মক্কায় রাসুল (ﷺ) যখন ইসলামের দাওয়াত দিলেন, কুরাইশ গোত্রের নেতারা তার চরম বিরোধিতা করল। শুরু হলো মুসলমানদের উপর নির্যাতন। কুরাইশরা বানু হাশেম এবং বানু মুত্তালিবের লোকদের উপর বয়কট ঘোষণা করে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অসুস্থতায়, এবং নিদারুণ কষ্টে তারা দিনাতিপাত করে। সেই একই বছরে, নবী মুহাম্মদ (ﷺ) তার দুই শক্তিশালী সমর্থক এবং সান্ত্বনার উৎস, তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা:) এবং তাঁর চাচা আবু তালিবকে হারান।
আল্লাহর একত্ববাদ অর্থাৎ ইসলামের বার্তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাসুল (ﷺ) তায়েফের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তিনি আশা করেছিলেন তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাঁকে সমর্থন জানাবে।
রাসুল (ﷺ) তায়েফে তাকীফ গোত্রের প্রধানদের সাথে দেখা করেছিলেন। তিনি তাদের ইসলাম সম্পর্কে বললেন, এক আল্লাহর ইবাদত করতে বললেন, এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করতে বললেন। কিন্তু গোত্রীয় প্রধানরা তার বার্তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করল না, তাকে চরম অপমান করল। তারা এলাকার ছোট ছেলে মেয়ে এবং ক্রীতদাসদের তাঁর পিছনে লেলিয়ে দিল। পাথর মেরে তারা তাঁকে রক্তাক্ত করলো। রাসুল (ﷺ) দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাগানে আশ্রয় নিলেন।
রাসুল (ﷺ) এখন একা, রক্তাক্ত এবং প্রত্যাখ্যাত। একটি পাথরের উপর শুয়ে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। তিনি তো রাহমাতুল্লিল আলামিন’ – সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত, তিনি তায়েফবাসীদের শাস্তি বা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অনুরোধ করলেন না।
তিনি তায়েফে যে শক্তিশালী দু’আটি করেছিলেন তা সব মুসলিমদের মুখস্থ করা উচিত। যখনই আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি, জুলুমের শিকার হই, বা আমাদের ওপর যখন বিপর্যয় নেমে আসে তখন এই দু’আটি আমাদের করা উচিত।
اللّٰهُمَّ إِلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِى، وَقِلَّةَ حِيلَتِى وهَوَانى عَلَى النَّاس يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ المُسْتَضْعَفِينَ، وأَنْتَ رَبَّى إلَى مَنْ تَكِلَنِى إِلَى بَعِيدٍ يَتَجَهَّمُنِى؟ أوْ إلى عَدوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِى، إنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ غَضَبٌ عَلَىَّ فَلاَ أُبَالِى، غَيْرَ أَنَّ عَافِيتَكَ هِى أَوْسَعُ لى، أَعُوذُ بِنُورِ وَجْهِكَ الَّذِى أَشْرَقَتْ لَهُ الظُّلُمَاتُ، وَصَلُحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنيا وَالآخِرَةِ أَنْ يَحِلَّ عَلَىَّ غَضَبُكَ أوْ أَنْ يَنْزِلَ بى سَخَطُك، لك العُتبى حَتَّى تَرْضَى وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلا بِكَ
‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে স্বীয় দুর্বলতা, (মানুষকে বুঝাতে) আমার কলা-কৌশলের স্বল্পতা এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার অভিযোগ করছি। হে সর্বাধিক দয়ালু! আপনি দুর্বলদের প্রভু, আমারও প্রভু। আপনি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করছেন? আপনি কি আমাকে দূরের এমন অচেনা কারও হাতে ন্যস্ত করছেন, যে আমার সাথে কঠোর ব্যবহার করবে? নাকি কোন শত্রুর হাতে সোপর্দ করেছেন , যাকে আপনি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছেন? আপনি যদি আমার উপর রাগান্বিত না হন তাহলে আমি কোন কিছুই পরওয়া করিনা। তবে নিঃসন্দেহে আপনার ক্ষমা আমার জন্য সর্বাধিক প্রশস্ত ও প্রসারিত। আমি আপনার সেই চেহারার আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূরিভূত হয়ে যায় এবং যা দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় সংশোধন হয়। এই কথার মাধ্যমে আমার উপর আপনার ক্রোধ নেমে আসা হতে, অথবা আমার উপর আপনার অসন্তুষ্টি নাযিল হওয়া থেকে আপনার আশ্রয় চাই। আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই আমার সকল প্রচেষ্টা। আপনার সাহায্য ব্যতীত অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় এবং আপনার তাওফীক ও শক্তি ছাড়া আপনার আনুগত্য করা অসম্ভব’’।
সেই মুহুর্তে, ফেরেশতা জিবরাঈল (আ:) রাসুলের (ﷺ) কাছে এসে বললেন,
‘তিনি যদি চান তবে আল্লাহ তায়েফবাসীদের ঘিরে থাকা দুটি পর্বত নিক্ষেপ করে তাদের ধ্বংস করার জন্য একজন ফেরেশতাকে আদেশ দিতে পারেন।’
যারা তাঁকে অপমান করেছে এবং পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করেছে, তাদের প্রতি রাসুল (ﷺ) কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?
তিনি তাদের প্রতি সহিংসতা নয় করুণার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তায়েফবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে তিনি ফেরেশতা জিবরাঈলকে (আ:) বললেন, ‘আমি বরং আশা করি আল্লাহ তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন লোক সৃষ্টি করবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।’
আমরা আজ তায়েফের দিকে তাকালে আমাদের প্রিয় নবীর (ﷺ) দূরদৃষ্টি, ধৈর্য এবং করুণার প্রশংসায় আমাদের অন্তরে নুয়ে আসে। বর্তমানে তায়েফ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। তায়েফ সৌদি আরবের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং আঙ্গুর, ডালিম, ডুমুর, গোলাপ এবং মধুর জন্য সুপরিচিত। সৌদি আরবে বসবাসকারী যে কেউ এর শীতল আবহাওয়া এবং পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্যের জন্য তায়েফ ভ্রমণ করতে পছন্দ করে।
ইতিহাসে তায়েফের ঘটনার নেতিবাচক দিকটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এটি বোধগম্য কারণ এটি ছিল নবীজীর (ﷺ) জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত, আয়েশা (রা.) রাসুলকে (ﷺ) জিজ্ঞাসা করেন,
‘ওহুদের চেয়ে কঠিন কোনো দিন কি আপনার জীবনে এসেছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন তায়েফের দিনগুলোর কথা উল্লেখ করেন।’
[সিরাতে মোস্তফা : ১/২৭১ ও ২৭৫]
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেদিন এই ঘটনা থেকে ভালো কিছুর উৎপত্তি হয় এবং ইসলামের বাণী সম্পূর্ণরূপে বিফল হয়নি। কেউ একজন সেই সময়ে তায়েফে ইসলামের বাণী গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু নবীর জীবনী সম্পর্কিত বইগুলিতে সবসময় তাঁর উল্লেখ নেই।
যখন রাসুল (ﷺ) পাথরের উপর বসে আল্লাহর দিকে হাত তুললেন, তখন বাগানের দুই মালিক তাঁকে দেখেন এবং তারা সমব্যথী হয়ে তাদের একজন ক্রীতদাসকে একগুচ্ছ আঙ্গুর দিয়ে রাসুলের (ﷺ) কাছে পাঠান।
ক্রীতদাসটি ছিল একজন খ্রিস্টান যুবক, যার নাম আদ্দাস। আদ্দাস যখন রাসুলকে (ﷺ) আঙ্গুর দিলেন, তখন তিনি খাওয়ার আগে নবীকে বলতে শুনেছিলেন, بسم الله – “আল্লাহর নামে”। আদ্দাস বিস্মিত এবং কৌতূহলী হলেন কারণ তিনি আগে কাউকে এমন কথা বলতে শোনেননি। রাসুল (ﷺ) আদ্দাসকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কোথা থেকে এসেছেন এবং আদ্দাস উত্তর দিলেন যে তিনি নেনোয়া থেকে এসেছেন। রাসুল (ﷺ) বললেন, ‘কোন নেনোয়া? যেখানে ইউনুস (আ:) নবী হয়ে এসেছিলেন?’ আদ্দাস বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কিভাবে ইউনুসের (আ:) কথা জানলেন?’ তখন রাসুল (ﷺ) বললেন, ‘তিনি আমার ভাই, তিনি আল্লাহর নবী, আমিও আল্লাহর নবী।’
আদ্দাস অভিভূত হলেন; তিনি নিশ্চিত হলেন এই ব্যক্তি অবশ্যই একজন নবী।আদ্দাস রাসুলের (ﷺ) মাথায় ও হাতে চুমু খেলেন এবং তিনি সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
হে আল্লাহ! আপনি আদ্দাসের প্রতি সন্তুষ্ট হন। সুতরাং, তায়েফে নবীর মিশন সম্পূর্ণরূপে নিষ্ফল হয়নি। আদ্দাস নামক এক যুবক রাসুলের (ﷺ) সাথে সাক্ষাৎ ও কথা বলার পর আন্তরিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
একবার কল্পনা করে দেখুন সেই মুহূর্তটি – আমাদের প্রিয় রাসুল (ﷺ) রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছেন পাথরের উপর। শুধু তাঁর দেহ রক্তাক্ত নয়, রক্তক্ষরণ চলছে তাঁর অন্তরে। এত অপমান এবং প্রত্যাখ্যানের পরেও রাসুল (ﷺ) কিন্তু তায়েফবাসীর জন্য বদদোয়া করেননি, বরং তিনি নিজের অপারগতার কথা আল্লাহ তা’লাকে জানিয়েছেন।কায়মনোবাক্যে তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছেন। এরকম অসহায় অবস্থায় আদ্দাস নামের ক্রিস্টান যুবকটি আঙ্গুর নিয়ে এগিয়ে এসেছেন রাসুলের (ﷺ) কাছে, তাঁর কথা শুনে আন্তরিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ যেনো প্রচন্ড দগ্ধতায় এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি। রাসুল (ﷺ) আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, আল্লাহ সুবাহানাতালা সেই মুহূর্তে আদ্দাসকে পাঠিয়ে প্রশান্ত করেছিলেন তাঁর ক্লান্ত দেহ মন।
এই ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি তা হ’ল কোনো প্রচেষ্টা বা ভালো কাজকে কখনোই ছোট করে দেখা উচিত নয়। বিশুদ্ধ নিয়ত, অধ্যবসায় এবং আন্তরিকতা থাকলে যেকোনো কাজে সফলতা আসবেই।