আসমাউল হুসনা – আল-বাতিন

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে আল-বাতিন — লুক্কায়িত, গোপন বিষয়ের জ্ঞাতা — বলেছেন একবার। আল-বাতিন সৃষ্টির উপলব্ধি থেকে আড়াল এবং আবৃত। তিনি এই জগতে অদৃশ্য, তথাপি তাঁর অস্তিত্ব তাঁর সৃষ্টির নিদর্শনগুলির মাধ্যমে স্পষ্ট, যার সমস্ত অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তিনি জানেন!

বাতিন এর মূল এসেছে ب-ط-ن থেকে এসেছে যা দুটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল লুকিয়ে থাকা এবং দ্বিতীয় অর্থ হল ভিতরে থাকা এবং প্রবেশ করা।

ভাষাগতভাবে, জাহির এবং বাতিন বিপরীতমুখী, জাহির বলতে বোঝায় যা প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান এবং বাতিন যা অভ্যন্তরীণ ও গোপন। আরবি ভাষায় بطن বলতে পেট বা গর্ভকে বোঝায়, যা মানুষের শরীরের ভিতরে লুকিয়ে থাকে।

আল্লাহর নিখুঁত গুণাবলীতে এই দুই বিপরীতের সমন্বয়, ‘আজ্জা ওয়া জাল — আয-জাহির এবং আল-বাতিন উভয়ই। তিনিই প্রকাশ্য, তাঁর মাধ্যমেই সব কিছু প্রকাশিত হয় এবং তাঁর নিদর্শনের মাধ্যমে আমরা তাঁকে জানি, তবুও আমরা তাঁকে এই জগতে ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি না।

আল-বাতিন নিজেই বলেছেন –

هُوَ ٱلۡأَوَّلُ وَٱلۡأٓخِرُ وَٱلظَّٰهِرُ وَٱلۡبَاطِنُۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَىۡءٍ عَلِيمٌ
তিনিই প্রথম ও শেষ এবং প্রকাশ্য ও গোপন; আর তিনি সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।[৫৭:৩]

মূসার (আ:) অনুরোধ:

وَلَمَّا جَآءَ مُوسَىٰ لِمِيقَٰتِنَا وَكَلَّمَهُۥ رَبُّهُۥ قَالَ رَبِّ أَرِنِىٓ أَنظُرۡ إِلَيۡكَۚ قَالَ لَن تَرَىٰنِى وَلَٰكِنِ ٱنظُرۡ إِلَى ٱلۡجَبَلِ فَإِنِ ٱسۡتَقَرَّ مَكَانَهُۥ فَسَوۡفَ تَرَىٰنِىۚ فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُۥ لِلۡجَبَلِ جَعَلَهُۥ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقًاۚ فَلَمَّآ أَفَاقَ قَالَ سُبۡحَٰنَكَ تُبۡتُ إِلَيۡكَ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ
আর যখন আমার নির্ধারিত সময়ে মূসা এসে গেল এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন। সে বলল, ‘হে আমার রব, আপনি আমাকে দেখা দিন, আমি আপনাকে দেখব।’ তিনি বললেন, তুমি আমাকে কখনো দেখবে না। বরং তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও, অতঃপর তা যদি নিজ স্থানে স্থির থাকে তবে তুমি অচিরেই আমাকে দেখবে। অতঃপর যখন তার রব পাহাড়ের উপর নূর প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ করে দিল এবং মূসা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তার হুঁশ আসল তখন সে বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আমি আপনার নিকট তাওবা করলাম এবং আমি মুমিনদের মধ্যে প্রথম।’[৭:১৪৩]

এই আয়াতে আমরা প্রমাণ পাই যে, আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জালকে এই পৃথিবীতে দেখা যায় না। আল্লাহ বলেন, যখন মুসা (আ:) তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলেছিলেন, তিনি তাঁকে দেখতে চেয়েছিলেন, আল্লাহ বললেন: لَن تَرَىٰنِى – লান তারানী- তুমি আমাকে দেখতে পারবেন না কখনও, لَن শব্দটি দিয়ে ‘কখনোই না’ ইঙ্গিত করা হচ্ছে। মুমিনদের জন্য আখেরাতের সবচেয়ে বড় নিয়ামত হবে যখন তারা আল্লাহকে দেখতে সক্ষম হবে।

وُجُوهٌ يَوۡمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ
সেদিন কতক মুখমন্ডল হবে হাস্যোজ্জ্বল।[৭৫:২২]
إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
তাদের রবের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপকারী।[৭৫:২৩]

আল্লাহ হলেন আল-বাতিন, তিনি মূসাকে (আ:) বলেছিলেন যে তার নশ্বর চোখ দিয়ে তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। আমরা লুক্কায়িত জিনিসগুলি আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি না এবং আমরা আমাদের খালি চোখে অত্যন্ত উজ্জ্বল চিত্রগুলিও দেখতে সক্ষম নই। যাইহোক, আমরা আমাদের চারপাশে তাঁর ক্রিয়াকলাপ এবং নিদর্শনগুলির মাধ্যমে মাধ্যমে আমাদের সামান্য জ্ঞান দিয়ে তাঁকে জানি।

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

আল-বাতিনের কাছে স্বস্তির সন্ধান করুন। যখনই আপনি একা বোধ করেন, ভীত হন, এবং কষ্ট পান – জেনে রাখুন আল্লাহ আপনার চিন্তা ও মানসিক অবস্থা সহ সমস্ত গোপন বিষয়ের জ্ঞাত। একমাত্র তিনিই আপনাকে সত্যিকার ভাবে জানেন, তাই তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন এবং আপনার দু’আয় তাঁর সাথে কথা বলুন, তাঁর কাছে সাহায্য চান এবং তাঁকে বলুন আপনাকে সংশোধন করতে। এই সত্যে সান্ত্বনা নিন যে তিনি অদৃশ্য হলেও তিনিই আপনাকে সবচেয়ে ভাল জানেন।

অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক – উভয় দিক থেকেই সৎ থাকুন। সূরা আল-হাদীদে আল্লাহ بَاطِنُهُۥ – বাতিনুহু শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যখন তিনি আখেরাতে মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে স্থাপিত দরজা সহ একটি দেওয়ালের কথা বলেছেন, যার ভিতরের অংশে রয়েছে ঈমানদারদের জন্য রহমত এবং জাহিরুহু অর্থাৎ এর বাহিরের অংশে রয়েছে আজাব।

...فَضُرِبَ بَيۡنَهُم بِسُورٍ لَّهُۥ بَابٌۢ بَاطِنُهُۥ فِيهِ ٱلرَّحۡمَةُ وَظَٰهِرُهُۥ مِن قِبَلِهِ ٱلۡعَذَابُ
তারপর তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর স্থাপন করে দেয়া হবে, যাতে একটি দরজা থাকবে। তার ভিতরভাগে থাকবে রহমত এবং তার বহির্ভাগে থাকবে আযাব।[৫৭:১৩]
يُنَادُونَهُمۡ أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡۖ
মুনাফিকরা মুমিনদেরকে ডেকে বলবে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?[৫৭:১৪]

এই মানুষগুলো কিভাবে আটকা পড়ে গেল? তাদের অপরাধ কি ছিল?

...قَالُواْ بَلَىٰ وَلَٰكِنَّكُمۡ فَتَنتُمۡ أَنفُسَكُمۡ وَتَرَبَّصۡتُمۡ وَٱرۡتَبۡتُمۡ وَغَرَّتۡكُمُ ٱلۡأَمَانِىُّ حَتَّىٰ جَآءَ أَمۡرُ ٱللَّهِ وَغَرَّكُم بِٱللَّهِ ٱلۡغَرُورُ
....তারা বলবে ‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমরা নিজেরাই নিজদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছ। আর তোমরা অপেক্ষা করেছিলে এবং সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং আকাঙ্ক্ষা তোমাদেরকে প্রতারিত করেছিল, অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ এসে গেল। আর মহা প্রতারক তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছিল। [৫৭:১৪]

বস্তুত এই লোকগুলো ঈমানদারদের সাথে থাকার ভান করেছিল এবং তাদের সাথে প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু তারা নিজেদেরকে সব ধরণের প্রলোভনে লিপ্ত রেখেছিল। আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে তারা সন্দিহান ছিল এবং মৃত্যু তাদের কাছে না আসা পর্যন্ত তারা তাদের পাপগুলিকে সহজ মনে করেছিল। এভাবেই শয়তান তাদের ধোঁকা দিয়েছে। এখানে মর্মার্থ এই যে, মুমিনরা মুনাফিকদের জবাব দেবে এই বলে, “তোমরা স্ব-শরীরে আমাদের সাথে ছিলে ঠিকই, কিন্তু তোমরা ছিলে হৃদয়হীন ও নিয়ত-বর্জিত, তোমরা ছিলে সন্দেহের বেড়াজালে আবদ্ধ, তোমাদের প্রার্থনা ছিল লোক দেখানো এবং তোমরা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করছিলে। [তাফসীরে ইবনে কাসির]

এই আয়াত থেকে শিক্ষা নিন, এবং যে কোন কাজের পিছনে আপনার নিয়ত কি তা খেয়াল করে দেখুন। লোক দেখানো কাজ থেকে সাবধান থাকুন এবং কথায় ও কাজে আল্লাহকে স্মরণ করুন, তাহলে আপনি জান্নাতে দেয়ালের ডান পাশের লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন!

* আল-বাতিনকে তাঁর নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে স্মরণ করুন। যদিও আপনি আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’কে আপনার ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে পারেন না, তবুও আপনি তাঁকে স্মরণ করতে পারেন এবং আপনার চারপাশে তাঁর সৃষ্টির প্রতি অবলোকন করে তাঁর প্রতি আপনার ভালবাসা বৃদ্ধি করতে পারেন। জরীর ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘একদা আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি রাতে (পূর্ণিমার) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঐ চাঁদকে তোমরা যেমন দেখছ, ঠিক তেমনি অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে সেদিন তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না।’ [আল-বুখারী, মুসলিম] পরের বার আপনি যখন পূর্ণিমা দেখবেন, মনের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করুন যে একদিন আপনি আল-বাতিনকে দেখতে সক্ষম হবেন ইন শা আল্লাহ। এভাবে তাঁর সৃষ্টির প্রতি অবলোকন করে নিজের ঈমান বৃদ্ধি করুন।

আপনার পাপ গোপন রাখুন। রাসুল (ﷺ) বলেছেন,
‘আমার সব উম্মতের গুনাহ মাফ হবে, কিন্তু দোষ-ত্রুটি প্রকাশকারীর গুনাহ মাফ হবে না। দোষ-ত্রুটি এভাবে প্রকাশ করা হয় : কোনো ব্যক্তি রাতের বেলা কোনো কাজ করবে। অতঃপর সকাল হবে মহান আল্লাহ তার এ কাজ গোপন রাখবেন। সে (সকালবেলা) বলবে, হে অমুক! আমি গত রাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে রাতযাপন করেছিল এমন অবস্থায় যে মহান আল্লাহ তার কাজগুলো গোপন রেখেছিলেন আর সকালবেলা আল্লাহর এই আড়ালকে সে সরিয়ে দিল। [আল-বুখারী, মুসলিম]

আপনার বন্ধুদের কাছে আপনার খারাপ কাজগুলি নিয়ে কখনই গর্ব করবেন না, বা অন্যদের খারাপ কাজগুলি প্রকাশ করার চেষ্টা করবেন না যারা প্রকাশ্যে পাপ করেনি এবং সেগুলি গোপন করার চেষ্টা করেছে!

হে আল্লাহ, আল-বাতিন, আমরা জানি যে, আপনি লুক্বায়িত এবং সব গোপন বিষয়ে পরিজ্ঞাত। আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করুন, আমাদেরকে কপটতা থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে আপনার সন্তুষ্টি পথে পরিচালিত করুন। আপনি আমাদের চারপাশে যে নিদর্শনগুলি দিয়েছেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে আমাদের সহায়তা করুন। আমাদের পাপগুলি গোপন করুন এবং আমাদেরকে নিজেদের এবং অন্যদের পাপ প্রকাশ করা থেকে আমাদের রাখুন। আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা প্রতিদিন আপনাকে জান্নাতে দেখতে পাবে, আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আল-বাতিন

আসমাউল হুসনা

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version