আসমাউল হুসনা – আল-বাক্বী

আল-বাক্বী (الباقي)
অর্থঃ চিরস্থায়ী, অবিনশ্বর
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা হলেন আল-বাকী – চিরস্থায়ী। তিনি সবসময় আছেন এবং থাকবেন। তিনি সেই সত্ত্বা যার অস্তিত্বের কোন শুরু বা শেষ নেই। এই নামের গুণটি আল্লাহকে চিরস্থায়ী, অন্তহীন, এবং অবিনশ্বর হিসাবে বর্ণনা করে। তিনি চিরকাল থাকবেন এবং সময়ের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না।

বাক্বী এসেছে ب-ق-ي এর মূল থেকে যার প্রধান অর্থ হলো টিকে থাকা, স্থায়ী হওয়া, থেকে যাওয়া, চিরস্থায়ী, অবিরাম এবং অবিচ্ছিন্ন হওয়া। এই মূলটি পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন রূপে এসেছে। কয়েকটি উদাহরণ হল – بَقِىَ- বকেয়া বা অবশিষ্ট আছে, أَبۡقَىٰ- অবশিষ্ট, وَيَبۡقَىٰ – এবং অবশিষ্ট থাকবেন, بَاقٍ – স্থায়ী, ইত্যাদি।

আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে ৮১টি কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, বাকি ১৮টি নামের ব্যাপারে সব আলেমরা একমত হতে পারেননি। আল-বাক্বী সেই নামগুলির মধ্যে একটি।

ইবনে উসাইমিন, ইবনে হাযম এবং ইবনে হাজার প্রমুখ আলেমরা আসমাউল হুসনার তালিকায় এই নামটি রাখেননি। যাইহোক, ইবনে আরাবী, ইমাম আল-বায়হাকী এবং আল-গাজালী তাদের তালিকায় এই নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

আল্লাহর নাম আল-আউয়াল অর্থ প্রথম, এবং আল-আখির অর্থ শেষ। আর আল-বাক্বী অর্থ চিরন্তন যা উপরোক্ত দুই নামকেই প্রতিফলিত করে।

সময়ের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক আসলে কেমন? সময় আল্লাহর সৃষ্টি, এবং এ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি অপরিবর্তনীয়।
ইমাম গাজ্জালি উল্লেখ করেছেন,
“শুধুমাত্র পরিবর্তনশীল জিনিসগুলিই অতীত বা ভবিষ্যতে সংগঠিত হয়, কারণ অতীত বা ভবিষ্যত হল সাময়িক অভিব্যক্তি।”
তবে পদার্থবিদ্যার একই নিয়ম অনুসারে আল্লাহ তা’আলাকে উপলব্ধি করা যাবে না, এই নিয়ম স্রষ্টার জন্য নয়, কেবলমাত্র তাঁর সৃষ্টির জন্যই প্রযোজ্য। তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রকৃতিকে অতিক্রম করেন এবং এর দ্বারা তিনি সীমাবদ্ধ নন। আমরা আমাদের সামান্য জ্ঞান দিয়ে তা বুঝতে অক্ষম, কারণ আমাদের জ্ঞানও তাঁর প্রকৃতির নিয়মে সীমাবদ্ধ।

ইমাম গাজ্জালী আরো বলেন
“আল্লাহ সেই সত্ত্বা যার অস্তিত্ব তাঁর নিজের মধ্যেই বিদ্যমান।”
আল্লাহর অস্তিত্ব অবিসম্ভাবি এবং তা চিরন্তন। তাঁর কারণে আমরা সবাই আজ এখানে। তাঁর অনুমতিতেই আমরা অস্তিত্বে এসেছি, তিনিই আমাদের ভরণ পোষণ অব্যাহত রেখেছেন।

مَا عِندَكُمۡ يَنفَدُۖ وَمَا عِندَ ٱللَّهِ بَاقٍۗ وَلَنَجۡزِيَنَّ ٱلَّذِينَ صَبَرُوٓاْ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ
তোমাদের নিকট যা আছে তা ফুরিয়ে যায়। আর আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। আর যারা সবর করেছে, তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।1
كُلُّ مَنۡ عَلَيۡهَا فَانٍ
যমীনের উপর যা কিছু রয়েছে, সবই ধ্বংসশীল।2
وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ
আর থেকে যাবে শুধু মহামহিম ও মহানুভব তোমার রবের চেহারা।3

চেহারা বলতে কোন কোন তাফসীরকার আল্লাহর সত্তাকে বুঝিয়েছেন।
মুসার (আ:) কাহিনীতে যাদুকররা এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিল। আল্লাহ প্রদত্ত মুসার (আ:) মুজেজাকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য ফেরাউন শহরের সেরা জাদুকরদের একত্র করেছিল। তারা তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল –

قَالُواْ يَٰمُوسَىٰٓ إِمَّآ أَن تُلۡقِىَ وَإِمَّآ أَن نَّكُونَ نَحۡنُ ٱلۡمُلۡقِينَ
তারা বলল, ‘হে মূসা, হয় তুমি নিক্ষেপ করবে, নয়তো আমরাই নিক্ষেপ করব।’4

জাদুকররা তাদের দুর্দান্ত জাদু দেখিয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালা মুসাকে (আ:) অভয় দিয়েছিলেন।

وَأَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ أَنۡ أَلۡقِ عَصَاكَۖ فَإِذَا هِىَ تَلۡقَفُ مَا يَأۡفِكُونَ
আর আমি মূসার প্রতি ওহী পাঠালাম যে, ‘তুমি তোমার লাঠি ছেড়ে দাও’ তৎক্ষণাৎ সে গিলতে লাগল সেগুলিকে যে অলীক বস্তু তারা বানিয়েছিল।5
فَوَقَعَ ٱلۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ
ফলে সত্য প্রকাশ হয়ে গেল এবং তারা যা কিছু করছিল তা বাতিল হয়ে গেল6
فَغُلِبُواْ هُنَالِكَ وَٱنقَلَبُواْ صَٰغِرِينَ
তাই সেখানে তারা পরাজিত হল এবং লাঞ্ছিত হয়ে গেল।7

ফেরাউনকে হতভম্ব করে দিয়ে জাদুকররা প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে ঈমান আনে। ক্রোধে উন্মত্ত ফেরাউন বলতে থাকে নিশ্চয়ই মুসার (আ:) সাথে জাদুকরদের কোন আঁতাত হয়েছে, যার কারণে তারা ভোল পাল্টে ফেলেছে। ফেরাউন জাদুকরদেরকে হত্যার হুমকি দেয়। কিন্তু তাদের ঈমান এতটাই মজবুত হয় যে এজন্য তারা নিজেদের জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করে না।

قَالُواْ لَن نُّؤۡثِرَكَ عَلَىٰ مَا جَآءَنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلَّذِى فَطَرَنَاۖ فَٱقۡضِ مَآ أَنتَ قَاضٍۖ إِنَّمَا تَقۡضِى هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَآ
তারা বলল, ‘আমাদের নিকট যে সকল স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার উপর আমরা তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দেব না। সুতরাং তুমি যা ফয়সালা করতে চাও, তাই করো। তুমিতো কেবল এ দুনিয়ার জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার’।8
إِنَّآ ءَامَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغۡفِرَ لَنَا خَطَٰيَٰنَا وَمَآ أَكۡرَهۡتَنَا عَلَيۡهِ مِنَ ٱلسِّحۡرِۗ وَٱللَّهُ خَيۡرٌ وَأَبۡقَىٰٓ
নিশ্চয় আমরা আমাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের অপরাধসমূহ এবং যে যাদু তুমি আমাদেরকে করতে বাধ্য করেছ, তা ক্ষমা করে দেন। আর আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী’।9

জাদুবিদ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বলেই জাদুকররা বুঝতে পেরেছিল মুসার (আ:) এই কারিগরি কোন জাদু নয় অর্থাৎ দৃষ্টির কোন কারসাজি নয়, এটা অতিপ্রাকৃত কিছু। তারা আল্লাহর সত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলেই প্রাণ হারাবে জেনেও ঈমান এনেছিল, এবং আল্লাহর অস্তিত্বে আস্থাশীল ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল আল্লাহর পুরস্কারের তুলনায় ফেরাউনের প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল নিছক ক্ষণস্থায়ী এবং নিরর্থক, আর আল্লাহর শাস্তিও ফেরাউনের শাস্তি থেকে দীর্ঘস্থায়ী।

وَمَآ أُوتِيتُم مِّن شَىۡءٍ فَمَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتُهَاۚ وَمَا عِندَ ٱللَّهِ خَيۡرٌ وَأَبۡقَىٰٓۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ
আর তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা দুনিয়ার জীবনের ভোগ ও সৌন্দর্য মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা আছে তাই উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি বুঝবে না?10

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ্ বলেন,
আদম সন্তানরা আমাকে কষ্ট দেয়। তারা যামানাকে গালি দেয়; অথচ আমিই যামানা। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা; রাত ও দিন আমিই পরিবর্তন করি।11

এই হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিষেধ করেছেন আমরা যেন যামানা অর্থাৎ সময়কে গালি না দেই। এখানে সময় বলতে কি বোঝানো হয়েছে?
সময় হল বাস্তবতা, বর্তমান ঘটনার উন্মোচন। যা কিছু ঘটে সবই আল্লাহরর ঐশী হুকুমেই ঘটে থাকে। তাই সময়কে গালি দেওয়া মানে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, তাই আমাদের উচিত তা পরিহার করা। আপাতত দৃষ্টিতে আমাদের অপছন্দনীয় কিছু ঘটলে তার জন্য মৌখিকভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করার কোন মানেই হয় না। মনকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলহামদুলিল্লাহ বলার দিকে পরিচালিত করতে হবে, এবং পরবর্তী সেরা পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে হবে। আহাজারি করে খামোখা দুইবার কষ্ট পেয়ে কি লাভ?

আল্লাহর এই নামটি কি নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীতে আমাদের জীবনটা সসীম, এবং একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালাই অসীম এবং চিরন্তন। তবে এই সংক্ষিপ্ত সফরে অনন্ত জীবন লাভের একটি উপায় আছে। এই পৃথিবীর সাথে নিজের জীবনকে খুব বেশি সম্পৃক্ত না করে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে পরকালের জন্য। তাৎক্ষণিক সুবিধা এবং ভোগের আশা না করে এই পৃথিবীতে আমাদেরকে কাজ করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের দেহগুলো ধূলিকণায় পরিণত হবে, কেবল থেকে যাবে আমাদের আমল। আর এই উদ্দেশ্যটাই আল-বাক্বী নামের ব্যাখ্যায় অনুরণিত হয়। এখনই তো সময় পরিবর্তনের! তাই আসুন, ধ্বংসাত্মক এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অবসান ঘটিয়ে যা কিছু ভালো, যা কিছু ন্যায়সঙ্গত তার প্রচার এবং প্রসার ঘটাই কেবল আল-বাক্বীর সন্তুষ্টির জন্য।

হে আল্লাহ, আল-বাক্বী, আমরা জানি যে আপনিই অবিনশ্বর এবং চিরন্তন । জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে যেন আপনার উপর নির্ভর করতে পারি — আমাদের আশীর্বাদ করুন। আমাদেরকে আপনার পরিপূর্ণতা এবং নিখুঁত গুণাবলী সমূহ উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন, এবং এই উপলব্ধিকে সম্বল করে আমাদের পথচলার নির্দেশনা দিন। আমাদের জীবনকে কল্যাণের উৎস করুন এবং আমাদের জীবনের একটি সুন্দর সমাপ্তি দিন, আমাদেরকে আপনার দিকে ফিরে আসতে অনুপ্রাণিত করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে আমাদের অনন্ত জীবন দান করুন, আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আল-বাক্বী

আসমাউল হুসনা

  1. সূরা আন-নাহাল-১৬: আয়াত-৯৬ ↩︎
  2. সূরা আর-রহমান-৫৫: আয়াত-২৬ ↩︎
  3. সূরা আর-রহমান-৫৫: আয়াত-২৭ ↩︎
  4. সূরা আল-আরাফ আয়াত-১১৫ ↩︎
  5. সূরা আল-আরাফ আয়াত-১১৭ ↩︎
  6. সূরা আল-আরাফ আয়াত-১১৮ ↩︎
  7. সূরা আল-আরাফ আয়াত-১১৯ ↩︎
  8. সূরা ত্বহা-২০: আয়াত-৭২ ↩︎
  9. সূরা ত্বহা-২০: আয়াত-৭৩ ↩︎
  10. সূরা আল ক্বসাস-২৮: আয়াত-৬০ ↩︎
  11. সহিহ বুখারী:৪৮২৬ ↩︎

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version