দরুদ শরীফে মুহাম্মদ সা. এর সাথে কেবল ইবরাহিম আ. এর নাম কেন
দরুদের মধ্যে কেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে অন্য নবী-রাসূলগণের মধ্যে কেবল ইবরাহিম আ. এর নাম বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে?
সালাতে তাশাহুদের বৈঠকে নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবারবর্গের পাশাপাশি তাঁর পূর্বপুরুষ ইবরাহিম ও তার পরিবার বর্গের প্রতিও দরুদ পেশ করা হয়। তাই এটি ‘দরুদে ইবরাহিম’ নামে সুপরিচিত।
আলেমগণ এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যথা:
১. ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বংশগতভাবে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সমগ্র আরবের ঊর্ধ্বতন পিতা। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এরপরে যত নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে সকলেই তাঁর বংশ থেকে এসেছে। তাই তাকে বলা হয় ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীদের পিতা।
সুতরাং তাঁর প্রতি এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সালাত পেশ করা হলে তার পরবর্তী সকল-নবী রাসূল তাতে শামিল হয়ে যায়। কারণ তারা সকলেই বংশগতভাবে তাঁর পরিবারভুক্ত।
তাই তো আসমানি কিতাব ধারী সকল ধর্ম তথা ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম-এ তিনটি মূল ধর্মের অনুসারীরাই তাঁর শরিয়তের উপর বিশ্বাস রাখে। সে কারণেই ইসলাম এবং তাওরাত-ইনজিলের অনুসারী ইহুদি ও খৃষ্টান ধর্মকে এককথায় ইবরাহিমিয় ধর্ম’ বা আবরাহামিয় ধর্ম [Abrahamic Religion]-যাকে সেমেটিক ধর্ম বা সেমিটিক ধর্মও বলা হয়। যদিও ইহুদি-খৃষ্টান ধর্ম পরবর্তীতে বিকৃতির শিকার হয়েছে।
২. সকল নবী-রাসূল সম্মানিত। কিন্তু বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী- যা তাকে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা তার অনেক মর্যাদা ও গুণাবলী উল্লেখ করেছেন।
সেগুলোর মধ্য অন্যতম হল: তিনি উলুল আযম তথা দৃঢ় সংকল্প ধারী পাঁচ জন নবী-রাসূলের অন্তর্ভুক্ত [দেখুন: সূরা আহকাফ এর ৩৫ নং আয়াতের তাফসির]
৩. ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন, তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও শিরক উৎখাতের এক মহান প্রাণপুরুষ।
মহান আল্লাহ তাআলা ইহুদি-খৃষ্টানদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁর প্রসঙ্গে বলেন,
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
“ইবরাহিম ইহুদি ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না কিন্তু তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ও আত্মসমর্পণকারী এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না।”
[সূরা আলে ইমরান: ৬৭]
৪. কুরআনে সকল নবী-রাসূলদের মধ্যে তাঁকে ‘তোমাদের পিতা’ বলে অভিহিত করে তার আদর্শকে অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
مِّلَّةَ أَبِيكُمۡ إِبۡرَٰهِيمَۚ
"তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাত (দীন ও আদর্শ অনুসরণ করো।"
[সূরা হিজর: ৭৮]
উল্লেখ্য যে, তিনি বংশগতভাবে আরবদের পিতা এবং মর্যাদার দিক দিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সকল তাওহীদ পন্থী মুমিনের পিতৃতুল্য।
আল্লাহ আরও বলেন,
ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
“অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহিমের দীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।”
[সূরা নহল: ১২৩]
তিনি আরও বলেন,
إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَٰذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا ۗ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ
“মানুষদের মধ্যে যারা ইবরাহিমের অনুসরণ করেছিল, তারা আর এই নবী এবং যারা এ নবীর প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইবরাহিমের ঘনিষ্ঠতম-আর আল্লাহ হলেন, মুমিনদের অভিভাবক।”
[সূরা আলে ইমরান: ৬৮]
৫. তিনি শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাঁর ব্যাপারে বলেন,
وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۗ وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا
“যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহিমের আদর্শের অনুসরণ করে- যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন-তার চাইতে উত্তম আদর্শ কার? আর আল্লাহ ইবরাহিমকে খলিল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) রূপে গ্রহণ করেছেন।”
[সূরা নিসা: ১২৫]
ইবনে কাসির রাহ. বলেন,
ولا خلاف أن محمدا صلى الله عليه وسلم أفضلهم، ثم بعده إبراهيم، ثم موسى على المشهور. اهـ.
“সকল নবী-রাসূলদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। তবে প্রসিদ্ধ মতানুসারে এর পরেই ইবরাহিম আ., অত:পর মুসা আ. এর অবস্থান।” [তাফসিরে ইবনে কাসির]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি হানাফি রাহ. এর অন্য একটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হল, সালাতে দরুদ পাঠের সময় ইবরাহিম আলাইহিস সালামের এর নাম এ জন্যই উল্লেখ করা হয় যে, মিরাজ রজনীতে যখন নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঊর্ধ্বাকাশ ভ্রমণ করেন তখন পথিমধ্যে যত নবী-রাসূলের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটেছিলো তাদের মধ্যে একমাত্র ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এই উম্মতের প্রতি সালাম পেশ করেছিলেন। তার প্রতিদান হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত মুমিনগণ তার প্রতি দরুদ পাঠে নির্দেশিত হয়। [শারহে সুনানে আবু দাউদ লিল আইনি ৪/২৬০]
لأن النبي عليه السلام رأى ليلة المعراج جميع الأنبياء والمرسلين ، وسلم على كل نبي ، ولم يسلم أحد منهم على أمته غير إبراهيم عليه السلام ، فأمرنا النبي عليه السلام أن نصلي عليه في آخر كل صلاة إلى يوم القيامة ، مجازاة على إحسانه
شرح سنن أبي داود” للعيني (4/260) .
আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. বলেন,
قد خُصَّ بأنه أبو الأنبياء ، وأنه صاحب الحنيفية ، وأمرنا باتباعه ؛ لأننا نحن أولى بإبراهيم
“নবীদের মাঝে তাঁকে (ইবারাহিম আ. কে) বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল, তিনি নবীদের পিতা, একনিষ্ঠ তাওহীদ অভিমূখী ও শিরক বিমুখ। আর আমরা তাঁকে অনুসরণের নির্দেশ প্রাপ্ত। কারণ আমরাই ইবারাহিম এর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ।”
[আল লিকাউশ শাহরি (মাসিক সভা)-১৮৯, প্রশ্ন নং ৭]
আল্লাহু আলাম।