গোপন পাপ
গোপন পাপ: একুশ শতকের অগ্নিপরীক্ষা
একুশ শতকে পাপের রাস্তা এতো সহজ হয়েছে যে, পাপ করাটা এখন সাদামাটা। পাপ করতে চাইলে মুহূর্তের মধ্যে পাপ করা যায়। একটা সময় ছিলো, যখন পাপ করতে হলে আপনাকে সুযোগ খুঁজতে হতো। আর এখন আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সুযোগ বের করতে হয়।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“হে ঈমানদারগণ! অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন শিকারের এমন বস্তু দ্বারা তোমাদের হাত ও বর্শা যার নাগাল পায়; যাতে তিনি বুঝতে পারেন, কে তাঁকে না দেখেও ভয় পায়। এরপর যে সীমালঙ্গন করে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।”
[সূরা মায়িদাহ ৫: ৯৪]
এই আয়াত নাযিলের একটি প্রেক্ষাপট আছে। সাহাবীরা যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় একত্রিত হোন, তখন তারা উমরাহর নিয়তে ইহরাম পরে গিয়েছিলেন। তাঁদের আশেপাশে বন্য জন্তু, পাখি জড়ো হয়েছিলো। তারা চাইলেই সেগুলো শিকার করতে পারতেন। সেইসময় তাঁদের ক্ষুধা আর চোখের সামনে এতো সুস্বাদু খাবারের কথা চিন্তা করুন!
কিন্তু, আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, তারা যেনো সেগুলো শিকার না করে। এই অবস্থায় শিকার করা তাঁদের জন্য বৈধ না। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আল্লাহ দেখতে চান, তারা আল্লাহর বিধান মানেন কিনা। শেষে দেখা গেলো, সাহাবীরা আল্লাহর বিধান আঁকড়ে ধরেন। আল্লাহর অবাধ্য হোননি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইহরাম অবস্থায় পশু শিকার করেননি।
আজ থেকে দশ বছর আগে পাপ করাটা অনেকাংশে আমাদের হাতের নাগালে ছিলো না। এখন পাপ করা কুরআনের সেই আয়াত অনুসারে আমাদের হাতের নাগালে। আমরা মোবাইল বের করলেই পাপে লিপ্ত হতে পারি, ল্যাপটপের উইন্ডোজ অন হতেই পাপে লিপ্ত হতে পারি। পাপের কাজ দেখতে পারি, পাপের কথা শুনতে পারি।
আজ থেকে ২০ বছর আগে একজন ছেলে একজন মেয়ের সাথে কথা বলা এতো সহজ ছিলো না। অনেক কাঠখড় পুড়াতে হতো। এখন মোবাইলে কয়েকটি ক্লিকের ব্যাপার। টাকা দিয়ে ফোন করা লাগে না, ম্যাসেজ করলেই হয়। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে কল দেয়া যায়। খরচও তেমন লাগে না। ওয়াইফাই থাকলে তো আর কথাই নেই!
এমনসব ছবি বা ভিডিও দেখা হয়, যা মানুষের অন্তরকে পুড়ে ফেলে। ইন্টারনেটের অবাধ সাগরে সবাই সাঁতরাচ্ছে, কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।
পাপ করার সুযোগ যখন হাতের কাছে, আল্লাহর অবাধ্য হবার সুযোগ যখন হাতের নাগালে, তখন আমরা সেটাকে কিভাবে ব্যবহার করছি?
আমরা কি সাহাবীদের মতো আচরণ করছি, নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে পাপে লিপ্ত হচ্ছি?
ফিতনা এখন আমাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে, আমাদের হাতের মুঠোয় ফিতনা। এর দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে কী পরীক্ষা করতে চান?
আল্লাহ আমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান- ‘যাতে তিনি বুঝতে পারেন, কে তাঁকে না দেখেও ভয় পায়’।
মোবাইল হাতে নিয়ে বন্ধ ঘরে মনে করছি কেউ আমাদেরকে দেখছে না, কেউ আমাদেরকে শুনছে না। অথচ আমরা ভুলেই যাচ্ছি, আল্লাহ আমাদেরকে দেখছেন। যেই অবস্থায় আমরা পাপে লিপ্ত, সেই অবস্থায় পর্যন্ত আল্লাহ আমাদেরকে দেখছেন।
একজন সালাফ বলেন:
“দরজা বন্ধ করে পাপ করার সময় দরজার ওপাশে শব্দ শুনে আপনি পাপ করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারমানে বন্ধ দরজায় আপনি আল্লাহকে ভয় না করে ভয় করছেন দরজার ওপাশের কাউকে!”
একজন বলেন, আমি দরজা বন্ধ করে পাপ কাজ লিপ্ত হলাম। দরজার বাইরের শব্দ শুনে ল্যাপটপ বন্ধ করে দরজা খুললাম। খুলে দেখি সেটা একটা বিড়াল!
আমাদের মনে আল্লাহর ভয় এতোটাই কমে গেছে যে, সামান্য একটা বিড়ালকে আমরা ভয় পাচ্ছি!
কেউ কেউ জনসম্মুখে ‘আল্লাহওয়ালা’ কিন্তু গোপনে পাপের সাগরে ডুবে আছেন। ৬০-৭০ বছর বয়স ধরে এমন দুমুখো মুখোশ পরে সমাজে আছেন। সবার সামনে যখন হাজির হোন, তখন তার এক রূপ। দরজা বন্ধ করলে আরেক রূপ। কিয়ামতের দিন তার এমন মুখোশ উন্মোচিত হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমলসহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন।”
অর্থাৎ, তাদের নেক আমল ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না।
সাহাবীরা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের পরিচয় আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করুন, যাতে আমরা অজ্ঞাতসারে তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
“তারা তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতো ইবাদাত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে।”
[সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২৪৫]
আজকের যুগে পাপের সুযোগ আমাদের হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সকল মানুষের জন্য এমন সুযোগ আগে কখনো ছিলো না। এই ফিতনায় আমরা সবাই আছি। দ্বীন সম্পর্কে গাফেল থেকে শুরু করে আলেম পর্যন্ত। কেউই এর থেকে রেহাই পায়নি। এখন দেখার বিষয় পরীক্ষায় কারা উত্তীর্ণ হয়।
এমন সময়ে যারা আল্লাহর প্রিয় হতে পারবে, তারা সত্যিকারার্থে আল্লাহর প্রিয়। তারা সকল বাধা উপেক্ষা করে আল্লাহর প্রিয় হবে। তারা পাপের সমস্ত সুযোগ ত্যাগ করে আল্লাহকে ভয় করবে।
কিভাবে আমরা নিজেদেরকে এমন গোপন পাপ থেকে বাঁচাতে পারি?
আমি তিনটি উপায় বলবো:
১। ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ এই ভয় সর্বদা মনের মধ্যে থাকা।
আপনি যেই অবস্থায় থাকুন না কেনো, জনসমক্ষে থাকুন বা নির্জনে থাকুন; শুধু এতোটুকু মনে রাখুন যে, আল্লাহ আপনাকে দেখছেন। মানুষের মনে এই বোধটা যদি থাকে, তাহলে মানুষ গোপনে বা প্রকাশ্যে পাপে লিপ্ত হতে পারে না। ইমাম আশ-শানকিতী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“মানুষকে পাপ থেকে বাঁচাতে পারে একটি জিনিস। সমস্ত আলেমগণ এই ব্যাপারে একমত। আর সেটা হলো- মনে আল্লাহর এই ভয়, আল্লাহ আমাকে দেখছেন।”
২। মনোযোগের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করা।
আপনি যদি গভীর মনোযোগের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করেন, এই তেলাওয়াত আপনাকে পাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। আপনি কুরআনের অর্থ বুঝে বুঝে তেলাওয়াত করলে আল্লাহর ভয়ে আপনার অন্তর গলবে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কুরআন তেলাওয়াত আপনাকে সমস্ত পাপ থেকে দূরে রাখবে; তা না হলেও অন্তত কিছু পাপ থেকে দূরে রাখবে।
৩। গোপন ইবাদাত।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“মানুষ গোপনে যে পাপ করে, সেটার কারণে সে বিপথগামী হয়। অন্যদিকে, গোপনে যে নেক আমল করে, সেটার কারণে সে সুপথপ্রাপ্ত হয়।”
আপনি গোপনে নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত করা, রোজা রাখা, দান করা বাড়িয়ে দিন। দেখবেন আস্তে আস্তে গোপন পাপ থেকে মুক্তি পাবেন।
উস্তাদ আলী হাম্মুদার লেকচার অবলম্বনে প্রকাশিতব্য ‘সফলতার সূত্র’ বই থেকে। প্রকাশনী পরবর্তীতে জানানো হবে।