Q/A

পিতা সন্তানকে প্রহার করে দারোগা চোরকে প্রহার করে উভয় কি এক

পিতা তার সন্তানকে প্রহার করে, আবার থানার দারোগা চোরকে প্রহার করে। উভয় প্রহার কি এক?
শিক্ষক তার ছাত্রকে শাসন করতে গিয়ে বেত্রাঘাত করে, অপর‌দিকে পুলিশও অপরাধীকে বেত্রাঘাত করে। উভয় কি সমান?
সার্জন রোগীর দেহে অস্ত্রপাচার করে, আবার ডোমও লাশের দেহে অস্ত্রপাচার করে। উভয়টা নিশ্চয় সমান নয়।

দীর্ঘদিন পর বন্ধুকে পেয়ে আরেক বন্ধু বুকে চেপে ধরে। আবার হা ডু ডু খেলায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে বাগে পেলে চেপে ধ‌রে। উভয় চাপাচা‌পি কি সমান?
দু‌নিয়াতে নানারকম বিপর্যয় দেখায় দেয় ঝড় তু্ফান প্লাবন বন্যা দাবানল ভুমিকম্প ইত্যাদি। এগু‌লো মু‌মিনের জীবনেও আসে আবার কা‌ফির মুশ‌রিকদের জীবনেও আসে। মুস‌লিমজনপদকে ধ্বংস ক‌রে আবার কা‌ফি‌রের জনপদকেও ধ্বংস করে। উভয়টা কখনো সমান নয়। উভয়ের কার্যকারণ দৃষ্টিভ‌ঙ্গি ও ব্যাখ্যা এক নয়।

যারা কা‌ফির মুশ‌রিক জা‌লিম ও অবাধ্যতার সীমা লঙ্ঘন করেছে, তাদের ওপর আপ‌তিত এসব প্রাকৃ‌তিক বিপর্যয় নি‌শ্চিত আল্লাহর আযাব ও ক্রো‌ধের ব‌হিঃপ্রকাশ। এর মাধ্যমে ওই জনপদবা‌সিকে আল্লাহ তাআলা চুড়ান্ত ধ্বংস ক‌রতে চান, কিংবা ক‌ঠিনভা‌বে সতর্ক করে দিতে চান। যেন তারা তাওবা করে এবং ফিরে আসে। যেমন ফেরাউন নমরূদ আ’দ সামুদ আইকা লূত জা‌তি‌কে আল্লাহ তাআলা বারবার সতর্ক করার পর চুড়ান্তভা‌বে ধ্বংস ক‌রে দি‌য়ে‌ছেন। এর সবই প্রথম‌দি‌কে ছিল সুযোগপ্রদান ও সতর্ককরণ, চুড়ান্তপর্যা‌য়ে ছিল আযাব ও গজব।

[3:11]كَدَأۡبِ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ وَٱلَّذِینَ مِن قَبۡلِهِمۡۚ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَا فَأَخَذَهُمُ ٱللَّهُ بِذُنُوبِهِمۡۗ وَٱللَّهُ شَدِیدُ ٱلۡعِقَابِ

পক্ষান্তরে নবীগণ ও তাদের অনুসারীদের ওপর নানা বিপদ ও সাম‌য়িক বিপর্যয় নেমে এসে‌ছিল। হযরত ইউনুস আ. সমুদ্রে নিম‌জ্জিত হয়ে‌ছি‌লেন এবং মাছের পেটে ৪০দিন আটকে ছিলেন। হযরত আইউব আ. ক‌ঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে শরীর, স্বাস্থ্য, স্ত্রী-সন্তান, অর্থ সম্পদ সবই হা‌রিয়ে ছিলেন। হযরত যাকা‌রিয়া আ. করাতে দ্বিখ‌ণ্ডিত হয়ে‌ছি‌লেন। মূসা আ. এর অনুসারী বনী ইসরাইল তীহ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দী ছিল। প্লেগ‌ রোগে তাদের লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়ে‌ছিল।

হাদীসের ভাষ্যমতে নবীগণ সবচেয় বেশী বিপ‌দের সম্মুখীন হন, অতঃপর যারা নবীদের কাছাকা‌ছি জীবনযাপন করেন। তারপর সাধারণ মু‌মিনেরা। এসবই কি কা‌ফিরদের মত নিছকই শা‌স্তি বা আযাব স্বরূপ ছিল?
না, কখনোই না।

বরং এর সবই ছিল বি‌ভিন্ন হেকম‌তে।
এক. তা‌দের পরীক্ষা ক‌রা, অতঃপর প্রমোশন দেওয়া।
দুই. তা‌দের মর্যাদা বৃ‌দ্ধি করা।
তিন. নবীগ‌ণকে এমন বিষয়েও পাকড়াও করার‌ নিয়ম রয়েছে, যা সাধার‌ণ মানুষের বেলায় গুনাহই নয়।
চার. দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় স্বাভা‌বিক ত্যাগ কুরবানী মুজাহাদার অংশ হিসাবে।
পাঁচ. তাকদীর তথা আল্লাহর সৃ‌ষ্টিপ্রকৃ‌তি‌র উত্থান-পত‌নের নিয়ম অনুসারে এবং তাঁর পূর্বসিদ্ধান্তের কারণে। উম্মতী ও সাধারণ মু‌মিন হ‌লে আরও ৩টি বিষয় যুক্ত হ‌বে।
ছয়. তা‌দের গুনাহ হ্রাস ও পাপ‌মোচন করা।
সাত. তাদের‌কে সতর্ক করা এবং তাওবা করতে চাপ সৃ‌ষ্টি করা।
আট. তাদের আখিরাতের আযাব হ্রাস করা।

কুরআন মাজীদে এসবের স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। এগু‌লি‌কে নবীগণ ও মুমিন‌দের বেলায় বাহ‌্যদৃ‌ষ্টি‌তে আয‌াব-গজব ম‌নে হ‌লেও মূলত তা উপরের কোনো কারণে হয়ে থাকে।

যেসব লোক মু‌মিন হওয়ার প‌রে নানান কি‌সিমের পাপে ডু‌বে যায় এবং কা‌ফিরদের অনুসরণে অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়, তাদের জন্যে এসব বিপর্যয় সামা‌য়িক আযাব, সতর্ককরণ, তাওবা ইস্তিগফারে মনোযোগী কর‌ণ এবং দ্বীনের দিকে প্রত্যাবর্তনের লক্ষে হয়ে থাকে। যারা সেটা বু‌ঝে, তারা তাওবা করে ঠিক হয়ে যায়। আর যারা বু‌ঝে না, তারা ধ্বংস হ‌য়ে যায়।

আর যারা নেককার হ‌য়, তারা উপ‌রিউক্ত প্রথম ৫‌টির কো‌নো কার‌ণে হ‌য়ে থা‌কে।

আরেক‌টি কারণ এটাও হ‌তে পা‌রে- নেককা‌রগণ নিজেরা নেক হওয়ার পরেও এবং পাপাচা‌রিদের সতর্ক করার পরেও যখন পা‌পিষ্টরা ফিরে আসে না, বরং পাপাচারে সীমালঙ্ঘন ক‌রে; তখন আল্লাহ তাআলা ‌ব্যাপক আযাব দেন। এতে নেককার ও বদকার সবাই ক্ষ‌তিগ্রস্থ হয়। কিন্তু বদক‌রেরা এতে দুনিয়া‌তেও ক্ষ‌তিগ্রস্থ হয়, আখিরা‌তেও হবে এবং বদলোক হিসা‌বে উঠ‌বে। পক্ষান্ত‌রে নেককা‌রের সওয়াবপ্রাপ্ত হয়। য‌দি এতে মারা যায়, তা হলে নেক হিসাবে হাশরে উপ‌স্থিত হ‌বে, য‌দিও বদকারদের জন্যে পাঠা‌নো আযাবে সে মৃত্যুবরণ ক‌রে‌ছিল।

এটা ঠিক আল্লাহর রহমত বন্ট‌নের মত। যখন তি‌নি বৃ‌ষ্টি না‌যিল ক‌রেন, তা যেমন তাঁর নেককার‌দের সা‌থে বদকা‌রেরাও ভোগ ক‌রে, তেম‌নি বদকার‌দের কার‌ণে কোনো আযাব আস‌লে অল্প‌কিছু নেককা‌রেরাও সেটা ভোগ ক‌রতে বাধ‌্য হয়।

মোটকথা, কা‌ফির-‌বে‌দীন-জা‌লিমদের জনপদে যেসব প্রাকৃ‌তিক বিপর্যয় দেখা দেয়, সেটা তাদের ধ্বং‌সের জন্যে আযাব, অথবা সতর্ক সাইরেন। এটা ঠিক দুশমন ও অপরাধী শায়েস্তা করার মত।

পক্ষান্ত‌রে যারা মু‌মিন নেককার হয়, তাদের ওপর আপ‌তিত বিপদ সে পর্যা‌য়ের নয়। বরং সেখা‌নে বি‌ভিন্ন ব‌্যাখ‌্যা র‌য়ে‌ছে। সেটা পিতা সন্তান‌কে শাসন করা এবং শিক্ষক ছাত্রকে‌ শিক্ষা দেওয়ার মত।

প্রকৃত ঈমানদার ও আল্লাহওলাগণ এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে থাকে। তারা এ নিয়ে কোনো অ‌ভিযোগ আপ‌ত্তি করে না; বরং সেটাকে নে’মত ভেবে উপভোগ করে। য‌দিও বাইর থেকে এসব মু‌সিবত ও বিপর্যয়কে অন্যেরা আযাব ভেবে উৎফুল্ল হয়। এটা ঠিক হযরত ইবরাহীম আ. এর নমরূ‌দের অ‌গ্নিকু‌ণ্ডে প‌তিত হওয়ার ন্যায়। ‌বাইর থে‌কে তা ছারখার মনে হলেও ভেতরে ছিল গুলযার। হযরত ইবরাহীম সেখানে ‘খিল্লাতের খেলওয়াত’ ও বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতা অনুভব করে‌ছিলেন। বিপদাপদের অনুভূতি ও দৃ‌ষ্টিভঙ্গী বান্দার ঈমান-আম‌লের অবস্থা ও রবের সাথে তার সম্পর্কের ভি‌ত্তিতে নি‌র্ণিত হয়, জাহেরের দৃ‌ষ্টিতে নয়। আল্লাহু আ’লামু।

লিখেছেন

Picture of সাইফুদ্দীন গাযী

সাইফুদ্দীন গাযী

‌শিক্ষকতা, দাওয়াহ, লেখালে‌খি, সস্পাদনা, খুতবা প্রদান

All Posts

‌শিক্ষকতা, দাওয়াহ, লেখালে‌খি, সস্পাদনা, খুতবা প্রদান


Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture