আসমাউল হুসনা – আল-মুসাউইর
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে আল-মুসাউইর — রূপদানকারী, আকৃতিদানকারী — নামে উল্লেখ করেছেন। তিনিই বিদ্যমান সমস্ত কিছুর গঠন ও আকৃতি দান করেন। আল-মুসাউইর সবকিছুকে তার নিজস্ব আকৃতি এবং চিত্তবৃত্তি বা প্রবণতা দিয়েছেন; সৃষ্টির বিশাল বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি প্রাণীই অনন্য!
মুসাউইর মূল এসেছে ص-و-ر থেকে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম প্রধান অর্থ হল কিছু ঝুঁকানো বা বাঁকানো, এবং দ্বিতীয় অর্থ হল কিছু গঠন বা রূপদান করা, ভাস্কর্য তৈরি করা, কল্পনা করা বা ছবি আঁকা। তৃতীয় অর্থ হল কোন কিছুর প্রতি প্রবণতা বা ঝোঁক থাকা।
এই মূলটি কুরআনে ১৯ বার পাঁচটি উদ্ভূত আকারে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল وَصَوَّرَكُمْ – ওয়াসওয়ারকুম (এবং তিনি আপনাকে আকৃতি দিয়েছেন), الصُّوۡرِ – আস-সূরি (“শিংগা”), এবং صُورَةٍ – সুরাতিন (“রূপ”)।
ভাষাগত দিক থেকে খালিক, বারি’ এবং মুসাউইর পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং স্রষ্টা হিসাবে আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জালকে নির্দেশ করে; আল-মুসাউইর স্রষ্টা আর বাকি সব সৃষ্টি। আল-মুসাউইর রূপ দান করেন কোন কিছুর অনুকরণে নয়; তিনি এর থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। আল-মুসাউইর বলেন, হও! এবং তা হয়ে যায়, তাঁরই মনোনীত রূপ এবং বৈশিষ্টে। তিনি যা চান তাই করেন, এবং যে আকৃতিতে এবং রূপে চান সেভাবেই সৃষ্টি করেন।
আল-মুসাউইর নিজেই বলেছেন –
هُوَ ٱللَّهُ ٱلْخَٰلِقُ ٱلْبَارِئُ ٱلْمُصَوِّرُ لَهُ ٱلْأَسْمَآءُ ٱلْحُسْنَىٰ তিনি আল্লাহ্, সৃজনকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, রূপদাতা, তাঁরই রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। [৫৯:২৪]
সূরা আল-হাশরে, আল-খালিক (স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা) এবং আল-বারির (প্রবর্তক) পরে আল-মুসাউইর’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু আলেম বলেছেন যে এই আয়াতে সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তা আল্লাহর সংকল্পের ওপর নির্ভর করে, তাই আল খালিক প্রথমে এসেছে। আল-বারি’ নাম দ্বারা আল্লাহ যা সৃষ্টি করতে চান তা নিয়ে আসার সৃজনশীল প্রক্রিয়াকে বোঝায়। পরিশেষে, আল-মুসাউইর নামটি প্রতিটি সৃষ্ট জিনিসকে তার নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। তাই আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন তা নির্ধারণ করেন, তারপর অস্তিত্বে আনেন, এবং পরিশেষে এর বিশেষ এবং অনন্য রূপ ও বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করেন।
আলেমগণ এই তিনটি নামের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এইভাবেও – তিনিই আল-খালিক যিনি নির্ধারিত গুণাবলী অনুসারে বিদ্যমান সমস্ত প্রাণীকে শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। আল-বারি’ মানুষকে আল-বারা অর্থাৎ মাটি থেকে তৈরি করেছেন। আল-মুসাউইর হলেন তিনি যিনি বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি সৃষ্টি করেন। সুতরাং আল-খালিক একটি সাধারণ শব্দ, আল-বারী’ আরও নির্দিষ্ট এবং আল-মুসাউবির আরও বেশি নির্দিষ্ট [কিতাব শারহ আসমা’আল্লাহ তা’আলা আল-হুসনা, ডঃ হিসাহ আল-সাগীর]।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন? আল-মুসাউইর আপনাকে যেভাবে গঠন করেছেন তাতে খুশি থাকুন। আমরা কসমেটিক সার্জারির যুগে বাস করছি; নিজের চেহারা বা অবয়ব পছন্দ না হলে চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে তা পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য আল্লাহর কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
هُوَ ٱلَّذِى يُصَوِّرُكُمْ فِى ٱلْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَآءُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়। [৩:৬]
আল-মুসাউইর তাঁর চূড়ান্ত জ্ঞান দ্বারা আপনাকে যেভাবে গঠন করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকুন। ধরুন, আমরা যদি ইউসুফের (আ:) মতো সুন্দর হতাম, তাহলে আমরা কি তাঁর মুখোমুখি হওয়া প্রলোভনগুলোকে প্রতিরোধ করতে পারতাম? যখন আপনি আয়নায় নিজেকে দেখেন, আলহামদুলিল্লাহ বলুন। যদি শয়তান আপনাকে আপনার চেহারার বা শরীরের কোন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অভিযোগ করতে প্রলুব্ধ করে, তবে যারা অন্ধ, অসুস্থ বা অক্ষম তাদের কথা স্মরণ করুন।
সুন্দর কোন আকৃতি দেখলে তা নিয়ে চিন্তা করুন। আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়াজল বলেন –
ثُمَّ خَلَقْنَا ٱلنُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا ٱلْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا ٱلْمُضْغَةَ عِظَٰمًا فَكَسَوْنَا ٱلْعِظَٰمَ لَحْمًا ثُمَّ أَنشَأْنَٰهُ خَلْقًا ءَاخَرَ فَتَبَارَكَ ٱللَّهُ أَحْسَنُ ٱلْخَٰلِقِينَ তারপর আমরা শুক্রকীটটিকে বানাই একটি রক্তপিন্ড, তারপর রক্তপিন্ডকে আমরা বানাই একটি মাংসের তাল, তারপর মাংসের তালে আমরা সৃষ্টি করি হাড়গোড়, তারপর হাড়গোড়কে আমরা ঢেকে দিই মাংসপেশী দিয়ে, তারপরে আমরা তাকে পরিণত করি অন্য এক সৃষ্টিতে। সেইজন্য আল্লাহ্রই অপার মহিমা, কত শ্রেষ্ঠ এই স্রষ্টা! [২৩:১৪]
আপনি আপনার চারপাশে যা কিছু দেখছেন তা আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ। আল-মুসাউইর ফুল, গাছ, ফল, এমনকি গরু এবং ভেড়া ইত্যাদির নকশা করেছেন খুব আকর্ষণীয় ভাবে। কাজেই আপনি যখনই সুন্দর কোন সৃষ্টি দেখেন, তখন আল-মুসাউইরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
আপনার অবস্থান সম্পর্কে জানুন। আল-মুসাউইর নিজেই বলেছেন –
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে। [৯৫:৪]
আল-মুসাউইর আমাদের প্রত্যেককে একটি বিশেষ মস্তিষ্ক, হৃদয়, চেহারা এবং অবয়বে গঠন করেছেন, যা আমাদের অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করে। কাজেই আপনি এগুলো কিভাবে ব্যবহার করবেন? কেয়ামতের দিন আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে — আপনি আপনার শ্রবণ, আপনার দৃষ্টি এবং আপনার হৃদয়কে কিভাবে ব্যবহার করেছেন? তাই যতটা সম্ভব ভাল কাজের জন্য এগুলো ব্যবহার করুন, এবং পাপের উদ্দেশ্যে, বা নিষিদ্ধ জায়গায় গিয়ে নিজের বা অন্যের ক্ষতি করার জন্য এগুলি ব্যবহার করবেন না।
আল-মুসাউইরের ইবাদত করুন, একমাত্র তিনিই ইবাদতের যোগ্য, আর সব তাঁর সৃষ্টি।
هَٰذَا خَلْقُ ٱللَّهِ فَأَرُونِى مَاذَا خَلَقَ ٱلَّذِينَ مِن دُونِهِۦ بَلِ ٱلظَّٰلِمُونَ فِى ضَلَٰلٍ مُّبِينٍ এইসব আল্লাহ্র সৃষ্টি! সুতরাং আমাকে দেখাও তো কী সৃষ্টি করতে পেরেছে তিনি ব্যতীত অন্যেরা। বস্তুত অন্যায়কারীরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। [৩১:১১]
এই আয়াতটি স্মরণ করুন যখন আপনি আল-মুসাউবিরের পরিবর্তে অন্য কাউকে সন্তুষ্ট করতে প্রলুব্ধ বোধ করেন।
আল-মুসাউইরের কাছে চাইতে থাকুন
أَوَلَيْسَ ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ بِقَٰدِرٍ عَلَىٰٓ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُم بَلَىٰ وَهُوَ ٱلْخَلَّٰقُ ٱلْعَلِيمُ আচ্ছা, যিনি মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হাঁ, বস্তুতঃ তিনিই তো মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞাতা। [৩৬:৮১]
إِنَّمَآ أَمْرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيْـًٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ যখন তিনি কোনো-কিছু ইচ্ছা করেন তখন তাঁর নির্দেশ হল যে তিনি সে-সন্বন্ধে শুধু বলেন -- ''হও’’, আর তা হয়ে যায়। [৩৬:৮২]
فَسُبْحَٰنَ ٱلَّذِى بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَىْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
সুতরাং সকল মহিমা তাঁরই যাঁর হাতে রয়েছে সমস্ত কিছুর শাসনভার, আর তাঁরই নিকট তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে।
[৩৬:৮৩]
আপনার চারপাশে যা কিছু দেখেতে পান, সবকিছুই আল-মুসাউইর নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। আপনার কি মনে হয় না আপনার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান তিনি করতে পারেন? সুতরাং আপনি যখন দু’আ করবেন তখন মনে রাখবেন, আল-মুসাউইরের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।
হে আল্লাহ, আল-মুসাউইর, আমরা জানি যে আপনিই সমগ্র সৃষ্টির রূপকার। আমাদের নিজেদের এবং চারপাশের রূপ ও আকৃতির জন্য আমাদেরকে শাকিরিন (কৃতজ্ঞদের) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাদের আপনার সৃষ্টিগুলি নিয়ে চিন্তা করার তৌফিক দান করুন।
আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি প্রয়োজনে যেন আপনার কাছে চাইতে পারি। আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা আপনার দেওয়া নেয়ামতগুলোকে ভালো কাজে ব্যবহার করে। হে আল্লাহ, আল-মুসাউইর আপনার সৃষ্ট জান্নাতের সুন্দর রূপের সাক্ষী আমাদের করুন, আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আল-মুসাউইর
Source: understandQuran