আল্লাহ নিজেকে আল-বার্ – মঙ্গলের উৎস, সদয় দানকারী- বলেছেন পবিত্র কুরআনে একটি উপলক্ষে। তিনিই সবচেয়ে দয়ালু ও বিনয়ী, তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি অতিব নম্র। আল-বার্ সমস্ত সদাশয়তার উৎস, তাঁর সমস্ত আশীর্বাদ এবং অনুগ্রহের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টির জন্য যা ভাল তাই করছেন প্রতিনিয়ত।
বার্ এসেছে ب-ر-ر এর মূল থেকে, যা পাঁচটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল নিষ্ঠাবান এবং নম্র হওয়া; এবং দ্বিতীয়টি হল ন্যায়পরায়ণ, সঠিক এবং সৎ হওয়া; তৃতীয় অর্থ হল কারো পরিস্থিতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া; এবং চতুর্থটি হল প্রচুর উপহার দেওয়া, এবং যথেষ্ট হওয়া; পঞ্চম প্রধান অর্থ হল ভাল কাজ করা এবং ধার্মিক হওয়া।
এই মূলটি কুরআনে ৩২ বার তিনটি উদ্ভূত রূপে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল الْبِرَّ-আল-বিররা (ধার্মিকতা/ পূণ্য), ٱلۡأَبۡرَارِ-আল-আবরারি (ধার্মিক) এবং البر- আল-বার (ভূমি)।
ভাষাগতভাবে, আল-বির্ একটি অনন্য শব্দ যা সমস্ত ধার্মিকতা এবং ভাল আচরণকে অন্তর্ভুক্ত করে [ইবনে ‘হাজর আল-হায়তামি] আল-বার্ সমস্ত ধার্মিকতার উৎস, তাঁর কাছ থেকেই প্রতিটি ভাল কাজ আসে। আল-বার্ তাঁর বান্দাদের পাপ ও অবাধ্যতার কারণে তাঁর ইহসান বন্ধ করেন না। [ইমাম আল-কুরতুবী] তিনি অন্যায়কারীদের প্রতি দয়াশীল, তিনি সীমালঙ্ঘনকারীকে এবং পাপীকে ক্ষমা করেন। যারা অনুতপ্ত হয়, তিনি তাদের দিকে ফিরে তাকান; যারা তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তিনি তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। তিনি প্রশংসনীয় কাজ এবং ভাল প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর বান্দাদের দিকে ফিরে তাকান, যখন তিনি নিজেই এসবের সবচেয়ে বেশি যোগ্য। [আর-রাজি]!
আল-বার্ নিজেই বলেছেন-
إِنَّا كُنَّا مِن قَبۡلُ نَدۡعُوهُۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡبَرُّ ٱلرَّحِيمُ
নিশ্চয় পূর্বে আমরা তাঁকে ডাকতাম; নিশ্চয় তিনি ইহসানকারী, পরম দয়ালু।1
আল-বির্ (الْبِرُّ) বনাম আল-ইসম (الْإِثْمُ):
হাদিস থেকে আমরা আল-বির্ এবং এর বিপরীতে আল-ইসম সম্পর্কে একটি সুন্দর ব্যাখ্যা পাই। এক ব্যক্তি এসে রাসুলের (ﷺ) কাছে ধার্মিকতা ও গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তাই রাসুল (ﷺ) বললেন, ‘সৎকর্ম (আল-বির্) হল উত্তম আচরণ, আর পাপ (আল-ইসম/ ألاثم) হল যা আপনার বুকে ওঠানামা (তরঙ্গায়িত হয়) করে, এবং আপনি অপছন্দ করেন যখন লোকেরা আপনার সম্পর্কে তা জানতে পারে। [আত-তিরমিযী]
আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া’জাল কুরআনের একটি আয়াতে আল-বির্ এর সংজ্ঞাটি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই আয়াতটিতে প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। একটি হল সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াত।
لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّـۧنَ وَءَاتَى ٱلۡمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِۦ ذَوِى ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينَ وَٱبۡنَ ٱلسَّبِيلِ وَٱلسَّآئِلِينَ وَفِى ٱلرِّقَابِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلۡمُوفُونَ بِعَهۡدِهِمۡ إِذَا عَٰهَدُواْۖ وَٱلصَّٰبِرِينَ فِى ٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَحِينَ ٱلۡبَأۡسِۗ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُتَّقُونَ
ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী।[২:১৭৭]
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আসুন সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতটি আমরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখি।
আপনার ঈমানের ব্যাপারে যত্নশীল হন।
لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّـۧنَ....
ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি....[২:১৭৭]
প্রথমত আল্লাহ আল-বারকে বিশ্বাস করতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে সেই দিনকে যেদিন তিনি মানুষের ভালো এবং মন্দ কাজের প্রতিদান দিবেন, ফেরেশতাদেকে যাদের মধ্যে কাউকে কাউকে তিনি নিয়োজিত করেছেন মানুষের সৎকর্ম ও পাপ কাজগুলি লিপিবদ্ধ করতে। আল-বার্ মানবজাতিকে আল-বিরের (ٱلۡبِرَّ -পূণ্যের) পথে পরিচালিত করার জন্য তাঁর কিতাব এবং নবীদের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করেছেন! আরকান উল ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাসের স্তম্ভগুলো ভালোভাবে অধ্যয়ন করুন এবং তা মেনে চলুন।
নামাজ এবং যাকাতের মাধ্যমে নিজেকে শুদ্ধ করুন।
....وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ...
....যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়...[২:১৭৭]
সালাতের মাধ্যমে নিজেকে আধ্যাত্মিকভাবে শুদ্ধ করুন, নামাজে আপনি যা পড়েন তা বোঝার চেষ্টা করুন, এবং নামাজে মনোনিবেশ করুন। প্রতিটি মুহূর্তে সঠিক এবং ন্যায়পরায়ণতার পথে থাকার জন্য আল-বার্ এর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন। আর আপনার সম্পদ পবিত্র করার জন্য যাকাত দিন।
আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন, সত্য কথা বলুন এবং সত্যের উপর ভিত্তি করে কাজ করুন।
...وَٱلۡمُوفُونَ بِعَهۡدِهِمۡ إِذَا عَٰهَدُواْۖ....
....এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে....[২:১৭৭]
আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন, তা যত বড় বা ছোটই হোক না কেন, এমনকি তা যদি হয় আপনার ভাইবোনের লেখাপড়ায় সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি, বা আপনার সন্তানকে মিষ্টি খেতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
রাসুল (ﷺ) বলেছেন,
‘সত্য নেকীর দিকে পরিচালিত করে আর নেকী জান্নাতে পৌঁছায়। আর মানুষ সত্যের উপর কায়িম থেকে অবশেষে সিদ্দীক-এর দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহামিথ্যাচারী প্রতিপন্ন হয়ে যায়।'[বুখারী] কখনো মিথ্যা বলবে না, এমনকি রসিকতা করেও।
আপনার পিতামাতা এবং সন্তানদের সাথে ভাল ব্যবহার করুন। ইবনে ওমর (রা:) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাদেরকে ‘দায়িত্বশীল’ (আল-আবরার) বলেছেন কারণ তারা তাদের পিতামাতা ও সন্তানদের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ (বির্)। আপনার যেমন আপনার পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে সন্তানের প্রতিও।’
কাজেই পিতা-মাতার কাছে একজন ভালো সন্তান এবং সন্তানের কাছে ভালো পিতা-মাতা হওয়ার চেষ্টা করুন।
তাড়াহুড়ো করবেন না। আরাফাতের দিন রাসুল (ﷺ) তাঁর পিছনে প্রচন্ড হৈ চৈ এবং উটকে চাবুক মারার শুনতে পেলেন। তাই তিনি লোকদের ইশারা দিয়ে বললেন,
‘হে লোকসকল! তোমরা শান্ত হও, তাড়াহুড়ো করা ধার্মিকতার লক্ষণ নয়।'[আল-বুখারী]
আপনার দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপগুলি বিনম্রতার সাথে করার চেষ্টা করুন, উদাহরণস্বরূপ, রাস্তায় জোরে জোরে হাঁটবেন না এবং তাড়াহুড়ো করবেন না, যাতে আপনি অন্যদের অসুবিধার কারণ হন!
আল-বার্ এর কাছে প্রার্থনা করুন আপনাকে আল-বির্ এর পথে পরিচালিত করার জন্য। ভ্রমণের সময় আল-বির্ এর কাছে এই দু’আটি করা সুন্নত। প্রতিবার ভ্রমণের সময় এই দু’আটি করতে ভুলবেন না!
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِي سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى اللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاطْوِ لَنَا بُعْدَهُ اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ وَالْخَلِيفَةُ فِي الْأَهْلِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوءِ الْمُنْقَلَبِ فِي الْمَالِ وَالْأَهْلِ
মোটামুটি উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফরিনা হা-জাল বিররা ওয়াত তাকওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা তার-দা আল্লাহুম্মা হাউয়িন আলাইনা সাফারনা হা-যা, ওয়াতওই আন্না বু’দাহু, আল্লাহুম্মা আনতাস্-সাহিবু ফিস্-সাফার, ওয়াল খালিফাতু ফিল আহলি ওয়াল মাল। আল্লাহুম্মা ইন্না নাউজুবিকা মিন ওয়া-সা-ইস সাফারি ওয়া-কাআবাতিল মানজারি, ওয়া সুইল মুনকালাবি ফিল আহলি ওয়াল মাল।’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের এ সফর সহজ করে দাও। রাস্তার দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সফরের সঙ্গী এবং আমাদের পরিবারের কাছে তুমি আমাদের স্থলাভিষিক্ত। হে আল্লাহ! তোমার কাছে সফরের কষ্ট-ক্লান্তি ও ভয়ানক দৃশ্য দেখা থেকে এবং পরিবার, সম্পদ-বিত্ত ও অধীনস্তদের কাছে খারাপ অবস্থায় ফেরত আসা থেকে তোমার কাছে রক্ষা চাই। (মুসলিম, হাদিস : ৯৭৮/২)
হে আল্লাহ, আল-বার্, আমরা জানি যে আপনিই সব ভালোর উৎস। আমাদেরকে আবরার এর (ধার্মিক ব্যক্তিদের) বৈশিষ্ট্য দ্বারা সজ্জিত করুন, আমাদেরকে সদাচরণ দ্বারা পরিচালিত করুন, এবং আমাদের ন্যায়পরায়নাতাকে আপনার জান্নাতের পথে পরিচালিত করুন, আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
- [৫২:২৮] ↩︎