স্রষ্টা কি পুরুষতান্ত্রিক
ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় নুসাইবা ফাইজাকে বললো,
আচ্ছা ফাইজা, কোরআন-হাদীসের যে বিষয়গুলো নিয়ে তোকে প্রশ্ন করলাম, এসব তো কোরআনেরই আয়াত। এগুলো দিয়েই মানুষ কীভাবে বিভ্রান্ত করতে পারে?
নুসাইবা, একটি প্রসিদ্ধ কথা আছে না— ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর?’
হুম। তো?
প্রথমত, শুধু অনুবাদ পড়ে অনেককিছুই তুই বুঝতে পারবি না। তার আগে উচিত তোর নিজস্ব চিন্তাভাবনার জগতটাকে যাচাই করা। বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের পর্দাটা উঠিয়ে ফেলা। [বর্তমান পুরো বিশ্বের মনস্তত্ত্বে রাজত্ব করা পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের মানসিকতা এমনভাবে তৈরি করে দিয়েছে যে আমরা তাদের মতোই ভাবি; যার ভিত্তি ন্যায়ের উপর নয়—ইচ্ছার উপর। যা কোরআনের বিপক্ষেই সবক দেয় আমাদের সবসময়।] তারপর কোরআন শরীফের তরজমার সাথে সাথে শানে নূযুল, তাফসিরও পড়া। নয়তো তোকে বিভ্রান্তির জন্য কোরআনের একটি আয়াতই যথেষ্ট। যেমন : নারীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র।’
আচ্ছা তাহলে আমি যদি কোরআন বুঝতে চাই—তাহলে কী করলে ভালো হবে?
প্রথমত কুরআনুল কারীম অধ্যায়ন শুরু করলে বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রচুর। সেজন্য সবচেয়ে ভালো হয় আরবি শিখে আরবিতে কুরআন বুঝে নেওয়া। এটা হবে সবচেয়ে উত্তমপন্থা। তাছাড়াও যদি পড়তে চাস তাহলে ‘তাফসিরে মারেফুল কোরআন’ পড়তে পারিস। শানে নুযূল, তাফসিরসহ পড়তে পারবি। বিভ্রান্তির আশঙ্ক্ষা ক্ষীণ।
আচ্ছা অনুবাদক, সংগ্রাহক, বর্ণনাকারী, সিরাত রচনাকারী এগুলো সব পুরুষরাই কেন; নারীরা কেন হতে পারে না?
কেন নয়! সর্বোচ্চ হাদীস বর্ণনাকারীদের দ্বিতীয়জন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা। তাছাড়া হাফসা রাদিআল্লাহু আনহা সহ আরো অনেক নারী সাহাবারা হাদীস বর্ণনা করেছেন। সীরাতও লিখেছেন অনেকে।
কিন্তু তাদের সংখ্যা তো খুবই সীমিত!
দেখ, আমরা বিজ্ঞানের থিওরীগুলো পড়ি। অবশ্যই এসব উপকারী। যারা এগুলো আবিষ্কার করেছে তারা আমাদের নিকট সম্মানিত। কিন্তু একটা বিষয় দেখ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সেরা দশজন বিজ্ঞানীর একটি লিস্ট তৈরি করেছে। তারা হলেন–
স্যার আইজাক নিউটন, লুইস পাস্তুর, গ্যালিলিও, মেরি কুরি, আলবার্ট আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন, অটো হান, নিকোলা তেসলা, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, অ্যারিস্টটল।
এখন দেখ, শুধুমাত্র ‘মেরি কুরি’ ব্যতীত এই লিস্টে কোন নারী নেই। এজন্য কি তুই বলতে পারিস তারা ভুল নির্বাচন করেছে বা এটা নারীর প্রতি অসম্মানী?
না।
তাহলে তারা পুরুষ হয়ে জ্ঞান-অর্জন করেছে, বর্ণনা করেছে, এতে তাদের কী দোষ বল?
আচ্ছা ফাইজা দেখ, কোরআনে যখন আল্লাহর কথা বর্ণনা করা হয়—‘আমি’র জায়গায় ‘আমরা’ বলা হয়েছে। আবার দেখা যাচ্ছে সেখানে ‘আমরা’ শব্দটা ব্যবহার হচ্ছে ‘পুরুষবাচক’এটা কি স্রষ্টার পুরুষ হওয়ার প্রমাণ না?
নুসাইবা, কোরআন নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়। অর্থাৎ আরবদের ভাষায়। সুতরাং ওভাবেই ব্যবহার হবে; যেমন এ্যারাবিয়ানরা ব্যবহার করে। না হলে তো তারা কোরআন বুঝবে না। এখন দেখা যায়, এ্যারাবিয়ানরা যখন সম্মানিত কোনো ব্যক্তি বিষয়ক কথা বলে তখন তারা ‘তুমি’ এককের জায়গায় ‘তোমরা’ বহুবচন এবং ‘আমি’ একবচনের জায়গায় ‘আমরা’ বহুবচন ব্যবহার করে। আর সেটা ‘পুরুষবাচক’ করে। সুতরাং যেহেতু আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হয়েছে, তাই এরকমই নাজিল হয়েছে।
এখন বলবি তাহলে এরকম ভাষায় কেন কেরআন নাজিল হলো?
নুসাইবা, একটি ধর্মগ্রন্থের তো সে ভাষায় হওয়া উচিৎ যা যুগশ্রেষ্ঠ। আর সে যুগে ভাষা সাহিত্যে সর্বোচ্চ এগিয়ে ছিলো আরবি ভাষা। কবি সাহিত্যিকদের ছড়াছড়ি ছিলো তখন আরবে। তারা কবিতার আসর জমাতো। কবিতার শেষ অক্ষর থেকে কবিতা শুরু করতো। কবিতার প্রতিযোগিতা করতো। ভাষায় ছিলো তাদের বিশাল পাণ্ডিত্য। তখন আরবিই ছিলো সকল ভাষার চেয়ে উন্নত ভাষা। সুতরাং কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়াই উত্তম ছিলো।
আরেকটি বিষয় শোন, পুরুষের একবচন শব্দ ‘রজুলুন’—অর্থ একজন পুরুষ। আর বহুবচন হলো ‘রিজালুন’—অর্থ তিন বা ততোধিক পুরুষ। আরবি লোগাত অনুযায়ী এই ‘রিজালুন’ পুরুষবাচক শব্দটি আরবি সাহিত্যে ‘স্ত্রীবাচক’ হয়ে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ সেটা স্ত্রীবাচকের বিধানে। এখন তুই বল, এতে কি পুরুষ, নারী হয়ে গেল? হলো না তো! সে পুরুষই রইলো। ঠিক এমনই; এখানে পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার হলেই স্রষ্টা পুরুষ হবেন, এটা প্রমাণ হয় না।
ফাইজা, একটি আয়াতে বলা হয়েছে—‘তিনি কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি, তার কোন সন্তানও নেই।’-[সূরা জীনঃ৩] এখানে তো বলা হলো না ‘তার কোন স্বামীও নেই।’ এর দ্বারা কি বুঝা যায় না তিনি পুরুষই?
শোন, হিন্দুধর্মানুযায়ী ভগবান শিব এবং পার্বতীর সন্তান হলো গনেশ। খৃষ্টধর্মানুযায়ী স্রষ্টা এবং মরয়মের সন্তান যিশুখ্রিস্ট। অর্থাৎ সবার ধারণা তিনি পুরুষ। আল্লাহ তাআলা এসব বহু স্রষ্টাতন্ত্র এবং তাকে পুরুষ জ্ঞান করাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য বলেছেন ‘তিনি স্ত্রী গ্রহণ করেননি, এবং তার কোন সন্তানও নেই।’ অর্থাৎ গনেশ বা যিশু তার পুত্র নয়। পার্বতী আর মরয়মও স্ত্রী নয়। মোট কথা হলো—হিন্দু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা স্রষ্টার স্ত্রী, পুত্রের কথা বলে; ওটাকে ভুল প্রমাণিত করা।
আচ্ছা তাহলে তুই বলছিস স্রষ্টার কোন লিঙ্গ নেই, তিনি হিজড়া?
নুসাইবা, ধর, তুই একজন উদ্ভাবক। তুই একটা জিনিস আবিষ্কার করলি। যেটা দেখতে বিড়ালের মতো। তার মানে কি ধরে নেবো ‘তুই বিড়াল?’
না।
যিনি লিঙ্গের আবিষ্কারক, তার জন্য কেন লিঙ্গ লাগবে? আর হিজড়ারাও লিঙ্গের অধিকারী। হয়তো পুরুষ না হয় নারী। কিন্তু স্রষ্টার কোন লিঙ্গই নেই। সুতরাং কোরআনকে, স্রষ্টাকে পুরুষতান্ত্রিক বলা যায় না। এরকম আরো অনেককিছু জানতে পারবি, কোরআন অধ্যায়ন করলে। তাই তোকে বলি কোরআন পড়। তবে উত্তম পন্থায়।
আচ্ছা ফাইজা, আজ তাহলে যাই!
নুসাইবা বিদায় নিয়ে চলে গেলো।