তাছাড়া ইলম যার বেশি কিয়ামতে তার জবাবদিহিতা ও তত ভয়াবহ! অনেকেই ইলম অর্জন থেকে বিরত থাকার এমন হরেক রকমের অজুহাত দাঁড় করিয়ে দেয়; তারা বুঝাতে চায়, ইলম অর্জন কম করলে হয়ত বিচারও সহজ হয়ে যাবে।কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর যৌক্তিকতা কতটুকু?
যেকোন নফল ইবাদতের চেয়েও ইলম অর্জন হাজারগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইলম ছাড়া কেউ যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না সেটা দুনিয়াতে হোক কিংবা আখিরাতে!
একজন সতর্কবান পূরিপূর্ণ মুমিন ও একজন অসতর্কবান মুমিনের পার্থক্য হচ্ছে “জ্ঞানের পরিসীমা“। যার জ্ঞানের পরিসীমা যত বেশি আল্লাহর প্রতি তার নৈকট্যও তত বেশি। কেননা, একজন মুমিনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শয়তানকে কখনও দৈহিক শক্তিমত্তা জাহির করে পরাজিত করা সম্ভব নয়। দ্বীন সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের পরিধি বাড়লেই শয়তানকে হারানোর পথও সুগম হবে। মূলত, এজন্যই শয়তান চায় মানুষ দ্বীনের জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত থাকুক। কারণ এতে শয়তানেরই লাভ। অজ্ঞ ব্যক্তিকে যেকোনভাবেই শয়তানের পাতানো ফাঁদে আটকে ফেলা যায়।
আবার, দ্বীনের ইলমের চেয়ে যখন দুনিয়ার ইলমের গুরুত্ব বেড়ে যাবে তখন মানুষ নিজেকে ঈমানদার দাবি করা সত্ত্বেও দ্বীনের জ্ঞানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, যারা দ্বীন শিখে তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে খুঁজে বের করে অন্যের মাঝে প্রচার করে নিজেকে সমাজে উত্তম বলে জাহির করবে। দ্বীনী ইলম অর্জন ছাড়াই যারা দ্বীন চর্চা করে তাদের চেয়ে সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে। অনেকেই আবার আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসবে। এগুলো মূলত দ্বীনি ইলমের চেয়ে দুনিয়াবি ইলমকে অধিক প্রাধান্য দেয়ার সফল পরিণতি।আর এভাবেই শয়তান তাদেরকে নিয়ে খেলা করে।
দ্বীনি ইলম অর্জন থেকে মানুষকে বিরত রাখার পিছনে শয়তানের আরেকটি অন্যতম উদ্দেশ্য হল বিদআত! বিদআত সৃষ্টি হয় কোরআন-হাদিসের জ্ঞান অধ্যয়ন ব্যতীত কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার মাধ্যমে। ব্যক্তি কিংবা দলের প্রতি অতিরিক্ত আবেগ মানুষকে দ্বীন ইসলামের প্রতি অনিহা সৃষ্টি করে।ফলে সে নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা দলের পূজা করে দ্বীন দূরে ছুঁড়ে ফেলে তার প্রিয় ব্যক্তিকে মানদণ্ডের আসনে দাঁড় করিয়ে রাসূলের ওপরে স্হান দিয়ে বসে!
শয়তান তাদেরকে জালে আটকিয়ে সবচেয়ে বেশি মজা পায় যারা দ্বীনের জ্ঞান অধ্যয়ন করে না। সুফিয়ান সাওরী বলেন, “ইবলীসের নিকট পাপ অপেক্ষা বিদআত বেশি পছন্দনীয়। যেহেতু পাপ থেকে তওবা করা যায় কিন্তু বিদআত থেকে তওবা আশা করা যায় না।”
অর্থাৎ, মানুষ পাপ কাজ করলেও তার মনে একটা ভয় থাকে তাই তার ফিরে আসারও একটা আশা থাকে কিন্তু যে বিদআতের মত জঘন্য পাপকে ইবাদত মনে করে পালন করে সে “তওবা” করবেই বা কেন?ফলে,সে বিদআত এর ওপর অটল থেকেই মৃত্যুবরণ করে। এজন্যই শয়তানের কাছে মানুষকে দিয়ে পাপ করানোর চাইতে বিদআতে লিপ্ত করা,বিদআতের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করা অধিক পছন্দনীয়।
আমাদের সমাজে “বিদআতি” বলতে যদিও নির্দিষ্ট একটি দলকে বুঝানো হয় এটাও মূলত শয়তানের নেক চক্রান্তের অন্যতম কৌশল। এই চক্রান্তের ফলে মানুষ অন্যকে হেয় মনে করে নিজেকে সর্বদা পূরিপূর্ণ মনে করতে থাকে ফলে কখন যে সেও বিদআতের ওপর অধিষ্ঠ হয়ে যায় তা সে উপলব্ধি করতে পারে না!
আবার কিছু লোক “বিদআত” নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে এর চাইতেও জঘন্য “কবিরা গুনাহ” এ লিপ্ত হয়।যেমনঃ ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে,গালাগাল দিয়ে বসে এমনকি অন্যকে বারবার তুচ্ছজ্ঞান করার ফলে নিজের ভিতর অহংকারের বীজ বপন করে। এভাবে সে অন্যের কাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে নিজের ঈমান আমল সবকিছুই বিনষ্ট করে ফেলে।মূলত নিজের প্রতি, নিজ দলের প্রতি অতিরিক্ত আবেগই মানুষকে দ্বীন ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।আর নিঃসন্দেহে অহংকার বিদাতের চাইতেও নিকৃষ্ট!
আপনি যে দলেরই হোন,যে ব্যক্তিকেই ফলো করুন না করুন দ্বীনের জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত থাকা মানেই নির্ঘাত শয়তানের সাথে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।কেননা,যে দ্বীনের জ্ঞান অধ্যয়ন করে সে বিপথে যায় না।জ্ঞান মানুষের চিন্তাশক্তিকে সম্প্রসারিত করে।
অনেকেই দাবি করে থাকেন,ইবলীস বেশি জ্ঞানী ছিল বলেই সে অহংকারে পতিত হয়েছিল। তাই অতিরিক্ত জ্ঞান মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়!
ভুল! এটাও ঔসকল মানুষদের ওপর শয়তানের নেক চক্রান্তের অন্যতম একটি কৌশল। মূলত, জ্ঞান সল্পতার কারণেই মানুষ এমন দাবি করে থাকে।তাদেরকে প্রশ্ন করুন,তবে কী হযরত আদম (আঃ), হযরত ইবরাহিম (আঃ), হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইবলীসের চাইতেও কম জ্ঞানী বলে আপনারা দাবি করেন?
ইবলীস কি নবীর চাইতেও বেশি বিজ্ঞ; যে নবীদের স্বয়ং আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন?
অথচ, আল্লাহ ত স্বয়ং মানুষকে সবদিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন জীন-শয়তানের চেয়েও! তবে কি আল্লাহর এই দাবিও মিথ্যা? [নাউজুবিল্লাহ]
আসলে ইবলীস বেশি জ্ঞানী ছিল না; বরং জ্ঞানের চেয়ে তার ইবাদতের পরিমাণ বেশি ছিল বলেই সে অহংকারে পতিত হয়েছিল। তার মাঝে অহংকারের পরিণতি সম্পর্কে হীতজ্ঞান ছিল না ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভূর্ক্ত হয়েছিল। সুতরাং, শয়তান জ্ঞানী ছিল এই দাবির অসারতা প্রমাণিত!
ইলম অর্জনকে ফরয করা হয়েছে।আর ইলম ছাড়া কখনও আমল হয়না। তাই, আমলের চেয়েও ইলম অধিক জরুরী। নিঃসন্দেহে ইলমের অনুপাতে আমল কম হলে তার পরিণতি ভয়াবহ এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাই বলে আল্লাহর সাথে চালাকি করে ইলম অর্জনকে বাদ দেওয়া অযৌক্তিক। কেননা, ইলম অর্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার পিছনে সময় না দিলে তা অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
অনেকেই বলে সময় নেই,বিজি লাইফ।অথচ,তারা আনন্দ ফূর্তির জন্য,ঘুরাঘুরি, আড্ডার জন্য,টিভির সংবাদ, পত্রিকা, অনলাইনে সংবাদ সংগ্রহ কিংবা বিনোদনের জন্য প্রচুর সময় বের করে নেন। এমনকি দুনিয়াবি বই-পুস্তক মুখস্থের যথেষ্ট সময় তাদের থাকে কিন্তু দ্বীনের জন্যই কেবল সময় সংকীর্ণ।
এ থেকে বুঝা যায়,দ্বীন থেকে দুনিয়ার গুরুত্বই তাদের বেশি। দুনিয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়ে যদি কেউ দাবি করে যে দ্বীনের জন্য সময় নেই তবে তার জেনে রাখা উচিত এর জবাবদিহি হবে আরও ভয়াবহ। কেননা, এটা স্পষ্টতই দ্বীনের বিরুদ্ধ পৃষ্টপ্রদর্শন। আবার, কেউ দ্বীন অর্জনের সুযোগ পেয়েও ফিতনার অজুহাতে যদি বনজঙ্গলে চলে যায় এবং নিজেকে জ্ঞান অর্জনের অমৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে তবে তার পরিণতি হতে পারে আরও অধিক ভয়াবহ।
ইলম অর্জনের জবাবদিহিতা থেকে কেবল সে মুক্ত থাকতে পারবে যে এমন অবস্থানে আছে যেখানে দ্বীনী ইলম অর্জনের কোন সুযোগ নেই।
যেমনঃ আফ্রিকার বন জঙ্গলের কোন অধিবাসী! কারণ, তাদের কাছে দ্বীনি ইলম অর্জনের উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই।
তাই, তাদের ইলম কম থাকার কারণে আমল কম হলেও আল্লাহ তাদের প্রতি সদয় হবেন। কিন্তু, তারা এবং যারা দ্বীনি ইলমের সুযোগ পেয়েছে তারা কিভাবে সমান হতে পারে?
আল্লাহ কারো প্রতি জুলুম করেন না, কাউকে সাধ্যের অতিরিক্তও চাপিয়ে দেন না। যার যার সাধ্য অনুযায়ী সকলকেই জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।
নিশ্চয়,আল্লাহ ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী।