আমরা কেন জান্নাতে থাকলাম না

আরো একটি প্রশ্ন যা আমরা অনেকেই করি – কেন আদম (আ:) জান্নাতে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করলেন না, কেন আমাদেরকে পৃথিবীতে নেমে আসতে হলো? এর উত্তর কুরআনেই আছে –

وَقُلۡنَا يَٰٓئَادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ
আর আমি বললাম, ‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং তা থেকে আহার কর স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এই গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না, তাহলে তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
[সূরা বাকারা:৩৫]

দৃশ্যটা এরকম! আল্লাহ বলছেন জান্নাত তোমাদের, তোমরা যেভাবে ইচ্ছা বাঁচো, যেমন ইচ্ছা উপভোগ করো, কেবলমাত্র একটি জিনিস ছাড়া। এমন সময় কে এলো? শয়তান!

فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِۖ وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوٌّۖ وَلَكُمۡ فِى ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرٌّ وَمَتَٰعٌ إِلَىٰ حِينٍ
অতঃপর শয়তান তাদেরকে জান্নাত থেকে স্খলিত করল। এবং তারা যাতে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল, আর আমি বললাম, ‘তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। আর তোমাদের জন্য যমীনে রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আবাস ও ভোগ-উপকরণ’।
[সূরা বাকারা:৩৬]

অতঃপর শয়তান তাদেরকে প্রলুব্ধ করল। আল্লাহ তাদেরকে নিচে নেমে যেতে বললেন, এবং এও জানিয়ে দিলেন যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ হবে একে অপরের শত্রু, তারা এই পৃথিবীতে আবাসের জন্য জায়গা খুঁজে পাবে, এবং সেখানে তারা কিছুকাল উপভোগ করবে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।

এরপর আদম (আ:) অনুতপ্ত হলেন এবং এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তার তওবা কবুল করলেন।

فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَٰتٍ فَتَابَ عَلَيۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ
অতঃপর আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেল, ফলে আল্লাহ তার তাওবা কবূল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবূলকারী, অতি দয়ালু।
[সূরা বাকারা:৩৭]

আজকের প্রশ্নটি ছিল কেন তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী হলেন না?
এর উত্তর হল তারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিলেন। আল্লাহ কেন এই গল্পটি কুরআনে বলেছেন?
এখান থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই?

প্রথমত আল্লাহ যখন আমাকে কোন আদেশ দেন এটা তাঁর প্রজ্ঞা এবং হিকমত থেকে। তিনি যখন আমার জন্য কোন কিছু নিষেধ করেন, আমাকে বুঝতে হবে তা আমার জন্য ভালো নয়। আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে ওটা তো ছিল একটা গাছ মাত্র, কেন আল্লাহ এর থেকে তাদের খেতে নিষেধ করেছেন?
আদম (আ:) এবং হাওয়ার (আ:) এই গল্পের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি আছে, তবে এই ইচ্ছাশক্তি এবং পছন্দকে এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যা আল্লাহকে খুশি করে, অন্যথায় অন্যান্য বুদ্ধিহীন প্রাণীর সাথে আমাদের কোন পার্থক্য থাকবে না।

এই গল্পটিতে আপনার এবং আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো শয়তান কিভাবে কাজ করে। শয়তান যখন তাদের কাছে এলো, সে বলেনি যে তোমরা এই গাছের ফল খেওনা, খেলে তোমরা জান্নাত থেকে বিতাড়িত হবে, বা তোমরা আল্লাহর নাফরমানি করবে। এখানে ٱسۡكُنۡ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, আরবিতে এর মূল سكن যার অর্থ অস্থায়ীভাবে বসবাস করা, স্থায়ীভাবে নয়। এই পৃথিবীতে আল্লাহর আনুগত্য করার পর জান্নাতে আমরা চিরস্থায়ী হবো ইন শা আল্লাহ।

সেই সময় তাদের জন্য জান্নাতের আবাস ছিল সাময়িক। আদম (আ:) এবং হাওয়াকে (আ:) আল্লাহর অবাধ্য করার জন্য শয়তান যে কৌশলটি ব্যবহার করেছিল তা সুরা আরাফের অন্য একটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে –

...قَالَ مَا نَهٰکُمَا رَبُّکُمَا عَنۡ هٰذِهِ الشَّجَرَۃِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَا مَلَکَیۡنِ اَوۡ تَکُوۡنَا مِنَ الۡخٰلِدِیۡنَ
...সে বলল, ‘তোমাদের রব তোমাদেরকে কেবল এ জন্য এ গাছ থেকে নিষেধ করেছেন যে, (খেলে) তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা চিরস্থায়ীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’।
[সূরা আল-আরাফ: ২০]

মূলত শয়তান তাদেরকে বলেছিল যদি তোমরা জান্নাতে চিরকালের জন্য থাকতে চাও তবে এ গাছের ফল খাও। এভাবেই শয়তান আপনার এবং আমার উপর কাজ করে। সে আল্লাহর অবাধ্যতাকে এমন সুন্দরভাবে আপনার সামনে উপস্থাপন করে যে আপনার মনে হয় যেন আপনি তাঁর আনুগত্য করছেন।

এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আপনার এবং আমার জন্য এই গল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। শয়তান সবসময় আমাদেরকে ওয়াসওয়াসা দেয়। তাই, এখানে প্রথম পয়েন্টটি হল শয়তান যখন আপনাকে প্রলুব্ধ করে এবং আল্লাহর অবাধ্যতাকে আপনার কাছে শোভিত করে তুলে, তখন আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে।

দ্বিতীয় পয়েন্ট হল, জান্নাত আপনার এবং আমার জন্য চিরস্থায়ী হবে ইন শা আল্লাহ আমিন, আল্লাহর আনুগত্য করার পরে, এবং এর জন্য আমাদের নিজেদের পছন্দনীয় এবং উপভোগ্য জিনিসের বিরুদ্ধেও যেতে হবে।

তবে এখানে সবচেয়ে সুন্দর পয়েন্টটি হল, আদম (আ:) আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার পরেও আল্লাহ তার তওবা কবুল করেছিলেন। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার জন্য এটা আপনার এবং আমার জন্য একটা আশার বার্তা। আল্লাহর অবাধ্যতা করার সাথে সাথেই যদি আমরা তা স্বীকার করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাই আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন।

فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَٰتٍ فَتَابَ عَلَيۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ
অতঃপর আদম তার রবের পক্ষ থেকে কিছু বাণী পেল, ফলে আল্লাহ তার তাওবা কবূল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাওবা কবূলকারী, অতি দয়ালু।
[সূরা বাকারা:৩৭]

এই আয়াতটি আমাকে অনেক আশান্বিত করে। কাজেই আপনারা হতাশ হবেন না। আয়াতের শেষ অংশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন তিনি তওবা কবুলকারী, অতীব দয়ালু। এ কারণে আল্লাহ জান্নাতে আদম (আ:) এবং হাওয়াকে (আ:) অল্প কিছুদিনের জন্য স্থায়ী করেছিলেন। কুরআনের আরো অনেক জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে বলেছেন শয়তান কিভাবে মানুষের সাথে কৌশল অবলম্বনে করে।
কিন্তু তারপরও আশা হারালে চলবে না, প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি দিয়ে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। হয়তো কখনো কখনো আমরা ব্যর্থ হব, কিন্তু শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ যেন আমাদের জন্য সহজ করে দেন।

সিরিজ: কুরআনে সব আছে

মূল: ড: হাইফা ইউনিস

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version