আসমাউল হুসনা – আল-হাফীজ

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে তিনবার আল-হাফীজ- মহা-রক্ষাকারী, সর্ব-সচেতন নামে উল্লেখ করেছেন। এই জগতের সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন, এবং তিনিই সংরক্ষণ করেন। আমরা যা করি আল-হাফীজ তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, এবং তিনি আমাদের এমন কিছু থেকে রক্ষা করেন যা অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না, বিশ্বাসীদেরকে তিনি তাঁর বিশেষ সুরক্ষা অর্জনের অনেক সুযোগ দেন!

একই মূল থেকে এসেছে ْحَفِيظ এবং حَفِظ, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল
পাহারা দেওয়া,
রক্ষা করা, বাজায় রাখা এবং যত্ন নেওয়া, এই মূলের দ্বিতীয় অর্থ হল ধ্বংস হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা, এবং তৃতীয় অর্থ হল সতর্ক, মননশীল, মনোযোগী থাকা।

এই মূলটি কুরআনে ৪৪ বার আটটি উদ্ভূত রূপে উপস্থিত হয়েছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল حَفِيظًا – হাফিজান (“অভিভাবক”), مَحْفُوظ মাহফুদ (“সুরক্ষিত”), এবং وَحَفِظْنَاهَا ওয়াহাজনা-হা (“এবং আমরা তা রক্ষা করেছি”)।

ভাষাগতভাবে, হাফীজ এমন ব্যক্তির জন্য ব্যবহৃত হয় যিনি কুরআন মুখস্থ করেছেন। আল-হাফীজ হলেন সমগ্র সৃষ্টির চূড়ান্ত সংরক্ষক, অভিভাবক এবং রক্ষাকর্তা।

....وَلَا تَضُرُّونَهُۥ شَيۡئًاۚ إِنَّ رَبِّى عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ حَفِيظٌ
.....আর তোমরা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয় আমার রব সব কিছুর হেফাযতকারী।1
إِلَّا لِنَعۡلَمَ مَن يُؤۡمِنُ بِٱلۡأٓخِرَةِ مِمَّنۡ هُوَ مِنۡهَا فِى شَكٍّۗ وَرَبُّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ حَفِيظٌ
তবে কে আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে আর কে তাতে সন্দেহ পোষণ করে তা প্রকাশ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আর তোমার রব সকল কিছুর হিফাযতকারী।2

জ্ঞান, সংরক্ষণ, এবং প্রতিদান:

আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়াজাল নিজের উপর ভুলে যাওয়াকে অস্বীকার করেছেন; তিনি জ্ঞানকে রক্ষা করেন এবং কখনই ভুলে যান না। মূসা (আ:) এই সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন:

قَالَ عِلۡمُهَا عِندَ رَبِّى فِى كِتَٰبٍۖ لَّا يَضِلُّ رَبِّى وَلَا يَنسَى
মূসা বলল, ‘এর জ্ঞান আমার রবের নিকট কিতাবে আছে। আমার রব বিভ্রান্ত হন না এবং ভুলেও যান না’।3

আমাদের জানতে হবে যে হাফিজ শব্দটি তিনটি আঙ্গিকের সমন্বয়:
প্রথমত, জ্ঞান (‘ইলম),
তারপর সংরক্ষণ (হিফজ)
এবং তারপর প্রতিদান (হিসাব)। উদাহরণস্বরূপ, আপনি মেঝে থেকে একটি ছোট ময়লা অপসারণ করতে পারেন যাতে কেউ সেখানে পিছলে না পরে। যদিও কেউ তা দেখেনি, তবুও আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে আল্লাহ এ সম্পর্কে অবগত, তারপরে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি এই ঘটনাটি সংরক্ষণ (হিফজ) করবেন; এবং অবশেষে আপনার নিশ্চিত হওয়া উচিত যে আল-হাফিজ আপনাকে এর জন্য প্রতিদান দেবেন।

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে যাই করুক না কেন, এটি তার জন্য প্রযোজ্য! কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহর
আল-আলিম (সব-জ্ঞানী),
আল-হাফীজ (মহা-সংরক্ষণকারী) এবং
আশ-শাকুর (প্রশংসাকারী) – এই তিনটি সুন্দর নামের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে।

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবেন?

আল-হাফীজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। আল-হাফীজ তাঁর জ্ঞান দ্বারা আপনি যা কিছু করেন তার প্রতি মনোযোগী। তিনি তাঁর ফেরেশতাদের আদেশ করেন আপনি যা কিছু করেন তা রেকর্ড করার জন্য। এমনকি ক্ষুদ্রতম কাজ, যেমন একটি ইসলামী বক্তৃতায় আসা, সুন্দরভাবে বসা এবং নোট তৈরি করা— আল-হাফীজ এসব সবই সংরক্ষণ করেন এবং প্রশংসা করেন। যখন আপনি এটা উপলব্ধি করতে পারবেন, তখন আপনি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর দাস হয়ে যাবেন, মানুষের নয়।

আল-হাফীজকে ভয় করুন। আপনি যখন খারাপ কাজ করেন তখনও তিনি আল-হাফীজ। মনে রাখবেন আপনার “খুব ছোট” ভুল কাজটিও তিনি দেখেন, সংরক্ষণ করেন এবং এর জন্য তিনি আপনাকে প্রতিদান দিবেন, যদি না আপনি অনুতপ্ত হন। যেমন নামাজে আপনার হৃদয়ের উপস্থিতি প্রয়োজন। খুশু মানে হৃদয়ের উপস্থিতি ( حضور القلب-হুদুর আল ক্বালব) এবং উপলব্ধি (فحم -ফাহম)। হতে পারে শুধুমাত্র একটি রুকুতে আপনি আল্লাহকে স্মরণ করেছেন, এবং বাকি সময় আপনার অন্তর বিক্ষিপ্ত বা গাফেল ছিল।

আল্লাহ আল-হাফীজ, এমনকি জানেন যে আপনি কেবলমাত্র একটি রুকুতে তাঁকে স্মরণ করেছেন; অতঃপর তিনি আপনার রুকুর এই স্মরণকে সংরক্ষণ করবেন, এবং এর জন্য আপনাকে প্রতিদান দিবেন। আপনার ভাল বা খারাপ কাজের উপর নির্ভর করে আল-হাফীজ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন বা শাস্তি দিবেন। তাই এই নামটি আপনার মনে আশা (রাজা) এবং ভয় (আল-খাওফ বা খাশিয়াহ) উভয়ই জাগিয়ে তোলে।

মানুষকে মনে রাখুন। সিফাত উল মু’মিনীন অর্থাৎ মুমিনদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, অন্যদের প্রতি মনোযোগী হওয়া। হয়তো কোন এক সময় আপনার কারো সাথে দেখা হয়েছে এবং তখন আপনি তাকে একটি কলম ধার দিয়েছেন। অনেক বছর পরেও ওই ব্যক্তি যদি সেই কথা মনে রাখে, তাহলে আপনি খুশি হবেন, তাই না?
স্মরণ করার এই গুণের সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে কখনও ভুলে যাননি।

কুরআন মুখস্থ করুন। যারা তাঁর কিতাব, আল-কুরআন মুখস্থ করে এবং অন্তরে সংরক্ষণ করে, তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করুন। কুরআন মুখস্থ করার সময় আল-হাফীজকে ডাকুন, এবং এই কিতাবকে আপনার অন্তরে সংরক্ষিত করার জন্য তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করুন।

আপনার অন্তরকে পবিত্র করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি কাউকে অপছন্দ করার কারণে তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেন। আপনি যা করেছেন তা আল-হাফীজ কখনো ভুলেন না; এই জ্ঞান তাঁর কাছে সংরক্ষিত থাকে, হয়ত কোন এক সময় তিনি আপনাকে একই পরিস্থিতিতে ফেলবেন যেখানে আপনি নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও কেউ আপনাকে ভুলভাবে অভিযুক্ত করছে বা আপনার সম্পর্কে অসত্য কিছু বলছে।

যখন এরকম পরিস্থিতি ঘটে, তখন আপনি অন্য কারো সাথে অন্যায়ভাবে যা করেছেন তা স্মরণ করুন, এবং এর জন্য অনুতপ্ত হন। আল-হাফীজ আসলে আপনাকে পরীক্ষায় ফেলছেন, কারণ তিনি পূর্বের ঘটনাটি সংরক্ষণ করেছেন, যা আপনি হয়তো ভুলে গেছেন বা তুচ্ছজ্ঞান করেছেন।

আল-হাফীজের বিশেষ সুরক্ষার জন্য প্রচেষ্টা করুন। আবু তাইয়্যেব আত-তাবারী ছিলেন একজন প্রারম্ভিক যুগের আলেম; প্রায় একশ বছর বয়সেও তিনি শারীরিকভাবে একজন যুবকের মতো শক্তিশালী ছিলেন। একবার এক ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর, আবু তাইয়্যেব আত-তাবারী নৌকা থেকে জমিতে ঝাঁপ দেন। মানুষ অবাক হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আমি যখন যুবক ছিলাম, তখন আমি এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে রক্ষা করেছিলাম, এবং আল্লাহ আমার বৃদ্ধ বয়সে এগুলোকে আমার জন্য সংরক্ষণ করেছেন।’4

আপনার যাবতীয় ধার্মিক এবং পার্থিব বিষয়ে আল-হাফীজের বিশেষ সুরক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করুন। রাসুল (সা.) বলেছেন: আল্লাহর আদেশকে হেফাজত করুন, তিনি আপনাকে হেফাজত করবেন এবং রক্ষা করবেন।5

আল-হাফীজের প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। আল-হাফীজ আপনার শরীরকে একটি আশ্চর্যজনক উপায়ে সংরক্ষণ করেন; একবার কল্পনা করে দেখুন, যদি আপনার রক্ত ​​​​আপনার মস্তিষ্কে অবাধে প্রবাহিত হতো। আল-হাফীজের প্রতি কৃতজ্ঞ হোন কারণ তিনি আপনাকে রক্ষা করেন, এবং এমনভাবে রক্ষা করেন যে আপনি তা বুঝতেও পারেন না।

আপনার চারপাশের পরিবেশ অবলোকন করুন এবং আল হাফীজের প্রতি আপনার মুগ্ধতা বাড়িয়ে তুলুন। আল-হাফীজ যেভাবে সবচেয়ে বড় সৃষ্টিগুলিকে সংরক্ষণ করেছেন তা দেখে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তিনিই আকাশকে আমাদের উপর পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর অনুগ্রহে আমরা লবণ দিয়ে খাবার সংরক্ষণ করি, আবার ফ্রিজেও খাবার সংরক্ষণ করি, আর টাকা-পয়সা সংগ্রহ করি ব্যাংকে। আল্লাহ হলেন আল-হাফীজ এবং তিনি মানুষের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং সম্পদ সবকিছুই সংরক্ষণ করেন।

আল-হাফীজের কাছে তওবা করুন। এই নামটি আপনাকে আল্লাহর আল-আলিম নামের চেয়েও বেশি নাড়া দেবে, কারণ আল-হাফীজ কেবল ইঙ্গিত করে না যে তিনি সবকিছু জানেন, বরং তিনি ছোটখাটো সব জিনিসও মনে রাখেন। আপনার আল-হাফীজের ক্ষমা প্রয়োজন, তাই এই নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল এটি আপনাকে দেরি না করে দ্রুত তওবা করতে অনুপ্রাণিত করে।

হে আল্লাহ, আল-হাফীজ, আমরা জানি- যা ছিল, আছে এবং থাকবে সবই আপনি রক্ষা করেন। আপনার আদেশ পালনে সাহায্য করার মাধ্যমে আমাদেরকে আপনার বিশেষ সুরক্ষা দিন; এমনকি ক্ষুদ্রতম পাপের বিষয়েও আমাদেরকে সচেতন হতে সাহায্য করুন; এবং আপনার সুরক্ষার জন্য আমাদেরকে তওবা করতে এবং আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে সাহায্য করুন। যারা কুরআন মুখস্ত করে, আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে সম্মানিত করুন। আপনার জ্ঞান, সংরক্ষণ এবং প্রতিদান সম্পর্কে বিশ্বাসে আমাদের সচেতন হতে সাহায্য করুন, যাতে আমরা আপনার সন্তুষ্টি অর্জনে এবং চিরস্থায়ী জান্নাত অর্জনে সক্ষম হই। আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আল- হাফীজ

আসমাউল হুসনা

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

  1. সূরা হুদ-১১: আয়াত-৫৭ ↩︎
  2. সূরা সাবা-৩৪: আয়াত- ২১ ↩︎
  3. সূরা ত্বহা-২০: আয়াত-৫২ ↩︎
  4. ইবনে রজব ↩︎
  5. আহমাদ, তিরমিযী ↩︎
Exit mobile version