আজ থেকে ১০০ বছর পর আমরা কেউই দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকব না। থাকব কবরের গহীন অন্ধকারে। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে থাকবে না কোনো মেলবন্ধন। আমাদের চূড়ান্ত ভাগ্য চোখের সামনে সুস্পষ্টভাবে থাকবে।
আগন্তুকরা আমাদের বাড়িতে বসবাস করবে। আমাদের চাকরি ফুরিয়ে যাবে। আমাদের সম্পদ অন্যদের হাতে চলে যাবে। কেউ আমাদের স্মরণ করবে না। আমরা কয়জন আমাদের দাদার বাবার নাম জানি?
আমাদের নামও মানুষ ভুলে যাবে।
তাহলে মানুষ আমাদের নিয়ে কি ভাবে তা নিয়ে এত চিন্তিত কেন আমরা? কেন সম্পদ, ঘরবাড়ি বা পরিবার নিয়ে এত উদ্বিগ্ন আমরা? একদিন এসব মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
বিশ্বজগতের বয়সের তুলনায় আমাদের অস্তিত্বকে তুলনা করলে তা এক পলকের মতো। একদিন আপনার পতন হবে, চোখের পলকে হারিয়ে যাবেন আপনি। কবরের অন্ধকার নিশ্চুপ জগতে শুয়ে থাকতে থাকতে অনুধাবন করব এই দুনিয়া আসলে কত ক্ষুদ্র।
দুনিয়ার পেছনে নিরন্তর ছোটা ছিল হাস্যকর। আমরা আফসোস করব যে পুরো জীবনটা যদি আল্লাহর ইবাদত ও নেককাজে কাটিয়ে দিতে পারতাম। আখিরাতে কাজে আসবে সাদকায়ে জারিয়াগুলো। আমাদের কেউ কেউ সাহায্যের জন্য আর্তচিৎকার করবে কিন্তু তা কোনো কাজে আসবে না।
আপনি করজোড়ে বলবেন, হে আমার রব আমাকে ফিরে যেতে দিন যেন আমি সৎকাজ করতে পারি। কিন্তু মানুষকে কখনোই ফিরে যেতে দেওয়া হবে না।
وَ اَنۡفِقُوۡا مِنۡ مَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ فَیَقُوۡلَ رَبِّ لَوۡ لَاۤ اَخَّرۡتَنِیۡۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَکُنۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۰﴾ وَ لَنۡ یُّؤَخِّرَ اللّٰهُ نَفۡسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا ؕ وَ اللّٰهُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۱﴾
আর আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে। কেননা তখন সে বলবে, হে আমার রব, যদি আপনি আমাকে আরো কিছু কাল পর্যন্ত অবকাশ দিতেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম। আর সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। আর আল্লাহ কখনো কোন প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে। আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। [সুরা মুনাফিকুন : ১০-১১]
মানুষের দুনিয়ার জীবনে যাত্রা শুরু হয় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের মাধ্যমে। এরপর তা অব্যাহত থাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত। এর মাঝে আছে অনেক স্টেশন, যার প্রতিটি আপন বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ। আর শেষে আপনার যাত্রা সম্পূর্ণ হবে জান্নাত বা জাহান্নামে যাওয়ার মাধ্যমে।
প্রিয় দীনি ভাই ও বোনেরা, এখনও কিছু সময় আছে আমাদের হাতে। আসুন নিজেদের শেষ সময়ের আগে বদলে ফেলি।
আপনি জানেন জানাজার কয়েক ঘন্টা পর কি হয়? কান্নার রোল আস্তে আস্তে থেমে যায়। আপনার পরিবার আত্মীয়স্বজনদের খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করতে শুরু করে। আপনার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা দুনিয়ার চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কিছু আত্মীয় আপনার পরিবারকে কল দিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলবে, তারা কিছু জরুরী কাজের জন্য জানাজায় শরিক হতে পারেনি। অন্যরা নিজেদের বাড়িতে ফেরার চিন্তাভাবনা করতে শুরু করবে। এরপর মানুষের এই দলটা প্রত্যেকে নিজ নিজ পথ ধরবে। কিছু দিন পর আপনার সন্তানেরা কাজে ফিরে যাবে। আপনার চাকুরিদাতা নতুন লোকের সন্ধান করবে।
নতুন নেতা আসবে, নতুন স্ক্যান্ডাল হবে। ছয় মাসের মধ্যেই আপনার স্ত্রী টিভিতে বিনোদন অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করবে। হাস্যরসে মজে উঠবে। আপনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী হয়তো ঘটা করে স্মরণ করা হবে। কিন্তু আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া হবে। সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। খুব কম মানুষই আপনাকে স্মরণ করবে।
আপনি কার জন্য জীবনে এতকিছু করছেন? অনেক মানুষই এই নশ্বর দুনিয়ার জীবন ছেড়ে পরকালে চলে গিয়েছে। তারা কেবল দুনিয়ার জন্যই নিজেদের সবকিছু উৎসর্গ করেছিল। রাজা, রাণী, লাখপতি, কোটিপতি, জালিম – সবাই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কয়জনকে মানুষ স্মরণ করে?
وَ کَمۡ اَهۡلَکۡنَا قَبۡلَهُمۡ مِّنۡ قَرۡنٍ هُمۡ اَشَدُّ مِنۡهُمۡ بَطۡشًا فَنَقَّبُوۡا فِی الۡبِلَادِ ؕ هَلۡ مِنۡ مَّحِیۡصٍ
আমি তাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছি যারা পাকড়াও করার ক্ষেত্রে এদের তুলনায় ছিল প্রবলতর, তারা দেশ-বিদেশ চষে বেড়াত। তাদের কি কোন পলায়নস্থল ছিল? [সুরা কফ : ৩৬]
যারা দুনিয়ায় পরাক্রমের সাথে রাজত্ব করেছে তাদের কেউ কি আজ টিকে আছে? তাদের ফিসফিসানিও শোনা যায় না। তারা যেই দুনিয়ার জন্য বেঁচে ছিল সেই দুনিয়াই তাদেরকে ভুলে গেছে। যখন মৃত্যু গলার কাছে চলে আসে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না, তাওবার দুয়ার বন্ধ থাকে।
বর্ণিত আছে যে, পূর্বের এক বিখ্যাত আলিম ইয়াজিদ আল-রাকাশি তাঁর নিজের সাথে এক কল্পিত আলোচনায় নিজেকে শাসাচ্ছিলেন যে,
হায় আফসোস ইয়াজিদ! তোমার জন্য আফসোস! কে তোমার হয়ে সালাত আদায় করবে? কে তোমার হয়ে সাওম আদায় করবে? কে তোমার হয়ে রবকে সন্তুষ্ট করবে? মৃত্যু তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। কবর হবে তোমার বাসস্থান। পৃথিবী হবে তোমার বিছানা। কবরের কীট হবে তোমার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। এসময় তুমি সবচেয়ে ভয়ংকর দিবসের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। তখন তোমার অবস্থা কেমন হবে?
এরপর তিনি এত কান্নাকাটি করেন যে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।
এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে পূর্বেকার সালাফদের মনে মৃত্যু ও পরকালের চিন্তা কীভাবে সবসময় ঘুরপাক খেত। তারা জানত মৃত্যুকে এড়ানো অসম্ভব। এটা হবে তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ঘটনা।
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ : جَاءَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ : يَا مُحَمَّدُ، عِشْ مَا شِئْتَ فَإِنَّكَ مَيِّتٌ، وَأَحْبِبْ مَنْ أَحْبَبْتَ فَإِنَّكَ مَفَارِقُهُ، وَاعْمَلْ مَا شِئْتَ فَإِنَّكَ مَجْزِيٌّ بِهِ. ثُمَّ قَالَ : يَا مُحَمَّدُ شَرَفُ الْمُؤْمِنِ قِيَامُ اللَّيْلِ وَعِزُّهُ اسْتِغْنَاؤُهُ عَنِ النَّاسِِ- رواه الحاكم بإسناد صحيح
অনুবাদ : সাহল বিন সাদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, জিবরিল এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যতদিন খুশী জীবন যাপন কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি মৃত্যুবরণ করবে। যার সাথে খুশী বন্ধুত্ব কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি তাকে ছেড়ে যাবে। যা খুশী তুমি আমল কর। কিন্তু মনে রেখ তুমি তার ফলাফল পাবে। জেনে রেখ, মুমিনের মর্যাদা হল ইবাদতে রাত্রি জাগরণে এবং তার সম্মান হল মানুষের মুখাপেক্ষী না হওয়ার মধ্যে। [হাকিম হা/৭৯২১; সিলসিলা সহিহাহ হা/৮৩১।]
বনি আদমের চাহিদা কখনই শেষ হবে না। রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি বনি আদমের স্বর্ণভরা একটা উপত্যকা থাকে, তথাপি সে তার জন্য দুটি উপত্যকা হওয়ার কামনা করবে। তার মুখ মাটি ছাড়া অন্য কিছুই ভরতে পারবে না। তবে যে ব্যক্তি তাওবা করবে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৩৯)
বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ করে। আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলাম। এ অবস্থায় এক আনসারী নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে তাঁকে সালাম দিল। অতঃপর বলল, হে আল্লাহর রাসুল, মুমিনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম কে? তিনি বলেন, স্বভাব-চরিত্রে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি উত্তম। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, মুমিনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান কে? তিনি বলেন, তাদের মধ্যে যারা মৃত্যুকে বেশি স্মরণ করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তারাই সর্বাধিক বুদ্ধিমান।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৪২৫৯)
দুনিয়ার প্রতি বেশি আকর্ষণের ফলে মানুষ মৃত্যুকে ভুলে যায়। ইরশাদ রয়েছে,
اَلۡهٰکُمُ التَّکَاثُرُ
‘বেশি থেকে বেশি (দুনিয়া) কামানোর লোভ তোমাদের গাফিল করে রাখে।’ [সুরা তাকাসুর : ১]
তাকাসুর অর্থ হল অধিক কামনা করা বা প্রাচুর্য নিয়ে পরস্পর প্রতিযোগিতা করা। এ কথাটি ব্যাপক; প্রাচুর্যে মাল-ধন, সন্তান-সন্ততি, সহযোগী-পৃষ্ঠপোষক, বংশ-গোত্র প্রভৃতি সবই শামিল। প্রত্যেক ঐ বস্তু যার প্রাচুর্য ও আধিক্য মানুষের প্রিয় এবং যা অধিকভাবে পাবার প্রচেষ্টা ও কামনা মানুষকে আল্লাহর আহকাম এবং আখেরাত হতে উদাসীন করে দেয়, তাই উদ্দেশ্য এখানে। এ স্থানে আল্লাহ তাআলা মানুষের সেই দুর্বলতাকে ব্যক্ত করেছেন, অধিকাংশ মানুষ সর্বযুগে যার শিকার হয়ে থাকে।
প্রাচুর্য খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে শয়তান তাকে দিয়ে অন্যায় করিয়ে নেয়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা বেশি করে স্বাদ বিনষ্টকারী বস্তুটির কথা তথা মৃত্যুকে স্মরণ করো।’
(তিরমিজি, হাদিস : ২৩০৭)
আমরা কবরস্থানে গেলে কিন্তু শুধু বৃদ্ধদের কবরই দেখি না। কবরস্থানে আমরা এমন অনেকের কবর দেখি, যারা বেশ কম বয়সে মারা গিয়েছে। কেউ পৃথিবীর আলো দেখার আগেই চলে গেছে ওপারে, কেউ জন্মানোর কয়েক মুহূর্ত পর, কেউবা ১মাস বয়সে, কেউ ১বছর বয়সে, কেউ ৮ বছর বয়সে, কেউ ২০বছর বয়সে, কেউবা ৯০ বছর বয়সে।
তাদের কবরে যাতায়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মৃত্যুর আসলে কোনো বয়স নেই। আমরা জানি না আমরা কখন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাব। একদিন আমরাও তাদের জায়গায় থাকব, তাদের প্রতিবেশী হব। আমরাও কবরের আঁধারে শুয়ে থাকব। এরপর আমাদের চূড়ান্ত বিচারের জন্য কবর থেকে ওঠানো হবে।
মৃত্যুর স্মরণ আমাদের ইবাদতে আরো মনোযোগী করে। তাই যারা সালাতে খুশুখুযুর অভাববোধ করেন তারা সেসময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করুন। যে ব্যক্তি সালাতে মৃত্যুর কথা স্মরণ করে, সে সঠিকভাবে সালাত আদায়ের প্রতি আরো যত্নবান হয়।
এমনভাবে সালাত আদায় করুন যেন এটিই আপনার জীবনের শেষ সালাত। কারণ, একদিন এটা সত্য হবেই। সত্যিই একদিন দুনিয়ার জীবনের শেষ সালাতটি আপনি আদায় করবেন। এরপর আর কোনোদিনও দুনিয়াতে সালাত আদায় করা হবে না।