কবরস্থানে একদিন

আব্বা কয়েকদিন ধরে আসতে চেয়েছিলেন কবরস্থানে। গতমাসেও নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন দুপুরে এসেছিলাম তাই রোদের তাপে বেশীক্ষণ থাকতে পারিনি। কিছুক্ষণ ঘুরে চলে এসেছিলাম। মনে এত বেশি দাগ কাটেনি।
আজ মেয়ে আরেকজনসহ তার নানু ভাইয়াকে ধরে ধরে কবরস্থান ঘুরিয়ে দেখালো। এই সময়ে আমি একা একা কবরস্থানের অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সারিবদ্ধভাবে একের পর এক কতগুলো কবর!
এক এক করে আমি কতজনের কবর দেখলাম। নামফলকের লেখা পড়লাম সময় নিয়ে নিয়ে। কবরগুলোর বাইরের অবস্থা দেখলাম। আজ কেন যেন আমার ভীষণ কান্না পেলো। না জানি কবে কখন আমিও ঠিক এমন করে মাটির নীচে থাকবো! ভাবতেই ভয় আর কষ্টের সংমিশ্রণে মনটা ভরে গেলো।
এ পৃথিবীতে বুঝি আর থাকবো না! মায়া ভরা সুন্দর এ পৃথিবী, প্রিয় আপনজন সবাইকে ছেড়ে মাটির নীচে একা একা শুয়ে থাকবো! চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে গেলো।
একটা নামফলকে দেখি কি মায়া নিয়ে কেউ লিখে রেখেছে,
“এখানে আমার একমাত্র প্রিয় ভাই চির নিদ্রায় শুয়ে আছে। পরম মমতায় তাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ অজানা এক ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল। আল্লাহ তায়া’লার ডাকে সাড়া দিয়ে আমাকে শোকের সাগরে ফেলে চলে গেল। সে ছিলো আমার সর্বক্ষণের ছায়া, এখন আমি ভীষন একা। মহান রাব্বুল আলামিন তাকে জান্নাত নসীব করুন।”
আহা! কী মায়া! কী কষ্ট!
একে একে কত ধরনের কত কিছু মনে আসতে থাকে! কবরে না জানি কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো! কী হবে!
ওহ! আল্লাহ! ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন।
অধিকাংশ কবরের নামফলকের লেখাতে দেখলাম মৃত্যু ২০২০ সালের জুন/ জুলাই। তার মানে কোভিডের সময়ে কোভিডেই একসাথে এত মানুষ মারা গিয়েছিল। একদম অধিকাংশ কবরেই কাছাকাছি সময় লেখা।
আহারে! একটি দিনে পৃথিবী থেকে কতগুলো মানুষ বিদায় নিয়ে চলে যায়! বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এ পৃথিবীতে তো কেউই চিরস্থায়ী নয়!
কতগুলো কবরের বাইরে কত সুন্দর করে সাজানো। চারপাশে যত্ন করে সারিবদ্ধভাবে গাছ লাগানো, পুরো কবর ঘাস নিয়ে ঢাকা। আবার কতগুলো কবর একদম অযত্নে, অবহেলায় পড়ে আছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কারো কবর দেখলাম, কবরের চারপাশে দামী গাছ। এমন ভাবে যত্ন করে লাগানো যেন ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখে প্রিয়জনকে!
হায়! এত এত ধনসম্পদ রেখে সবাইকে একই অবস্থানে চলে যেতে হয় মৃত্যুর পরে।
আহারে মানুষের কত মায়া! মৃত্যুর পরও হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না, যতনে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে প্রিয়জনকে। ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে যতটা পারা যায় যত্ন করতে ইচ্ছে করে।
এজন্যই বুঝি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন মাঝে মাঝে কবরের কাছে যেতে; যেন মৃত্যুর কথা মনে পড়ে, দুনিয়ার প্রতি মোহ কিছুটা হলেও কাটে।
হাঁটতে হাঁটতে একটা কবরের পাশে এসে থমকে দাঁড়ালাম। হালকা বেগুনি ফুলে ফুলে (শিয়ালমূত্রা) কবরটি ভরে আছে। এ গাছ তো কেউ নিজে থেকে লাগায় না! এটা অযত্নে জন্মানো একটি আগাছা + ভেষজ মাত্র। তাহলে কি নিজে থেকেই কবরটি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে?
বিক্ষিপ্ত ভাবনায় কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে গেলাম। যদি এমন হয় এ কবরটির বাইরে যেমন ফুলে ফুলে ভরে সুন্দর হয়ে আছে, ভেতরটাও যদি এমন ফুলে ফুলে ভরে থাকে!
ও আল্লাহ! আল্লাহ গো! আমার কবরটি কি এমন ফুলে ফুলে ভরা থাকবে? যদি ভেতরে বাইরে ফুলে ফুলে এমন ভরা থাকে! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন তো আল্লাহ? আমাকে একটা সুন্দর মৃত্যু দেবেন তো? আমার কবরটা এমন ফুলে ফুলে সুগন্ধময় করে দেবেন তো?
মহামহিম রব্বের কাছে কত আবদার করে ফেলি।
কিন্তু ভয় হয়, বড় ভয় হয়। কত গুনাহ করে ফেলি জানা অজানায়! দয়াময় রব্বের ক্ষমা ছাড়া, দয়া ছাড়া, রাহমার চাদর ছাড়া কোনো যে উপায় নেই!
ওহ! আল্লাহ! দয়াময় রব্ব! আল- গফুর, আল- গফফার!
আসতাগফিরুল্লহা ওয়া আ’ তুবু ইলাইহি!
আস্তাগফিরুল্লহ হাল্লাজি লা- ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বইয়্যুম ওয়া আ’তুবু ইলাইহি!
আল্ল-হুম্মা ইন্নি আ’উ-জুবিকা মিন আ’জা-বিল ক্ববর।
ইয়া রব্বি!
আপনি আমাদেরকে একটা সুন্দর মৃত্যু দিয়েন ; যখন আপনি আমাদের উপর পুরোপুরি সন্তষ্ট হয়ে যাবেন। আমাদের কবরের শাস্তি মাফ করে দিয়ে আমাদের কবরগুলো ফুলে ফুলে ভরে দিয়েন, আলোকিত করে দিয়েন।
আপনি কিন্তু সব দিতে পারেন মহান রব্ব! ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরম!