মুসল্লী : হুযুর, আপনি জুমাপূর্ব বয়ানে আরাফার দিন রোযা রাখতে বলেছেন। সেদিনের রোযা দ্বারা পূর্বের ও পরের দুই বছরের গোনাহ ক্ষমা করা হোক, আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) সেটা আল্লাহর কাছে মঞ্জুর করেছেন, সেটাও আপনি বলেছেন। আসলে আরাফার দিনের রোযা আমরা কবে রাখবো?
ইমাম : কেন, ৯জিলহজ শনিবার। বলেছি না?
মুসল্লী : জি বলেছেন। কিন্তু ৯ যিলহজ তো ‘ইয়াওমে আরাফা’ নয়। এ বছর হাজী সাহেবরা শুক্রবার দিন আরাফায় জমায়েত হবেন!
ইমাম : তো কী হয়েছে?
না মানে, যেদিন ‘ওকূফে আরাফা’, সেদিনই তো ‘ইয়াওমে আরাফা’; ব্যাপারটা এমন নয় কি?
হ্যাঁ, তাই? কিন্তু এতে কী হয়েছে? ইয়াওমে আরাফা কত তারিখে?
নবম তারিখে!
তা হলে তো ঠিকই আছে, ওরা নবম তারিখে উকুফ করবে, আমরা নবম তারিখে রোযা রাখবো!
তা হলে আরাফার দিন তো আমাদের রোযা রাখা হলো না। ওরা ওকুফ করবে শুক্রবারে, আমরা রোযা রাখবো শনিবারে।
সমস্যার কী হলো? বার ভিন্ন হলেও তারিখ তো অভিন্ন। নবম তারিখ। বিধান তারিখের সাথে সম্পৃক্ত, বারের সাথে নয়। আর তারিখ উদয়াচলের ব্যবধানে একেক দেশে একেকবারে হওয়া একটি স্বীকৃত বিষয়। এমনকি ইংরেজি তারিখের জন্য একটি আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা আছে; যার এপাশে এক তারিখ, ওপাশে আরেক তারিখ।
এটাকে কী একদিনে আনা যায় না?
না যায় না।
কেন?
অনেক সমস্যা আছে!
কী সমস্যা?
মনে করুন, আপনি ওদের সাথে মিল করতে গিয়ে যদি শুক্রবারে আরাফার রোযা রাখেন, আর আমাদের সাথে মিল করতে গিয়ে রবিবারে ঈদ করেন, তা হলে মধ্যখানের একদিনের গ্যাপকে কী করবেন? এটার কোনো অস্তিত্ব বা ভিত্তি কি ইসলামে আছে? মানে আরাফার দিন ও ঈদের দিনের মাধ্যখানে আরেকটি দিনের বিদ্যমানতা কি ইসলামে স্বীকৃত?
বলছিলাম এজন্য, আমাদের রোযা যেন আরাফার দিনের সাথে একত্রে হয়। নবীজি সা. ‘সওমে ইয়াওমে আরাফা’ বলেছেন। নিশ্চয় আরাফার সাথে এর সম্পৃক্ততা রয়েছে।
ও আচ্ছা! আপনি তা হলে ‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দ দেখে বিভ্রান্ত হয়েছেন। আপনি ভেবেছেন, হাজী সাহেবরা যেদিন আরাফার ময়দানে ওকুফ করবে, সেদিনই আমাদের রোযা হতে হবে। ব্যাপারটা এমন নয়। আসল কথা হলো, ‘ইয়াওমে আরাফা’ ৯ জিলহজের অপর নাম। এদিন হাজীয়ানে কেরাম আরাফায় ওকুফ করবে, অন্যেরা রোযা রাখবে। তারিখটাই এখানে মুখ্য, দিন হলো গৌন। তা মেলা জরুরি নয়।
আরাফা যখন বলা হয়েছে, তখন রোযাটাও তো তার সাথে মিলিয়ে হওয়ার দরকার নয় কি?
সে হিসাবে তো রোযাটাও তো হাজী সাহেবানই রাখা উচিত, কী বলেন?
বুঝিনি!
না মানে আরাফার ওকুফ কাদের জন্য?
হাজী সাহেবদের জন্য!
তা হলে রোযাও কি হাজী সাহেবরাই রাখবে?
না! কেন?
ওই যে হাদীসে আরাফার উল্লেখ আছে!
চিন্তা করতে হবে!
চিন্তা করার দরকার নেই! হাজী সাহেবান ওদিন রোযা রাখা নিষেধ। জানেন?
তাই নাকি?
-জ্বি! আসলে শব্দ দিয়ে সব নির্ণয় করা যায় না। তার হাকীকত ও উদ্দেশ্য বুঝতে হবে। কুরআন মাজীদে ‘খাইতে আবয়ায’ ও ‘খাইতে আসওয়াদ’ বলা হয়েছে। এর অর্থ ‘সাদা সুতা’ ও ‘কালো সুতা’। উদ্দেশ্য হলো ‘সুবহে সাদিক ও সুবহে কাযিব’। ইয়াওমে আরাফা মানে যিলহজের নবম তারিখ, সেটা যে বারেই হোক।
এ তারিখের নাম ইয়াওমে আরাফা করার বিশেষ হেকমত এ হতে পারে, এ তারিখে হাজী সাহেবান আরাফার ময়দানে একত্রিত হন এবং এটি এদিনকার সর্বশ্রেষ্ঠ আমল।
সুতরাং যেখানে আরাফা, সেখানে ওকুফ হবে । আর সেটা ওখানকার নবম তারিখ অনুযায়ী হবে। যেখানে আরাফার মাঠ নেই, সেখানকার লোকেরা নিজ দেশের তারিখ অনুযায়ী আমল করবে।
-জ্বি বুঝেছি।
আচ্ছা হুযুর, সবগুলোকে একত্র করা যায় না? মানে ঈদ রোযা কুরবানী সবকিছু?
-না, যায় না।
-কেন হুযুর!
একত্র করতে তো বলা হয়নি, তা হলে কেন একত্র করবো? বরং একত্র করতে গেলে নবীজির হুকুমের লঙ্ঘন হয়।
-কী বলেন?
-হাঁ, তাই! নবীজি সা. বলেছেন : صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ، وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ،
”রোযা রাখ চাঁদ দেখে, রোযা ছাড় চাঁদ দেখে।”
(সহীহ বুখারী : ১৯০৯)
মানে রোযা ও ঈদকে চন্দ্রনির্ভর করা হয়েছে। প্রত্যেককে তার স্থানীয় তারিখ অনুযায়ী তারিখ নির্ভর আমলগুলো আদায় করতে বলা হয়েছে।
আপনি যদি মক্কা-মদীনার তারিখ অনুযায়ী রোযা বা ঈদ করেন, আর আপনার এখানে তখনো সে নির্দিষ্ট তারিখ না এসে থাকে, তা হলে আপনি সময়ের পূর্বেই আমল করে ফেললেন। নির্দিষ্ট তারিখের আগে কি আমল করা যায়?
-না যায় না।
-আপনি সৌদীর দশম তারিখে কুরবানী করেন, অথচ বাংলাদেশে তখন নবম তারিখ; তা হলে আপনি সময়ের আগেই কুরবানী করে ফেললেন। আর সময়ের আগে কুরবানী করলে কুরবানী সহীহ হবে না। এমনকি ঈদের দিনও যদি কেউ ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করে, তার কুরবানী পুনরায় করতে হবে।
-আচ্ছা, আমরা এ ব্যাপারে ঐক্যমত হলেই তো হলো, কী বলেন? অর্থাৎ সবাই তারিখ নির্ধারণ ও ইবাদতউৎসব পালন এসব বিষয়ে একমত হলেই তো হলো!
-ভুল ঐক্যমতে কী লাভ! যার কোনো ভিত্তি নেই!
-কেমন?
এই ধরুন, সবাই একমত হলো, সৌদীর তারিখ অনুযায়ী রোযা রাখবে। সে হিসাবে ওদের তথ্য মতে আমরা রোযা শুরু করলাম। অথচ বাংলাদেশে চাঁদ দেখা যায়নি। তার মানে রমাযানের রোযা আপনি শাবান মাসেই আরম্ভ করে দিলেন। যখন রমাযানের চাঁদ দেখলেন, তখন আপনার একটি রোযা অলরেডি শেষ হয়ে গেছে। এর মানে আপনার আমলের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। বলুন এটার কোনো ভিত্তি আছে? এতে করে দুটি ক্ষতি
হলো। এক. নবীজি সা. হুকুম :
لَا تَقَدَّمُوا رَمَضَانَ بِصَوْمِ يَوْمٍ، وَلَا يَوْمَيْنِ.
“তোমরা একদিন বা দুদিন আগে রোযা রেখে রমাযানের আগে যেও না।” (সহীহ মুসলিম-১০৮২) - এ হাদীসের লঙ্ঘন করা হলো।
দ্বিতীয় বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্য তারিখ গোনলেন। আপনার তারিখ গোনার সাথে আপনার চাঁদের কোনো মিল নেই। আপনি এক তারিখ গোনলেন, অথচ তখনো চাঁদ ওঠেনি। এটা কি ঠিক হয়েছে?
-না, ঠিক হয়নি!
আসল ব্যাপারটি বুঝতে চেষ্টা করুন। আমাদের প্রতি হুকুম হলো স্থানীয় সময়ের রেয়াত করা এবং সে অনুযায়ী আমল ও ইবাদত সম্পন্ন করা। কোথাও মক্কামদীনার অনুসরণ করতে হবে, এমন কথা নেই। যেভাবে আমরা নামাযের ক্ষেত্রে স্থানীয় সময়ের প্রতি লক্ষ রাখি। মক্কার সময়ের নয়। এটা আমাদের ভালো করে মনে রাখতে হবে। আমরা যেমন মক্কার যোহরে আমাদের যোহর পড়ি না, তেমনি ওখানকার তারিখ অনুযায়ী রোযা ঈদ করবো না। এমন করতে গেলে আল্লাহ তাআলার ‘তাকবীন আওকাত’ তথা সময়ব্যবস্থাপনা মূল্যহীন হয়ে পড়ে এবং এর মধ্যে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জাহেলী আরবদের সময়শৃঙ্খলা নষ্ট করাকে আল্লাহ তাআলা কুফর বলেছেন। (সূরা তওবা ৩৭) আর চন্দ্রের বৃদ্ধি-হ্রাসকে ‘মাওয়াকীত’ তথা সময়নির্ধারণী বলে উল্লেখ করেছেন। (সূরা বাকারা : ১৮৯)
দ্বিতীয়ত, এটি ইসলামের ফিতরত তথা স্বভাবপ্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামে তাশরীই ও তাকবীন অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। দুনিয়ার যে প্রান্তেই মানুষ বসবাস করুক না কেন, তার কাছে ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, রেডিও, মোবাইল কিচ্ছু না থাকলেও সে সময় ও তারিখ বের করে ইবাদত করতে পারবে। কিন্তু আপনাদের এসব কথা সম্পূর্ণ যন্ত্র ও কৃত্রিমতা নির্ভর, যার ফলে করলে কোটি কোটি মানুষের পক্ষে যথা সময়ে আমল করা সম্ভব নয়।
-হুযুর, বিষয়গুলো এভাবে খেয়াল করিনি। এরপরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আপনি অনুমতি দিলে বলতাম।
-বলুন!
-আল্লাহ তাআলা সকলকে একতাবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ঠিক না?
-ও আচ্ছা! তা-ই বুঝি। তারিখ একত্র করলে বুঝি উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
ঐক্যবদ্ধতার অর্থ কি, জানেন? ঐক্যবদ্ধ থাকা মানে কুরআন সুন্নাহ মানার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকা। পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হওয়া। এর অর্থ এ নয় শরীয়ত লঙ্ঘন করে, দীনের নীতিমালা পদদলিত করে নিজেদের মন মতো একত্রিত হওয়া; যার সাথে দীনের কোনো মিল নেই। সারাবিশ্বে একই দিনে ইবাদত ও উৎসবগুলো পালন করতে গেলে কয়েকটি আয়াত ও হাদীসের স্পষ্ট লঙ্ঘন হয়, স্বীকৃত মূলনীতি ও বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হয়; তা কি লক্ষ করেননি? ইতিপূর্বে আমাদের আলাপচারিতায় যেটা স্পষ্ট করেছি।
যে ক্ষেত্রে একতাবদ্ধ ও মিলেমিশে থাকা শরীয়তের প্রত্যাশা, সেটার ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। পরস্পর ঝগড়াবিবাদ না করা, গালিগালাজ তোহমত না করা, মুসলিম ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ লালন করা প্রভৃতি ছিল ঐক্যবদ্ধতার প্রধান উপকরণ। কিন্তু আমরা তো লক্ষ করেছি, ইত্তিহাদের নামে সারাবিশ্বে একই দিনে ইবাদত ও উৎসব পালনের যারা দাওয়াত দেন, তারা প্রতিপক্ষের প্রতি সে সম্মান সৌহার্দ্য মোটেও বজায় রাখেন না। বরং বিভিন্ন কটুবাক্যে তাদের জর্জরিত করেন; যা ঐক্যের পথে প্রধান অন্তরায়…
-হুযুর, আজকে আসি। অনেক সময় হয়ে গেছে…
ঠিক আছে যেতে পারেন। তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন। সময় মেন্টিনের নাম ঐক্য নয়, বরং শরিয়ত মেন্টেইন ও পরস্পর মূলবোধ রক্ষা করাই হলো আসল ঐক্য। নিজেদের মন মতো চলার নাম দীন নয়, বরং মনকে দীনের অনুগত বানানোর নাম দীন!
জি হুযুর।
এ কথা বলেই মুসল্লীটি ইমামের কামরা থেকে বেরিয়ে গেল।