Writing

বদনজর থেকে বাঁচার উপায় এবং বদনজরের আক্রান্ত লক্ষন

বদনজরের ব্যাপারটা কিছুটা ভাগ্যের মতোই। অর্থাৎ ভাগ্য যেমন রোগ-ব্যাধি থেকে শুরু করে মৃত্যুর কারণ হয়, তেমনি নজর প্রথমে হয়তো মারাত্মক কোনো উপসর্গের কারণ হয়, তারপর সেখান থেকে প্রাণঘাতী জটিল কোনো রোগ হয়, আর তারপর কবর। এছাড়াও নজরের কারণে মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগে, যার ফলে কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে।

কীভাবে ‘বদনজর উটকে ডেকচিতে, আর মানুষকে কবরে পৌঁছে দেয়’- আশা করছি, তা এখন অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে।

বদনজর থেকে বাঁচার উপায়

১। কথার মাঝে আল্লাহর যিকির করা
২| মেয়ে হলে অবশ্যই শরীয়তের বিধান অনুযায়ী পর্দা করা।
৩। হাদীসে বর্ণিত সকাল সন্ধ্যার দুআগুলো পড়া, বিশেষত:

 بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ، فِي الْأَرْضِ، وَلَا فِي السَّمَاءِ، وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

বিসমিল্লা-হিল্লাযি লা-ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইউং ফিলআরদি ওয়ালা-ফিসসামা-ই, ওয়াহু ওয়াস সামি’উল ‘আলিম।

সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে পড়া।”

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
আ'উযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত্তা-স্মা-তি, মিং-শাররি মা-খলাক।

সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে পড়া।1
৪। সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস: প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে পড়া।”
আর বাচ্চাদের সুরক্ষার জন্য কর্তব্য হচ্ছে, মাঝেমধ্যেই সূরা ফালাক, নাস পড়ে বাচ্চাদের গায়ে ফুঁ দেওয়া, যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও করেছেন।

৫। নজর থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার একটা দুআ আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা পড়ে হাসান এবং হুসাইন রা.-কে ফুঁ দিয়ে দিতেন। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই একই দুআ মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ. নিজের ছেলেদের (অর্থাৎ ইসমাইল এবং ইসহাক আ.) জন্য পড়তেন। দুআটি হচ্ছে-

أعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ

উচ্চারণ: আউযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত্তা-ম্মাহ। মিং কুল্লি শাইত্বা-নিন- ওয়াহা-ম্মাহ। ওয়ামিং কুল্লি আইনিন লা-ম্মাহ।2

এই দুআ সকাল-সন্ধ্যায় কয়েকবার পড়ে বাচ্চাদের ফুঁ দিয়ে দেবেন, নিজের জন্যও পড়বেন। ইনশাআল্লাহ বদনজর থেকে বাঁচতে তাবীজ-কবচ অথবা নজর টিপের দরকার হবেনা। আল্লাহই হেফাজত করবেন।

দ্রষ্টব্য: অন্যের জন্য পড়লে أعوذ (আউযু) এর জায়গায় أعيذك (উইয়ীযু) বলা ভালো, দু’জনের ক্ষেত্রে أعيذكما আর অনেকজনের জন্য পড়লে أعيذكم বলা ভালো। তবে সাধারণভাবে ‘আউযুবিকালিমাতিল্লাহ…’ বললেও সমস্যা নেই, এক্ষেত্রে নিয়ত করে নিতে হবে, কার জন্য পড়ছেন।

৬। ফেসবুক বা এরকম সোশ্যাল মিডিয়ায় অনর্থক শো-অফ না করা। অহেতুক ছবি বা ঘটনা পোস্ট দিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ছবি মানুষকে দেখিয়ে না বেড়ানো।

৭। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিজের প্রয়োজন পূরণ হওয়ার ক্ষেত্রে ‘সেটা গোপন এবং লুকায়িত রাখার’ মাধ্যমে সাহায্য লাভ করো। কেননা, প্রতিটা নিয়ামত লাভকারী হিংসার স্বীকার হয়ে থাকে।3

মূলত এটা সফলতার একটা গোপন চাবিকাঠি। নিয়ামত গোপন রাখার মানে হলো, অন্যের সামনে অহেতুক নিজের বাণিজ্যের সম্পদের প্রশংসা না করা, সন্তানের প্রশংসা না করা, মেয়েরা নিজ স্বামীর প্রশংসা অন্যদের সামনে না করা, ছেলেরা নিজ স্ত্রীর প্রশংসা অন্যদের সামনে না করা। নিজের প্রজেক্ট বা ব্যবসার গোপন আলোচনা অন্যদের সামনে প্রকাশ না করা। অনেকে অহেতুক অন্যদের সামনে গল্প করেন, দৈনিক এত এত বিক্রি হচ্ছে, অমুক চালানে এত টাকা লাভ হলো। এমন আলোচনাও নজরের উৎস হতে পারে।

অহেতুক অন্যের সামনে নিজের কোনো নিয়ামতের আলোচনা না করাই উত্তম। প্রসঙ্গক্রমে করলেও কথার মাঝে যিকর করতে হবে। যেমন: ‘আলহামদুলিল্লাহ, এ বছর ব্যবসায় কোনো লস যায়নি’, ‘আল্লাহর রহমতে আমার ছেলে বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে’, ‘মা-শা-আল্লাহ! ভাবি, আপনি তো অনেক ভালো পিঠা বানান!’ ইত্যাদি। আর অন্য কেউ যদি আপনার কিছুর প্রশংসা করে, তাহলে তিনি যিকর না করলে আপনার উচিত হবে যিকর করা। উদাহরণস্বরুপ: কেউ বলল, আপনার ছেলেটা তো অনেক কিউট!’ আপনি বলুন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

আর অধিক পরিমাণে সালামের প্রচলন করুন, ইনশাআল্লাহ হিংসা দূর হয়ে যাবে।
সর্বোপরি আল্লাহর কাছে দুআ করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘তোমরা বদনজর থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। কেননা বদনজর সত্য।’4

বদনজর আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ

  • শরীরে জ্বর থাকা, কিন্তু থার্মোমিটারে না ওঠা। এ ধরনের অন্য কোনো অসুখ থাকা, কিন্তু মেডিকেল টেস্টে ধরা না পড়া।
  • একের পর এক রকমারি সব অসুখ লেগে থাকা। একটা অসুখ ভালো হতে না হতেই আরেকটা শুরু হওয়া।
  • সাধারণ রোগব্যাধি (সর্দিকাশি, জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদি) দেখা দিয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করেও তা ভালো না হওয়া, ওষুধ কাজ না করা।
  • পড়াশোনা বা কাজে মন না বসা। নামায-যিকরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। কিছুতেই মনোযোগ দিতে না পারা।
  • প্রায়শই শরীর দুর্বল থাকা। বমি বমি ভাব লাগা।
  • সবসময় ঘুমঘুম ভাব, সারাদিন হাই ওঠা।
  • চেহারা মলিন, ফ্যাকাসে বা হলুদ হয়ে যাওয়া। চেহারায় লাল ছোপ-ছোপ দাগ হয়ে থাকা।
  • ক্ষুধামন্দা, খাবারে রুচি না পাওয়া।
  • অহেতুক মেজাজ বিগড়ে থাকা।
  • বুক ধড়ফড় করা, দম বন্ধ বা অস্বস্তি লাগা।
  • কাঁধ ভারি হয়ে থাকা। অহেতুক মাথা ঝিম ধরে থাকা।
  • পেটে প্রচুর গ্যাস হওয়া। এজন্য ওষুধ খেয়ে তেমন ফায়দা না হওয়া।
  • অতিরিক্ত চুল পড়া। এজন্য ওষুধ বা শ্যাম্পু ব্যবহারে তেমন ফায়দা না হওয়া।
  • হাত-পায়ে মাঝেমধ্যেই ব্যথা করা। কিংবা পুরো শরীরে ব্যথা দৌড়ে বেড়ানো।
  • শরীরের বিভিন্ন জায়গার গোশতে গুটলির মতো অনুভব করা।
  • কোনো কারণ ছাড়াই কান্না আসা।
  • আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের সাথে দেখা করতে ভালো না লাগা।
  • ব্যবসা, চাকুরী, আয়-রোজগারে ঝামেলা লেগে থাকা। কোনোভাবেই উন্নতি না হওয়া।
  • যে কাজে ভাল দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটা করতে গেলেই ঝামেলা বাধা, কিংবা অসুস্থ হয়ে যাওয়া।
  • স্বপ্নের মাঝে বোরখা পরা কাউকে দেখা, যার শুধু চোখ খোলা থাকে কিংবা লাল চোখওয়ালা মানুষ দেখা।
  • স্বপ্নে মরা মানুষ দেখা, অথবা নিজেকে মৃত অবস্থায় দেখা।

কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয়:

১. উল্লিখিত বিষয়গুলো এমন না যে, শুধু বদনজরের কারণেই এসব হয়। অন্য কারণেও হতে পারে। যেমন এর কয়েকটা ‘জিন-আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণের’ মাঝেও পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বা অন্যান্য সমতে হবে সমস্যা কোথায়।

২. এই লক্ষণগুলোর মাঝে সবগুলোই মিলতে হবে, এমন না। যদি অল্প কয়েকটা মিলে তবে কম, আর যদি অনেকগুলো মিলে যায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে নজরের সমস্যা অনেক বেশি আছে। আর স্বপ্নের বিষয়গুলো যদি মাঝেমধ্যেই দেখা যায় তাহলে বদনজরের সমস্যা আছে বলে ধরে নেওয়া যাবে। অন্যথায় আউযুবিল্লাহ পড়ুন এবং এই চিন্তা বাদ দিন।

৩. কারও যদি বদনজরের অল্প কিছু লক্ষণ মিলে যায়, আর পাশাপাশি জিন-আক্রান্ত হওয়ার কিছু লক্ষণও মিলে যায় তাহলে সম্ভবত তার ওপর জিনের নজর লেগেছে। এটাকে আমাদের দেশে ‘বাতাসলাগা’ বলে। এই জিনের নজরের ক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যা হয়, যেমন: বাচ্চাদের অহেতুক খুব ভয় পাওয়া, অস্বাভাবিক কান্নাকাটি করা, বড়দের ক্ষেত্রে এমনটা মনে হওয়া যে, ‘আশেপাশে কেউ আছে’ কিংবা ঘরে কেউ না থাকা সত্ত্বেও ছায়া চলাচল করতে দেখা রাতে ঠিক মতো ঘুম না হওয়া, ওয়াসওয়াসা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

তো যাই হোক, এজন্য লাগাতার কিছু দিন বদনজরের রুকইয়াহ করলেই সুস্থ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। আর বদনজরের সমস্যা সাধারণত লক্ষণ শুনেই বুঝা যায়, এরপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য চাইলে রুকইয়াহ করে দেখতে পারেন।

  1. তিরমিযিঃ৩৫৫৯ ↩︎
  2. বুখারীঃ ৩১৯১ ↩︎
  3. আল মুজামুল আওসাতঃ ২৫২৯ ↩︎
  4. ইবনু মাজাহঃ ৩৫০৮ ↩︎

সংগৃহীত
বইয়ের নামঃ রুকইয়াহ
লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ
প্রকাশনাঃ মাকতাবাতুল আসলাফ

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture