Writing

আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) সুখের সংসার

যে প্রসঙ্গে আজ বলতে যাচ্ছি তা কয়েকটি ভিন্ন আবেগের সংমিশ্রণ। আলোচনা করছি আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) জীবন নিয়ে, হে আল্লাহ আপনি তাদের উভয়ের প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাদের দুজনের মানবতা, দাম্পত্য জীবনের সংগ্রাম, এবং জীবনের কিছু কঠিন পরিস্থিতি এই আলোচনায় উঠে আসবে। ঐ পরিস্থিতি গুলোতে রাসুল (ﷺ) তাঁদের কিভাবে সান্ত্বনা দিয়েছেন, যত্ন সহকারে অভিভাবকত্ব করেছেন, পরিশেষে রাসুল (ﷺ) এবং ফাতিমা (রা:) এর মৃত্যু, এবং এর ভেতর দিয়ে মানবিক যে সংবেদনশীলতা তাই ফুটে উঠবে এই আলোচনায়।

আলী (রা:) ও ফাতিমা (রা:) উভয়ই ছিলেন রাসুল (ﷺ) এর ভালোবাসার প্রত্যাশী। প্রথমেই শুরু করা যাক রাসুল (ﷺ) এর ভালোবাসা দিয়ে। সবাই তাঁর ভালোবাসার প্রত্যাশী ছিল, সবাই জানতে চাইত রাসুল (ﷺ) কাকে বেশি ভালোবাসেন? হাদিসে প্রায় দেখবেন, লোকজন রাসুল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করতেন, “আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন?” চিন্তা করতে পারেন, আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) দুজনেই রাসুল (ﷺ) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাদের দুজনের মধ্যে আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন?

আল আব্বাস, আলী এবং উসামা ইবনে যাইদ একবার রাসুল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি কাকে বেশি ভালোবাসেন। তখন রাসুল (ﷺ) উত্তর দিয়েছিলেন “ফাতিমাকে”, কিন্তু এখন আলী এবং ফাতেমা দুজনেই রাসুল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করছেন, “আমাদের দুজনের মধ্যে আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন?”
আপনার কি মনে হয়?
রাসুল (ﷺ) তখন কি উত্তর দিয়েছিলেন? আপনার সন্তানরা যখন আপনাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন?” আপনি তখন উত্তর দিতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাই না? রাসুল (ﷺ) কিন্তু খুব সুন্দর বাকপটু উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি তো মিথ্যে বলতে পারেন না। তাঁর হৃদয় জুড়ে আছেন ফাতিমা (রা:), তিনি সত্যিই ফাতেমাকে ভালোবাসেন। তাঁর অন্তরে ফাতেমার জন্য রয়েছে বিশেষ স্থান। কিন্তু তিনি এমনভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি যা আলীকে আঘাত করবে।

আলী (রা:) কে তিনি নিজ সন্তানের মতই মানুষ করেছেন, এবং ভালোবেসেছেন। আলী (রা:) একাধারে তাঁর চাচাতো ভাই, মদিনায় ভ্রাতৃ স্থানীয়, এবং তাঁর সন্তান তুল্য। তাঁর জীবনে আলীর ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই দুজনেই তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাদের দুজনের মধ্যে আপনি কাকে বেশি ভালবাসেন?” রাসুল (ﷺ) তখন আলীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, هِيَ اَحَبُّ اِلَيَّ مِنْك وَاَنْتَ اَعَزُّ عَلَيَّ مِنْهَا, সত্যিই খুব সুন্দর উত্তর! هِيَ اَحَبُّ اِلَيَّ مِنْك – “সে (ফাতিমা) আমার কাছে তোমার চেয়ে বেশি প্রিয়”, وَاَنْتَ اَعَزُّ عَلَيَّ مِنْهَا – “কিন্তু তুমি আমার কাছে তাঁর চেয়ে বেশি মূল্যবান।” রাসুল (ﷺ) এমন ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন যাতে দুজনেই কিছুটা গর্ব বোধ করতে পারেন। “আমার কাছে তোমার মূল্য বেশি, কিন্তু তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা বেশি।” তিনি যখন আলী (রা:) কে বলেছিলেন, “তুমি আমার কাছে বেশি মূল্যবান” অবশ্যই কথাটির কিছু অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। ফাতিমা (রা:) কে তিনি বলেছিলেন, “তুমি আমার কাছে বেশি প্রিয়” – সত্যিকার অর্থেই তিনি ফাতিমা (রা:) কে ভালোবাসতেন।

কাছে আসার আকুলতা:

আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) এর দাম্পত্য জীবনে প্রথম যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা কিন্তু ঝগড়া বিবাদ, বা দারিদ্রতা নয়, বরং তা ছিল রাসুল (ﷺ) এর সাথে তাদের দূরত্ব। বিয়ের পর তাঁরা রাসুল (ﷺ) কাছ থেকে দূরে চলে গেলেন, কারণ তাদের ঘর ছিল দূরে। এই দূরত্ব আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) অনুভব করেছিলেন, সেই সাথে রাসুল (ﷺ)ও। ফাতিমা (রা:) রাসুল (ﷺ) এর মেয়ে হিসাবে বড় হয়ে, اُمْ اَبِيهَا – ‘উম আবিহা’ তাঁর (ফাতিমার) বাবার মায়ের ভূমিকা পালন করেছিলেন।

মদিনার পুরাতন মানচিত্র দেখলে বুঝতে পারবেন, রাসুল (ﷺ) এর হুজুরাত – ছোট ঘর গুলো ছিল সেই স্থানে, যেখানে এখন তাঁর কবর। আয়েশা (রা:) এর হুজুরাত বা ঘরের উপরে রাসুল (ﷺ) এর কবর। হুজুরাত গুলো ছিল মসজিদের বাম পাশে, দুটো দুটো করে সেই এলাকা জুড়ে। রাসুল (ﷺ) এর সব ঘরগুলি ছিল একজন লোকের জমিতে নির্মিত। তাঁর নাম হারিসা ইবনে নুও’মান, যিনি সাহাবাদের মধ্যে খুব একটা সুপরিচিত নন। মসজিদের পাশে এক বিশাল জমির মালিক ছিলেন তিনি। যখনই রাসুল (ﷺ) এর বিয়ে হত, তখনই তিনি তাঁর জমির কিছু অংশ রাসুল (ﷺ) কে দান করতেন, যাতে রাসুল (ﷺ) সেখানে নতুন একটি ঘর তুলতে পারেন।

যখন আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) এর বিয়ে হল, রাসুল (ﷺ) চাইছিলেন তাঁরা তাঁর কাছাকাছি থাকুক, কিন্তু হারিসা (রা:) এর কাছে আরও জমি চাওয়ার ব্যাপারে রাসুল (ﷺ) খুব লজ্জিত বোধ করলেন। একদিন হারিসা (রা:) রাসুল (ﷺ) এর চেহারায় সেই আবেগ ও আকুলতা দেখতে পেলেন। তাই তিনি রাসুল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কি আপনার কন্যা ফাতিমার কথা মনে পড়ছে?
আপনি কি তাঁর সাথে দূরত্ব অনুভব করছেন?
” রাসুল (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ”, হারিসা (রা:) কি ইঙ্গিত করছে তাও তিনি বুঝতে পারলেন। রাসুল (ﷺ) বললেন, “আমি লজ্জায় আপনার কাছে আর জমি চাইছি না, কারণ আপনি ইতিমধ্যে আমাদের অনেক জমি দিয়েছেন।” সুবহানাল্লাহ! এটা রাসুল (ﷺ) এর বিনম্রতা।
তাঁর এক তুড়ির ইশারায় সবাই তাঁর জন্য সবকিছু অকাতরে দিতে প্রস্তুত। তিনি হারিসা (রা:) এর বদান্যতার সুযোগ নিতে চাননি। তাই তিনি বলেছিলেন, “আমি আপনাকে আর জিজ্ঞেস করতে চাইনি।” হারিসা (রা:) তখন বলেছিলেন, “আল্লাহর শপথ! আমার নিজের কাছে যেটুকু জমি আছে তার চেয়েও আমার কাছে বেশি প্রিয় আপনাকে যে জমিটুকু আমি দিয়েছি। আপনাকে জমি উপহার দিতে আমি ভালোবাসি, আমার সম্পত্তি থেকে আপনি যত খুশী নিতে পারেন।

” তাই তিনি রাসুল (ﷺ) কে পরামর্শ দিয়েছিলেন, “আয়েশা (রা:) এর সাথে আপনার যে ঘরটি আছে, তার ঠিক সামনের জমিটি আপনি নিতে পারেন।” রাসুল (ﷺ) তখন হাসলেন, এবং হারিসা (রা:) এর জন্য দু’আ করলেন, আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতে প্রাসাদ দান করেন। আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) এর ঘর বানানো হলো রাসুল (ﷺ) ও আয়েশা (রা:) এর ঘরের কাছাকাছি। ঐ ঘরগুলোর নকশা যদি আপনি দেখেন, ঘর গুলোতে শুধু একটি করে জানালা ছিল। কাজেই আয়েশা (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) এর জানালা ছিল ঠিক সামনা সামনি। এবার রাসুল (ﷺ) এর ঘরের খুব কাছাকাছি নির্মিত হলো আলী (রা:) এবং ফাতিমা (রা:) এর ঘর।

আলী (রা:) ও ফাতিমার (রা:) সুখের সংসার।

পর্ব – ০১

মূল: ড. ওমর সুলাইমান

লিখেছেন

Picture of ফাহমিনা হাসানাত

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture