেদিন সমাবেশ দিবসের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তোমাদের সমবেত করবেন, ঐ দিনই হচ্ছে লাভ-ক্ষতির দিন। আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তিনি তার পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়, তথায় তারা স্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য।4
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
সেই মহাসমাবেশের দিনকে স্মরণ করুন।
ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ لَيَجۡمَعَنَّكُمۡ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ لَا رَيۡبَ فِيهِۗ وَمَنۡ أَصۡدَقُ مِنَ ٱللَّهِ حَدِيثًا
আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে একত্র করবেন কিয়ামতের দিনে। এতে কোন সন্দেহ নেই। আর কথায় আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী কে?5
আল্লাহ আজ্জা’ ওয়া জালের মহানুভবতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন, যিনি সমস্ত মানবজাতিকে এক জায়গায় একত্রিত করতে সক্ষম। প্রতিদিন তাঁর সামনে আপনার দাঁড়ানোর কথা ভাবুন যিনি আল-জামিই’।
সেই দিন আল-জামিই’র ছায়ার জন্য এখন থেকেই চেষ্টা করুন। আপনার জ্ঞান এবং বিচার দিবসের স্মরণকে আপনার কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত করুন।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন,
আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন— যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না;
- এক. ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা),
- দুই. এমন যুবক যার যৌবন আল্লাহ তাআলার ইবাদতে অতিবাহিত হয়,
- তিন. যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।)
- চার. ওই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।
- পাঁচ. সেই ব্যক্তি যাকে কোনো সুন্দরী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।’
- ছয়. সেই ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে, তা তার বাম হাতও জানতে পারে না। সাত. যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।’6
এই প্রত্যেকটি শ্রেণী মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করুন এবং আপনার দৈনন্দিন জীবনে এদের অনুশীলন করার চেষ্টা করুন, আপনার স্থানীয় মসজিদের সাথে সংযোগ স্থাপন করুন এবং মসজিদের ব্যাপারে যত্নশীল হন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য লোকেদের সাথে একত্রিত হন, গোপন সাদাকাহ দিন এবং নিভৃতে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও ভয়ে কাঁদুন।
শুক্রবারের শিষ্টাচার এবং আদবগুলো পালন করুন। ইয়াওমুল জুমুআহ আপনার জীবনে কেমন ভূমিকা পালন করে? শুক্রবারের ফযীলত অধ্যয়ন করুন এবং সুন্নতের অনুশীলন করুন যাতে আপনি প্রচুর সওয়াব পেতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-কাহফ পাঠ করুন, গোসল করুন, জুমুআর নামায পড়ুন এবং খুতবা শুনুন এবং এর জন্য তাড়াতাড়ি মসজিদে যান। এছাড়াও যতটা সম্ভব আল্লাহর ‘আজ্জা ওয়া জাল’-এর কাছে দু’আ করুন, বিশেষ করে ‘আসরের শেষ প্রহরে এবং নবীর (সা.) উপর প্রচুর পরিমাণে সালাওয়াত পাঠ করুন।
জুম্মার দিনের ফজিলত এবং এর সওয়াব সম্পর্কে প্রচুর হাদিস আছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
সবচেয়ে উত্তম দিন হল শুক্রবার। কাজেই সেদিন আমার উপর সালাম ও রহমত বর্ষণ কর, কেননা তোমাদের সালাম এবং দরুদ আমার কাছে পেশ করা হবে7
জুমার দিনে এমন একটা সময়ে রয়েছে, যাতে আল্লাহর বান্দা আল্লাহর কাছে যা চায় আল্লাহ তাই দেন। অতএব তোমরা আসরের শেষ সময়ে তা তালাস করো।8
যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে, তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত নূর উজ্জ্বল করা হবে।9
যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে, যদি তার নিকট থাকে, তারপর জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়, নির্ধারিত নামাজ আদায় করে, তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে, তাহলে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সমস্ত সগিরা গুনাহর জন্য কাফ্ফারা হবে।10
সবাইকে একত্রিত করতে চেষ্টা করুন, আপনার জ্ঞান এবং কর্মের মাঝে সমন্বয় সাধন করুন। সালাতের মতো ব্যক্তিগত উপাসনা ছাড়াও, আল-জামি’ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন তাঁর সৃষ্টিকে সাহায্য করার জন্য, মানুষকে একত্রিত করার জন্য এবং তাদের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার জন্য।
হে আল্লাহ, আল-জামি’, আমরা জানি যে আপনি সবকিছুকে একত্রিত করেন। আপনি আমাদেরকে এবং আপনার সমস্ত সৃষ্টিকে যেভাবে একত্রিত করেছেন তা নিয়ে আমাদেরকে চিন্তা ভাবনা করার তৌফিক দিন। ইয়াওমুল-জুমুয়ার সুন্নতগুলো পালন করতে আমাদের সহায়তা করুন, আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা জামাআতে (ধর্মীয় সমাবেশে) যোগদান করে, এবং অন্যদেরকে কল্যাণের জন্য একত্রিত করে। আমাদের অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিন যাতে আমরা সেই মহা-সমাবেশের দিনকে বারবার স্মরণ করতে পারি এবং এই পৃথিবীতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই সেই বিশেষ দিনে আপনার ছায়ার নিচে থাকার জন্য।
আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আল-জামিই’
- সূরা আলি ইমরান – ৩ : আয়াত -৯ ↩︎
- সূরা আন-নিসা – ৪ : আয়াত -১৪০ ↩︎
- সহিহ মুসলিম ↩︎
- সূরা আত-তাগাবুন -৬৪: আয়াত-৯ ↩︎
- সূরা আন-নিসা -৪: আয়াত-৮৭ ↩︎
- বুখারি, হাদিস : ১৪২৩; মুসলিম, হাদিস : ১০৩১ ↩︎
- আবু দাউদ, আন-নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ↩︎
- আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮, নাসাঈ, হাদিস : ১৩৮৯ ↩︎
- তিরমিজি, আহমেদ ↩︎
- আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৩ ↩︎