আসমাউল হুসনা – আল-আখির
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে আল-আখির — শেষ — বলেছেন একবার। আল-আখির হলেন তিনি, যার শুরু বা শেষ নেই। তাঁর ঊর্ধ্বে কিছু নেই; তিনিই পরম এবং তিনি সমগ্র সৃষ্টি চলে যাওয়ার পরও থাকবেন!
আখির শব্দটি এসেছে ء-خ-ر এর মূল থেকে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল পরবর্তী হওয়া এবং পিছিয়ে রাখা, দ্বিতীয়টি স্থগিত করা বা শেষে রাখা এবং তৃতীয় অর্থ হল চূড়ান্ত, শেষ এবং পরম।
এই মূলটি কুরআনে ২৫০ বার ছয়টি উদ্ভূত রূপে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল ٱلۡأٓخِرَةُ – আল-আখিরাতু (“পরকাল”), ٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِر – ইয়াওমিল-আখিরি (“শেষ দিন”), يَسْتَكْبِرُوْنَ – ইয়াস্তাখিরুনা (“তারা পিছনে থাকে”), أُخْرَىٰ – উখরা (“অন্য”) এবং ءَاخَرِينَ – আখারিনা (” অন্যরা”)।
আল-আখির হলেন তিনি যিনি প্রথম ছাড়াই শেষ, তিনি যে কোনো বর্ণনার ঊর্ধ্বে। আল-আখির যৌক্তিকভাবে আমাদেরকে প্রথম দিকনির্দেশনা দেন এবং যাদেরকে তিনি পথনির্দেশনা দেন তাদের দেখাশোনা করার জন্য তিনিই সর্বশেষ। তিনিই সর্বশেষ থাকবেন, তাঁর সত্ত্বায় বা গুণাবলীতে তুলনীয় কেউ বা কিছুই হতে পারে না!
আল-আখির নিজেই বলেছেন –
هُوَ ٱلۡأَوَّلُ وَٱلۡأٓخِرُ وَٱلظَّٰهِرُ وَٱلۡبَاطِنُۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَىۡءٍ عَلِيمٌ
তিনিই প্রথম ও শেষ এবং প্রকাশ্য ও গোপন; আর তিনি সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।
[৫৭:৩]
কি অবশিষ্ট থাকবে?
সূরা আর-রহমান এর সুন্দর আয়াতে আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়াজল বলেছেন –
كُلُّ مَنۡ عَلَيۡهَا فَانٍ
যমীনের উপর যা কিছু রয়েছে, সবই ধ্বংসশীল।
[৫৫:২৬]
وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ
আর থেকে যাবে শুধু মহামহিম ও মহানুভব তোমার রবের চেহারা।
[৫৫:২৬]
পৃথিবীর সকল অধিবাসী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং মৃত্যুবরণ করবে, এমনকি আসমানের অধিবাসীরাও কেবলমাত্র আল্লাহ যাদের চান তারা ব্যতীত। তাহলে কি থাকবে?
শুধুমাত্র আল্লাহর সম্মানিত মুখ, কারণ আমাদের পালনকর্তা, মহিমান্বিত, বরকতময়, চিরঞ্জীব যিনি কখনও মৃত্যুবরণ করেন না।
আশ-শাবি বলেছেন, যখন আপনি পাঠ করবেন – কুল্লু মান আলাইহা ফাআন (যা কিছু পৃথিবীতে আছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে) থেমে যাবেন না, পড়তে থাকুন: ওয়া ইয়াবকা ওয়াজহু রাব্বুকা যুল জালালি ওয়াল ইকরাম (কেবল তোমার প্রভু, যিনি মহিমা এবং সম্মানের অধিকারী, তিনিই চিরকাল স্থায়ী হবেন)। [তাফসীরে ইবনে কাছীর]
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা যেন আপনাকে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত পছন্দ করে, আল্লাহ তার সাথে সাক্ষাত পছন্দ করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে অপছন্দ করে, আল্লাহ তার সাথে সাক্ষাত করতে অপছন্দ করেন।’ [তিরমিযী] যখন আপনি মারা যাবেন তখন আপনাকে জান্নাতে বা জাহান্নামে আপনার চূড়ান্ত গন্তব্যের একটি আভাস দেখানো হবে, এটাই আল্লাহর সাথে আপনার সাক্ষাতের প্রতি ভালবাসা বা অপছন্দের কারণ হবে।
প্রতিদিন আল্লাহর সাথে আপনার সাক্ষাত এবং তাঁর সামনে আপনার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা করুন এবং এটি আপনাকে ভাল কাজ করতে, আপনার আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে, এবং আপনাকে আল্লাহ আল-আখিরের সাথে সাক্ষাতের ভালবাসায় ধন্য হতে অনুপ্রাণিত করবে। যে আল্লাহকে প্রথমে রাখে সে কখনই শেষ হতে পারে না!
প্রতিনিয়ত দান করুন। আপনি যখন মারা যাবেন তখন আর কোন নেক আমল করতে পারবেন না, এবং তিন ধরনের আমল ছাড়া আর কোন কাজের প্রতিদান পাবেন না, আর এগুলোর পুরস্কার হবে দীর্ঘস্থায়ী!
রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন মানুষ মারা যায় তখন তিনটি আমল ছাড়া তার আমল সব বন্ধ হয়ে যায়: সাদাকাহ জারিয়াহ (অবিরাম দান)। উপকারী জ্ঞান, এবং সৎকর্মশীল বংশধর যে তার (মৃতের) জন্য প্রার্থনা করে। [মুসলিম]
তাই পড়াশোনা করুন এবং সাদাকাহ জারিয়াহ চালিয়ে যান: যেমন একটি গাছ লাগাতে পারেন, কোন মসজিদ নির্মাণে সহায়তা করতে পারেন, অথবা যে কোন দাতব্য কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ইসলামী জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে অংশগ্রহণ করুন, যেমন একটি ইসলামী বই ছাপাতে সাহায্য করতে পারেন, জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনার নিজস্ব লিফলেট ছাপাতে পারেন; নিজের জ্ঞান অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। কোন প্রকল্পই খুব ছোট নয়! আপনার সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকেই আপনার জন্য দু’আ করতে শেখান!
নিজেকে বিচার দিবসের কথা স্মরণ করিয়ে দিন। আপনার প্রতিটি কাজের জন্য সেদিন হিসাব দিতে হবে, তা যত তুচ্ছই হোক না কেন। কাজেই এমন কোন দিন যাতে অতিবাহিত না হয় যেদিন আপনি সেই দিনের কথা স্মরণ করবেন না। মৃত্যু এবং বিচার দিবসের স্মরণ যেন আপনাকে বিনীত করে।
নবীজি (ﷺ) যখন বিছানায় শুতেন, তখন তিনি তার ডান হাত ডান গালের নিচে রেখে বলতেন:
اَللَّهُمَّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ক্বিনি আজাবাকা ইয়াওমা তাবআসু ইবাদাকা।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! সেই দিনের আজাব থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দাও, যেদিন তুমি তোমার বান্দাদের পুনরুত্থান ঘটাবে।’ [তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ, রিয়াদুস সালেহিন]
এই দু’আটি মুখস্থ করুন এবং এটি আপনার বিছানার পাশে একটি নোটে লিখে রাখুন, যাতে আপনি ইন শা আল্লাহ ঘুমানোর আগে দু’আটি পড়তে না ভুলেন!
নীরবতাকে মূল্যায়ন করুন এবং প্রতিবেশী ও অতিথিদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন। আল-আখির এবং শেষ বিচার দিবসের প্রতি আপনার বিশ্বাসের সাথে কুরআন ও সুন্নতে নির্দিষ্ট কিছু ভালো কাজের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আপনার দৈনন্দিন জীবনে এই কাজগুলো সম্পাদন করার চেষ্টা করুন!
রাসুল (ﷺ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন সৎ কথা বলে অথবা চুপ থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের প্রতি উদার হয়।’ [মুসলিম]
আপনার জীবনের ভাল পরিসমাপ্তির জন্য আল-আখিরের কাছে প্রার্থনা করুন। কিছু মানুষ তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কুফরী করে। আল্লাহ যেন আমাদেরকে কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করা থেকে রক্ষা করেন! কিছু জীবন ভয়ঙ্কর, অসম্মানজনক ভাবে শেষ হয়, যেমন অনেক সময় অল্পবয়সী মুসলিমরা মাতাল অবস্থায় দ্রুত গাড়ি চালানোর জন্য দুর্ঘটনায় মারা যায়। আবার অনেক সময় মৃত্যুর ফেরেশতারা বিশ্বাসীদের জীবন কবজ করে বড় পাপে লিপ্ত থাকা অবস্থায়। আল-আখিরের কাছে প্রার্থনা করুন আপনার জীবনের শেষ কাজটি যেন হয় সেরা কাজ, এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের দিনটিই যেন হয় সর্বোত্তম দিন। আপনার নিজের জীবন, কাজ এবং মৃত্যু সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করুন এবং এই দু’আটি পড়ুন –
اللهم إني أسألك حسن الخاتمة
উচ্চারণ:-আল্লহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুসনাল খতিমাহ।
অর্থ:-হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উত্তম মৃত্যু চাই!
হে আল্লাহ আমরা জানি যে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও আপনিই শেষ যিনি থাকবেন। আমরা যেন সাগ্রহে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি সেজন্য আমাদের আর্শিবাদ করুন। আমাদের স্মরণ করিয়ে দিন যে বিচার দিবসে প্রতিটি কাজের জন্য আমাদেরকে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে হিসাব দিতে হবে। সেই বিশেষ দিনের কথা স্মরণ করে আমরা যেন এই পৃথিবীতে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হই। আমাদেরকে এমন কাজ করতে সক্ষম করুন যার প্রতিদান অব্যাহত থাকবে, এমনকি মৃত্যুর পরও। আমাদের জীবনের সুন্দর পরিসমাপ্তি দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।