পাত্তা না পাওয়া এক বন্ধুর কাহিনী
দুই বন্ধুু আরিফ এবং জহির। ভার্সিটি বন্ধ থাকলে জহির প্রায়ই আরিফের বাসায় বেড়াতে আসে। দুজনের-ই পরিচয় হয় ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টার থেকেই। কিন্তু তাদের অন্তরঙ্গতা দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, তাদের পরিচয় কেবলমাত্র দু’বছরের।
জহির একটু খেলাপ্রেমী মানুষ। একটু সুযোগ পেলেই খেলা নিয়ে কথা বলা শুরু করে দেয়।কোন দেশের কোন ক্রিকেটারের কী নাম,কে কোন পজিসনে ব্যাট করে, কার কতোটি সেঞ্চুরি রয়েছে ইত্যাদি সমস্ত পরিসংখ্যান যেনো তার নখদর্পনে। কিন্তু ইদানীং তার মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মসজিদেও নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি ইউটিউবে বেশ কিছুু ওয়াজ-লেকচার শুনায় এবং নিয়মিত ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ায় তার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।অন্তরে আল্লাহর ভয় ঢুকে গেছে।তাই এখন আর সে আগের মতো খেলার দিকে মনোযোগী নয়।
অন্যদিকে, আরিফ খেলাপ্রমী না হলেও সিনেমা দেখা তিনি কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না। ভার্সিটি বন্ধ থাকলেই দিন-রাত মুভি আর মুভি নিয়েই ব্যস্ত। কিভাবে দিন-রাত পার হয় এসবের কোনই খোঁজ থাকে না। আর থাকবেই বা কেনো!বড়ো লোক মা-বাবার আদরের সন্তান বলে কথা।
যাইহোক,পূর্বের কথা অনুযায়ী,জহির সন্ধ্যার দিকে আরিফের বাসায় আসলো। দু’জনেই চা খেতে খেতে গল্প করছিল। কিন্তু এবার আর জহিরের মুখ থেকে খেলার কোন শব্দ শোনা গেল না। অপরদিকে, আরিফও গতরাতের দেখা অ্যাকশন মুভি নিয়ে কথা বলা শুরু করলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি। কারণ জহিরের মধ্যে আল্লাহভীতি চলে আসায় সে আর এসব শুনতে আগ্রহী নয়। আর ইতোমধ্যে আরিফও তার বন্ধুর পরিবর্তন বুঝতে পেরেছে। তাই সেও এসব মুভি নিয়ে কথা আর বাড়ালো না।বরং অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলো।
আরিফ বলল, বন্ধু,অনেকদিন ধরেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। চল! এবারের ভেকেশনে একটু শিলং ঘুরে আসি। খুব অপরূপ জায়গা।
–হ্যাঁ,ঠিকই বলেছিস। আমার কাজিনরা গতো মাসে গিয়ে এসেছে। তাদের তুলা সেখানকার কিছু অসাধারণ ছবি দেখে আমিও সেখানে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। তাই আমিও মনে মনে সেখানে যাওয়ার কথা ভাবছি।
–আচ্ছা,বলতো জহির! সেখানে গেলে আমাদের কেমন খরচ হতে পারে? তোর কাজিনদের কাছ থেকে কি এ ব্যাপারে কিছু জেনেছিস?
ঠিক এমন সময় হঠাৎ দরজায় ঠক… ঠক…শব্দ বেজে উঠলো।
কে? জিজ্ঞেস করলো আরিফ।
–আমি রাহাত বলছি!দোস্ত,দরজটা একটু খোল না।
–ও,রাহাত বলছিস! দাঁড়া খুলছি। এই অসময়ে! ফোন দিয়ে আসলে না যে?
–দোস্ত, একটু বিপদে পড়ে এসেছি। তাই বলার আর সময় পাই নি। তাছাড়া, তুই তো এই সময়ে ঘরেই থাকিস।তাই ভাবলাম সরাসরি বাসায় গেলেই হয়তো তোকে পাবো।
–আয়,ভেতরে আয়! তারপর সব শুনব।
ভিতরে আসার পর জহির জানতে চাইলো, উনি কে?
আরিফ রাহাতের দিকে হাত দেখিয়ে বলল,ও আমার বাল্যবন্ধু,রাহাত।আমরা একসাথেই স্কুল-কলেজে ছিলাম। এখন সে ডিগ্রি করছে। দাঁড়া! রাহাতের সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দেই। জহিরকে দেখিয়ে বলল, ও হচ্ছে আমার বন্ধু, জহির। আমরা একসাথেই অনার্স করছি।
পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর, আরিফ রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলল, কী এমন বিপদ হয়েছে বল তো দেখি? তাছাড়া,তোকে বেশ পেরেশানিই লাগছে।
–রাহাত একটু আমতা আমতা করতে লাগলো যেনো জহির সামনে থাকায় তার কথাগুলো বলতে লজ্জা হচ্ছে।
জহির টের পেয়ে বললো, তাহলে আজ উঠি রে, তোরা কথা বল। অন্যদিন দেখা হবে। ইন শা আল্লাহ! এই বলে সে উঠতে চাইলো।
তা দেখে রাহাত বলল, না! না! ভাই। আপনি চলে যাবেন কেনো? আপনি বসেন। আমিই একটু পর চলে যাচ্ছি।
রাহাতের এমন অনুরোধের পর জহির আর যেতে পারলো না। তাই সে বসে পড়লো।
তারপর রাহাত বলল,আসলে হয়েছে কি দোস্ত! তুই তো জানিস-ই দোস্ত,আমাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। আমাকে কলেজে থাকা অবস্থা থেকেই টিউশনির টাকা দিয়ে নিজে চলার পাশাপাশি পরিবারেরও কিছু খরচ বহন করতে হয়। আর বাবাও অফিস থেকে যা আয় করেন তা দিয়ে আমাদের এই পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ ঠিকমতো চলে না। তার উপর এখন আমার মায়ের অবস্থা…….!
পুরো কথাটি শেষ করতে না দিয়েই রাহাতের কথার মধ্যেই আরিফ তার কথা বলা শুরু করে দিয়ে বলল, ওহ, আচ্ছা,বুঝেছি তাহলে!
দেখ রাহাত, আমিও কলেজ জীবনে টিউশনি করে পরিবারে অবদান রেখেছি। আসলে, এসব আর্থিক সমস্যা নিয়েই মানুষের জীবন।আমিও জীবনে কতো আর্থিক সমস্যায় পড়েছি। একদিন আমাদের অবস্থাও খুব করুণ ছিল। তখন আজকের মতো বাবার এতো সম্পদ ছিল না। অনেক কষ্ট করেই বাবা এসব কিছু গড়েছেন। কষ্ট করেছি বিধায় আজকে আমাদের অবস্থান…..!
হ্যালো, ভাইয়া! মা-র অবস্থা বেশি ভালো না। এখনি ডাক্তারে নিতে হবে। তুমি কোথায় আছো? তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। বাবাও অফিস থেকে এখন অবধি বাসায় ফিরেন নি। এভাবেই হঠাৎ বেজে ওঠা ফোন ধরে বোনের কাছ থেকে কথাগুলো শুনছিল রাহাত।তাই তাকে তার বলতে চাওয়া কথাগুলো অসমাপ্ত রেখেই চলে আসতে হলো!
এদিকে, জহির এতোক্ষণ সব শুনেই যাচ্ছিল।কিন্তু কিছু বলতে পারছিল না। আর এবার জহির কিছু বলবে বলে তার শরীরী ভাষা থেকে আঁচ করা যাচ্ছে।
–ধুর,আমাদের আজকের আড্ডাটাই বৃথা গেলো। সেও আসার আর সময় পেলো না-একটু বিরক্ত স্বরেই বলল আরিফ।
–জহির বলল,বন্ধু!তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
–কী কথা?
–কাজটি কিন্তু তুই একদমই ঠিক করিস নি।
–কেনো?কী হয়েছে?আমি আবার কী করলাম?
–তুই যা করেছিস তা আমার আজকের রাতের ঘুম নষ্ট হওয়ার জন্যই যথেষ্ট। একজন মানুষ বড়ো অসহায় হয়ে তোর কাছে তার কিছু কথা বলতে চাইলো আর তুই কিনা তা না শুনেই একদম উড়িয়ে দিলে। বাহ! এই বুঝি তোর উদারতা। আরে, হয়তো সে তার মায়ের অবস্থার কথা বলে কিছু সাহায্যের কথা বলতো। কিন্তু তুই তো তার কথা শেষ করতেই দিলে না, বুঝার চেষ্টাই করলি না। তার পুরো কথা তো শুনিস-ই নাই বরং তার কথার মাঝখানে তুই তোর নিজের কথা বলা শুরু করে দিলে। এ তোর কেমন আচরণ?
আরে! একজন মানুষকে সাহায্য করতে পারবি না ভালো কথা!অন্তত তার কথা তো তুই শুনবি রে ভাই। কথা শুনতে তো আর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মনে রাখিস, মনোযোগ দিয়ে মানুষের কথা শুনতে পারা তথা আদর্শ শ্রোতা হতে পারা অনেক বড়ো একটি গুণ।এই গুণটি মানুষের নিকট প্রিয় করে তুলে, মানুষকে অনেক মর্যাদাবান করে তুলে। আর সেই গুণটি তোর কাছে নেই বলেই আজ আমাকে এমন অপ্রত্যাশিত আচরণ দেখতে হলো।
বিখ্যাত লেখক Stephen R Covey যথার্থই বলেছেন যে, Most people do not listen with the intent to understand. Most people listen with the intent to reply.
উনার এমন উক্তিই যেনো তোর মধ্যে প্রতিফলিত হলো। দেখ, মহান আল্লাহ তা’য়ালা কাউকে সাহায্য করার মতো তোকে যথেষ্ট তাওফিকও দিয়েছেন। ফলে তাকে সাহায্য করা তোর জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। সত্যি বলতে কি, কোনো দুঃখী মানুষের দুঃখ গুরত্ব দিয়ে শুনলেও তাকে এক ধরণের সাহায্যে বা উপকার করা হয়ে যায়।কারণ তাতে তার দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব হয়। নিজেকে হালকা অনুভব করতে পারে। কিন্তু তুই তার দুঃখটাই শুনলি না বরং এড়িয়ে গেলে। আর এখানেই যতো দুঃখ রয়ে গেলো।
তোর উচিত ছিল তাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে না পারলেও অন্তত তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে সান্ত্বনা দেওয়া এবং সমস্যা সমাধান হতে পারে এমন কিছু পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু তুই কেমন জানি পাত্তাই দেস নি যা আমার হৃদয়কে খুবই ব্যাথিত করেছে। একটিবার ভেবে দেখ তো, আজ যদি তুই তার জায়গায় থাকতে তবে তোর কেমন লাগতো? কেমন লাগতো যদি তুই কারো কাছ থেকে তোর দুঃসময়ে এরকম অবহেলাপূর্ণ এবং পাত্তাহীন আচরণ পেতে?
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন,যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’
[সহীহ বুখারী,হাদীস নং :১৭৩২]
তুই কি চাস না, আল্লাহ তোর প্রতি দয়া করুন? আল্লাহর দয়া পেতে হলে আল্লাহর বান্দাকেও দয়া করতে হয়, তাদের বিপদ আপদে অন্তত সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে হলেও পাশে থাকতে হয়। এটাই একজন ঈমানদারের দায়িত্ব।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার একশ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’
[সহীহ মুসলিম,হাদীস নং : ২৫৬৬]
সুবহান’আল্লাহ! পরকালের মতো জায়গায় আল্লাহ তার বান্দার একশ প্রয়োজন মিটিয়ে দিবেন-এটা তো চাট্টিখানি কথা নয়।পরকালেই এমন বিষয়ের গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। তখন আর আফসোস করেও লাভ হবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেন,
‘আল্লাহ তা’য়ালা বান্দার সাহায্যে ততোক্ষণ থাকেন, যতোক্ষণ সে অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’
[সহীহ মুসলিম,হাদীস নং : ২৩১৪]
এখন, আমরা যদি চাই,আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সাহায্য করতেই থাকুন তাহলে আমাদেরকেও মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে তৎপর থাকতে হবে। আর সেই সাহায্য কমপক্ষে সুন্দর একটি পরামর্শ দিয়ে হলেও করতে হবে। এমন বিষয়ও পরকালীন জীবনে অনেক কাজে দিবে। সেজন্য কারো সাথে এমন কোনো আচরণ করতে নেই যে আচরণে পাত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ পায়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
যে ব্যক্তি তার মু’মিন ভাইকে তার বিপদে সান্ত্বনা দিবে আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরাবেন।
[সুনানে ইবনে মাজাহ,হাদীস নং: ১৬০১]
চিন্তা করেছিস, টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করার কথা বলেন নি কেবল সান্ত্বনা দিলেই আল্লাহ তা’য়ালা সম্মানের পোশাক পরাবেন। সুবহান’আল্লাহ! অথচ কাউকে কমপক্ষে সান্ত্বনা দেওয়া কতোই-না সহজ একটি আমল। আর এই আমলটাই কিনা আমাদের নিকট অবহেলিত। আফসোস!
আরে, দুনিয়ায় সামান্য কোনো প্রধানমন্ত্রীও যদি কোনো কাজের বিনিময়ে সম্মানের পোশাক পরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন তবে কি তুই সে কাজ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না? তখন কি তোর মধ্যে অন্য রকম তাগিদ কাজ করবে না?
আর দুনিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী যদি তোকে কোনো পোশাক পরিয়ে দেন তবে তাতেই তো তুই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বে, নিজেকে অনেক সম্মানিত বোধ করবে।তাই না? অথচ যেখানে আল্লাহ তা’য়ালা সম্মানের পোশাক পরাবেন সেটা কতোটা সম্মানের বিষয়, কতোটা গর্বের বিষয় হবে-তা কি তুই উপলব্ধি করতে পারছিস?
আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,
আল্লাহর পথে অর্থ সম্পদ ব্যয় করো,(অর্থ সম্পদ আঁকড়ে ধরে) নিজেদের হাতেই নিজেদের ধ্বংসের অতলে নিক্ষেপ করো না এবং তোমরা (অন্য মানুষদের সাথে দয়া) অনুগ্রহ করো, অবশ্যই আল্লাহ তা’য়ালা অনুগ্রহকারী ব্যক্তিদের ভালোবাসেন।
[সূরা আল বাকারা,আয়াত নং: ১৯৫]
অতএব,আল্লাহ তা’য়ালার ভালোবাসা পেতে হলে মানুষকে দয়া করতে হবে। আর মানুষের সাথে সুন্দর করে হাসি মুখে কথা বলা, মানুষকে গুরুত্ব দেওয়া,মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা ইত্যাদি মানুষকে দয়া করারই শামিল।
কোরআন হাদীসের আলোকে জহিরের এমন বাস্তব কথা শুনে আরিফ বুঝতে পারলো যে, সে আসলে কাজটি মোটেও ঠিক করে নি। তাই সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,
–সরি,বন্ধুুুু! আমার আসলে এরকম আচরণ করা একদমই ঠিক হয়নি। আমি আসলে তখন বুঝতে পারি নি। আর এমন বিষয়ের এতো ফযীলতও আমার জানা ছিল না। আমি আসলেই সরি!
–শুধু ঠিক হয়নি বা সরি বললে হবে না। এক্ষুণি রাহাতকে ফোন দিয়ে তার মায়ের অবস্থা জিজ্ঞেস করো মিয়া!
তারপর রাহাতের ফোন নাম্বারে ডায়াল করলে ঠুঠ..ঠুঠ..করে ফোন রিং করছে। একবার, দুবার, তিনবার ফোন দিয়েও রাহাতের ফোন রিসিভ হয়নি। তাহলে কি রাহাত আমার উপর অভিমান করেছে চিন্তিত মনে ভাবতে লাগলো আরিফ!
কিছুক্ষণ পর….
এই আরিফ,তোর ফোন বাজছে।রিসিভ কর।রাহাত বোধ হয় ব্যাক করেছে। চিন্তিত চাহনিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা আরিফকে বলল জহির।
ফোন রিসিভ করতেই রাহাতের আদ্র কন্ঠে শুনা গেলো,দোস্ত,কল দিয়েছিলে?
–হ্যাঁ,দোস্ত!আন্টির অবস্থা কী যেনো বলতে চেয়েছিলে?
–দোস্ত,আমার মা আর নেই রে!হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই মা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন।
এমন দুঃসংবাদ শুনে পাত্তাহীন আচরণ করা আরিফ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। চোখের জলকেও আর আটকে রাখতে পারলো না।অবশেষে কিছু বলার ভাষা না পেয়ে ফোন রেখে দিতে চাইলে পাশে থাকা জহির তার হাত থেকে ফোন নিয়ে মৃত্যুর কথা শুনে ইন্নালিল্লাহি…..বলে রাহাতকে সান্ত্বনা দিলো।
ফোন রেখে দেওয়ার পর আরিফের দিকে লক্ষ্য করে জহির আবারও বলতে শুরু করলো,
বুঝলি,বন্ধু! মানুষের দুঃখ-কষ্ট,বিপদ-আপদ এগুলো কিছুই থাকে না।কেবল থেকে যায় বিপদের মুহুর্তে পাওয়া মানুষের আচরণসমূহ।এগুলো অন্তরে গেঁথে রয়ে যায় এবং সময়ে সময়ে যন্ত্রণাও দেয়।
বিপদের সময় বড়ো কঠিন এক সময়।এ সময় মানুষ এমনিতেই অনেক নার্ভাস থাকে, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে।কী করবে না করবে তা ভেবে পায় না।তার উপর আর্থিক দূর্বলতা থাকলে তো আর কথাই নেই।বড়ো পেরেশানি নিয়ে চলতে হয়।আর তখন যদি কেউ বিপদগ্রস্তের সাথে পাত্তাহীন আচরণ করে তবে সে কষ্টের আর অন্ত থাকে না।
এই তো,রাহাত তার যে দুঃখের কথা তোকে বলতে এসেছিল সেই দুঃখ কিন্তু বেশীক্ষণ থাকে নি।তার মা-ই তাকে সেই দুঃখ করা থেকে মুক্তি দিয়ে গেছেন।কেবল থেকে গেলো তার দুঃসময়ে তার প্রতি তোর পাত্তাহীন আচরণ।
তুই রাহাতকে সাহায্য করলেও সে হয়তো তার মাকে ফিরে পেতো না।কিন্তু ঐ সাহায্যের কথা তার আজীবন মনে থাকতো।এমনকি তার কথাগুলো শুনে তাকে কিছু সান্ত্বনামূলক কথা বললেও মনে একটি ভরসা নিয়ে যেতে পারতো। বিপদের সময় মানুষ সবচেয়ে বেশি কী খোঁজে জানিস?
মানুষ খোঁজে ভরসার জায়গা। মানুষ চায় তখন যদি তাকে কেউ এসে সান্ত্বনা দিতো,তখন যদি তার পাশে এসে কেউ দাঁড়াতো তবে তার বিপদের অনেকখানিই লাঘব হয়ে যেতো কিংবা হালকা মনে হতো।
মানুষকে কখনো কোনোভাবে সাহায্য করতে না পারলেও অন্তত তার কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনার চেষ্টা করিস।কারো কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনলে তখন তার ভরসার জায়গা থাকবে।অন্যথায়,তার জমিয়ে থাকা কষ্টের সাথে নতুন করে আরও কষ্ট যোগ হবে।আর শুধু শুধু অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে কি কোনো লাভ আছে,বল? নিশ্চয়ই না!সুতরাং কখনও কোনো মানুষের সাথে এমন পাত্তাহীন এবং অবহেলাপূর্ণ আচরণ করিস না।
আর কখনো কেউ কিছু বলতে শুরু করলে কথার মাঝখানে নিজের কথা বা অন্যে যে কোনো কথা বলা শুরু করে দিস না।এটা খুবই জঘন্য একটি অভ্যাস।কারো চোখে খারাপ হওয়ার জন্য এমন অভ্যাসই যথেষ্ট। একজনের কথার মাঝখানে কথা বলা শুরু করলে তাতে সে মানুষটি তার বলতে চাওয়া কথাগুলো বা কষ্টের কথাগুলো বলতে না পারার এবং তোমার কাছে তার কথাগুলো শুনার গুরুত্ব না পাওয়ায় আরও কষ্টে ভুগবে। অন্যের কাছে নিজেকে মূল্যহীন মনে করবে।ফলে হতাশা আরও বাড়বে। এমনকি অন্য কোনো সময় তার কষ্টগুলো তোমাকে বলার ভরসা হারিয়ে ফেলবে। কাজেই,কোনো মানুষ যেনো আমাদের কারো কাছ থেকে এমন পাত্তাহীন আচরণের স্বীকার না হয়।আমরা যেনো এ ব্যাপারে সচেতন থাকি।
শোন, এবার তোকে একটি ঘটনা বলি।একবার এক লোক মসজিদে রাসূল (সাঃ) এর নিকট এসে তার কিছু কথা বলছিল।কথা বলতে বলতে ইকামতের সময় হয়ে গিয়েছিল।এদিকে সাহাবী কেরাম রাসূল (সাঃ) এর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ঐ লোকটি কথা বলতেই থাকলো। রাসূল (সাঃ) ইকামাতের সময় হয়ে গিয়েছে জেনেও তিনি নিজে থেকে ঐ লোকটিকে থামিয়ে না দিয়ে বরং তার কথাগুলো শুনতেই থাকলেন।
এভাবে ঐ লোকটির কথা শেষ করার আগ পর্যন্ত তিনি তার কথাগুলো গুরুত্ব সহকারে শুনে গেলেন। ফলে কিছুটা দেরিতে ইকামাত শুরু হয়েছিল। মোটকথা, তিনি চাচ্ছিলেন ঐ লোকটিই যেনো তার পুরো কথা বলা শেষ করে নেয়। সে যেনো নিজে থেকেই তার কথার সমাপ্তি ঘটায় যাতে করে তার পুরো কথা শেষ করতে না পারার কোনো কষ্ট বা আক্ষেপ না থাকে। তাই তিনি তাকে ঐ অবস্থায়ও থামাতে চান নি। আর এ থেকেই স্পষ্ঠভাবে প্রতীয়মান হয় যে,রাসূল (সাঃ) কতোটা বিনয়ী ছিলেন, মানুষকে কতোটা গুরুত্ব তথা পাত্তা দিতেন, কতোটা গুরুত্ব দিয়ে মানুষের কথাগুলো শুনতেন। আর সেই রাসূল (সাঃ) এর উম্মত হয়েও আমরা কিনা মানুষকে পাত্তাই দিতে চাই না।
বন্ধুর কথাগুলো শুনে আরিফের মধ্যে তীব্র অপরাধ বোধ জাগ্রত হলো। রাসূল (সাঃ) এর ঐ ঘটনা জেনে তার মনে এই হিসেবে খুব খারাপ লাগছিল যে, সে তার বন্ধুর সাথে রাসূল (সাঃ) এর মতো ঐ ধরণের আচরণ করতে পারি নি। ফলে কিছুতেই যেনো সে তার বন্ধুর সাথে করা নিজের পাত্তাহীন আচরণের কথা ভুলতে পারছে না। আজ সে অনুতপ্ত, বড়ো বেশি অনুতপ্ত।
এদিকে জহির ইতোমধ্যে আরিফের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে রাহাতকে ফোন করে জানাযার সময় জেনে নিয়েছে। কাল সকালে জানাযা হবে। জহির বলল,এখন চল আরিফ,আমরা রাহাতের বাসায় গিয়ে তাকে একটু দেখে আসি।
কিছু কথাঃ
গল্পের আরিফ শেষ পর্যন্ত তার পাত্তাহীন আচরণের কথা বুঝতে পেরেছিল বটে, হয়েছিল অনুতপ্তও। কিন্তু আমরা যারা মানুষের সাথে আরিফের মতো আচরণ করি তারা কি নিজেদের পাত্তাহীন আচরণের কথা বুঝতে পারছি? নাকি রাহাতের অবস্থার মতো কেউ সম্মুখীন হওয়ার পর বুঝতে পারবো?