আপনি সত্যবাদী নাকি মিথ্যাবাদী
সত্যবাদিতা মুমিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। আপনি যদি একজন নিয়মিত মিথ্যাবাদী হন, তাহলে আপনি মুমিন হতে পারবেন না। একজন মুমিন কখনো অনবরত মিথ্যা বলতে পারে না। সূরা আহযাবে আল্লাহ জান্নাতবাসীদের কিছু গুণের কথা উল্লেখ করেন। সেই গুণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সত্যবাদিতা।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, রোজাদার পুরুষ ও নারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী; তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান (জান্নাত) প্রস্তুত করে রেখেছেন।”
[সূরা আহযাব ৩৩: ৩৫]
আপনি যদি সত্যবাদী হন, তাহলে কিয়ামতের দিন সত্যবাদিতা আপনার কাজে আসবে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“এটা হলো সেই দিন, যেদিন সত্যবাদীগণকে তাদের সততা উপকার করবে।”
[সূরা আল-মায়িদাহ: ১১৯]
আপনি যদি সত্যবাদী হন, তাহলে আপনার সততার জন্য আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে তাদের সততার জন্য পুরস্কৃত করতে পারেন।”
[সূরা আহযাব: ২৪]
আল্লাহ যেমন আমাদেরকে সত্য বলার নির্দেশ দেন, সত্য বলায় উৎসাহিত করেন, তেমনি আমাদের বন্ধু কারা হবে তাদের সম্পর্কেও বলেন। আমরা যেন মিথ্যাবাদীদেরকে বন্ধু হিশেবে গ্রহণ না করি সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।” [সূরা তাওবা: ১১৯]
আমরা যদি মিথ্যাবাদীদেরকে বন্ধু হিশেবে গ্রহণ করি, তাদের সাথে থাকতে থাকতে একসময় আমরাও মিথ্যা বলা শুরু করবো। এজন্য আমাদের বন্ধু কারা সেটা যাচাই করতে হবে। যদি দেখা যায় আমাদের বন্ধুরা অনবরত মিথ্যা বলে, তাহলে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“সত্য নেকির দিকে পরিচালিত করে আর নেকি জান্নাতে পৌঁছায়। আর মানুষ সত্যের ওপর কায়িম থেকে অবশেষে ‘সিদ্দীক’ –এর দরজা লাভ করে। মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হয়।”
[সহীহ বুখারী: ৬০৯৪]
দেখুন, সত্যের পথ জান্নাতে, মিথ্যার পথ জাহান্নামে। আপনি অনবরত মিথ্যা বলা শুরু করলে মিথ্যা বলা আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
জাফর ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু নাজ্জাশীর সামনে ইসলামের বার্তা তুলে ধরেন। জাফর ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের বার্তা পাঁচটি পয়েন্টে উল্লেখ করেন। তারমধ্যে একটি ছিলো-
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সত্য বলতে নির্দেশ দেন।”
সুতরাং, এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, আমাদেরকে অবশ্যই সত্য বলতে হবে। কোনো কিছু বলার আগে সেটা যাচাই করে নিতে হবে। তবে, তিনটি ক্ষেত্রে কথা বলার সময় আমাদেরকে অতিরিক্ত সতর্ক হতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সেসব ক্ষেত্রে আমরা সত্য কথা বলছি।
১। যখন আমার দ্বীনের ব্যাপারে কথা বলবো
যখন আমরা ইসলাম নিয়ে কোনো কথা বলবো, তখন ১০০% নিশ্চিত হয়ে বলতে হবে। ইসলাম নিয়ে কোনো মিথ্যা কথা বলতে পারবো না। কোনো বিষয়ে যদি আমাদের জানা না থাকে, তাহলে আমরা স্বীকার করবো যে- আমরা জানি না। কিন্তু, না জেনে কিছু বলবো না।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে, তারা সফলকাম হবে না।”
[সূরা আন-নাহল: ১১৬]
আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে কোনো কিছু বলতে হলে জেনেশুনে বলতে হবে। নিজের মনগড়া কোনো কথা বলা যাবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“তোমরা আমার ওপর মিথ্যারোপ করো না। কারণ, আমার ওপর যে মিথ্যারোপ করবে, সে জাহান্নামে যাবে।”
[সহীহ বুখারী: ১০৬]
আমরা যদি বলি ‘এটা রাসূলুল্লাহ বলেছেন’ বা ‘এটা হাদীসে আছে’ তাহলে নিশ্চিত হয়ে বলতে হবে। নিজেদের বানানো কোনো কথাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে চালিয়ে দেয়া যাবে না। যারা এমন করে, তাদের স্থান জাহান্নামে।
২। আল্লাহর নামে কসম করে মিথ্যা বলা
এমনিতে তো মিথ্যা বলা গুনাহের কাজ, আল্লাহর নামে কসম করে মিথ্যা বলা তারচেয়ে বেশি ভয়ানক। আপনি যদি কারো সাথে কথা বলার সময় বলেন ‘আল্লাহর কসম!’ বা ‘ওয়াল্লাহি’, তারপর যদি মিথ্যা বলেন তাহলে আপনার অনেক বেশি গুনাহ হবে। বিশেষ করে আদালতে সাক্ষ্য দেবার সময়।
৩। ব্যবসা করতে গিয়ে মিথ্যা বলা
ব্যবসায়ীরা মুনাফার্জনের জন্য অনেক সময় মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তারা বলে, ‘পণ্যটি আমি ১০০০ টাকা দিয়ে কিনেছি, আপনাকে কেনা দামে বিক্রি করছি’। আসলে দেখা যায় তারা পণ্যটি কিনেছে ৭০০ টাকা দিয়ে, ৩০০ টাকা লাভে বিক্রি করছে। সে মনে করে মিথ্যা বলার কারণে তার ৩০০ টাকা লাভ হয়েছে। আসলে মিথ্যা বলার কারণে তার ব্যবসায় বরকত কমে গিয়েছে সেটা সে বুঝতে পারছে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“ক্রেতা-বিক্রেতা যদি সত্য বলে এবং পণ্যের অবস্থা ব্যক্ত করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ গোপন করে, তবে তদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হবে।”
[সহীহ বুখারী: ২০৭৯]
আপনি সততার সাথে ব্যবসা করলে ব্যবসায় যেমন লাভ হবে, তেমনি আল্লাহ সেই ব্যবসায় বরকত দান করবেন। আর মিথ্যাকে পুঁজি করে ব্যবসা করলে মানুষজন একসময় না একসময় আপনার প্রতারণা ধরে ফেলবে। আপনি দুনিয়াতে অপদস্থ হবেন, আখিরাতেও।
তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। ইসলাম সেসব ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়াকে অনুমতি দিয়েছে। যেমন: স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। স্বামী স্ত্রীকে এমন একটি কথা বললো, যেটা আসলে সত্য নয়, তবে কথাটি তাদের মধ্যকার বন্ধন বাড়াবে। এসব ক্ষেত্রে এমন মিথ্যা কথা ইসলাম সমর্থন করে।
যেমন: স্বামী স্ত্রীকে বললো, ‘তোমার হাতের বিরিয়ানী পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু বিরিয়ানী, তুমি যে গরুর মাংস রান্না করো, আমি পৃথিবীর কোথাও এমন খাবার খাইনি’।
একটি সুন্দর মুহূর্তে স্বামী স্ত্রীকে বললো ‘তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে’।
এসব মিথ্যাকে ইসলাম ‘মিথ্যা’ বলে মনে করে না। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের জন্য প্রয়োজনে এমন মিথ্যা বলাকে ইসলাম অনুমতি দেয়। আপনি আপনার ছোট্ট ছেলে-মেয়ের প্রশংসা করেও এমন কিছু বলতে পারেন।
দুজন মানুষের মধ্যে যদি মন কষাকষি হয়, তাদেরকে একত্র করতে প্রয়োজনে মিথ্যা বলতে পারেন। যেমন: একজনকে বলতে পারেন, অমুক তো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে অনুতপ্ত, সে আমাকে বললো তোমার সাথে কথা বলতে চায়। আবার, অন্যজনকে গিয়ে বলুন, অমুক সেদিন যেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এটার জন্য পরে কষ্ট পেয়েছে। সে চাচ্ছে তোমার সাথে কথা বলতে। আসো, তার সাথে গিয়ে কথা বলি।
এসব ক্ষেত্রে মিথ্যা বলতে অসুবিধা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাকে অনুমোদন দিয়েছেন। সেগুলো হলো:
একজনের সাথে আরেকজনের মন কষাকষি মিটিয়ে দেবার সময়
যুদ্ধের সময়
স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার সম্পর্ক মজবুত করতে মিথ্যার আশ্রয় নিলে।
[মুসনাদে আহমাদ: ২৬৭৩১]
এখন প্রশ্ন হলো, সত্য বললে লাভ কী?
আপনি যখন সত্য বলবেন, সেই সত্য বলার মাধ্যমে নেকি অর্জন করবেন। আপনি যখন কিছু লিখবেন, সেটা যদি সঠিক হয় তাহলে আপনি নেকি অর্জন করবেন। আপনি সত্য বললে আপাতত আপনার কোনো ক্ষতি হলেও দীর্ঘকালীন এর সুবিধা ভোগ করবেন।
কা’ব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। তাবুক যুদ্ধে না যাবার অজুহাত দেখাতে কেউ কেউ যখন মিথ্যার আশ্রয় নেবার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তখন সত্যের ওপর অটল থাকেন। মিথ্যা বলায় অনেকের অজুহাত গ্রহণ করা হয়েছিলো, সত্য বলায় তিনি আপাতত বিপদে পড়েছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীতে তাঁর এই সত্যবাদিতা তাঁকে পুরস্কৃত করে। আল্লাহ তাঁর ঘটনা উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে কয়েকটি আয়াত নাযিল করেন।
[সহীহ বুখারী: ৪৪১৮]
আপনি যখন মনে করবেন আল্লাহ আপনাকে দেখছেন, তিনি আপনাকে শুনছেন, তখন আপনি সত্য বলতে পারবেন। কারণ, আপনি জানেন আর কেউ জানুক বা না জানুক, আল্লাহ জানেন প্রকৃত ঘটনা কী। আপনাকে আল্লাহ দেখছেন, ফেরেশতারা পর্যবেক্ষণ করছেন। আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয়ে আপনি মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। জীবনের যে পরিস্থিতি আসুক না কেনো।
আপনি যদি জান্নাতে যেতে চান, আল্লাহর প্রিয়ভাজন হতে চান, তাহলে সত্য কথা বলুন। কেননা, সত্যবাদীদের স্থান জান্নাতে, মিথ্যবাদীদের স্থান জাহান্নামে।