Writing

সালাতুদ দুহা ও সালাতুল আওয়াবীনঃ হাদীস, মাসায়েল ও অন্যান্য

সালাতুদ দুহা

মাওলানা মনযুর নুমানি তাঁর কিতাব ‘মাআরিফুল হাদীস’-এ ‘কিতাবুস্‌ সালাত’ অধ্যায়ে ইশ্‌রাক-চাশ্‌তের সালাত সম্পর্কিত পরিচ্ছেদের শুরুতে লিখেছেনঃ

এশার পর থেকে সুবহে সাদেকের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যেভাবে কোন নামায ফরয করা হয়নি, কিন্তু এর মাঝে তাহাজ্জুদের কয়েক রাকআত নামায পড়ার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে; তেমনিভাবে ফজর থেকে নিয়ে যোহর পর্যন্ত এ দীর্ঘ বিরতির মধ্যে কোন নামায ফরয করা হয়নি।

তবে এর মাঝে ‘সালাতুদ দুহা‘ নামে কমপক্ষে দুই রাকাআত আর বেশীর পক্ষে যতোটুকু সম্ভব নফল নামায পড়ার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ কয়েক রাকাআত নামায যদি বেলা উঠার কিছুক্ষণ পরেই আদায় করে নেওয়া হয়, তাহলে এটাকে ‘ইশরাক’ বলা হয়। আর সূর্য বেশ উপরে উঠার পর যদি পড়া হয়, তাহলে এটাকে ‘চাশত’ -এর নামায বলা হয়।

হযরত শাহ্‌ ওয়ালীউল্লাহ্‌ রহিমাহুল্লাহ্‌ এগুলোর হিকমত বর্ণনা করতে গিয়ে যা কিছু লিখেছেন এর সারমর্ম এই –

“দিন (যা আরবদের কাছে ফজরের সময় থেকে শুরু হয়ে যায় এবং যা চার অংশে বিভক্ত এবং এক একটি অংশকে প্রহর বলা হয়।) আল্লাহ্‌র অপার হিকমতের দাবী এ হয়েছে যে, দিনের এ চারটি প্রহরের মধ্য থেকে একটি প্রহরও যেন নামায থেকে শুন্য না থাকে। এজন্য প্রথম প্রহরের শুরুতে ফজরের নামায ফরয করা হয়েছে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহরে যোহর ও আসরের নামায। আর দ্বিতীয় প্রহর যা সাধারণ মানুষের জীবিকা অন্বেষণের ব্যস্ততার খাতিরে ফরয নামায থেকে খালি রাখা হয়েছে, এতে নফল ও মুস্তাহাব হিসেবে এ ‘সালাতুদ দুহা’ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ নামাযের ফযীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করে করে এ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র যেসব বান্দা নিজেদের কর্মব্যস্ততা থেকে সময় বের করে এ সময়ে কয়েক রাকাআত নামায পড়ে নিতে পারে, তারা যেন এ সৌভাগ্য লাভ করে নেয়।
তারপর, এ ‘সালাতুদ দুহা’ কমপক্ষে দুই রাকাআত, আর এর চেয়ে অধিক উপকারী হচ্ছে চার রাকাআত, আর এর চেয়েও উত্তম হচ্ছে আট রাকাআত।”

মাওলানা মনযুর নুমানি এটুকু লেখার পর সালাতুদ দুহা সম্পর্কে কিছু হাদিস উল্লেখ করে সেই হাদীসে মুবারাকসমূহের সহজবোধ্য ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, তাদের মধ্যে একটি এই আর্টিকেলে পেশ করেছি। আগ্রহীরা মাওলানার মাআরিফুল হাদীস-এর ‘কিতাবুস্‌ সালাত’ অধ্যায় দেখতে পারেন।

শুরুর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা

চাশ্‌ত, ইশ্‌রাক, আও্‌ওয়াবীন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নামায।
তবে হাদীসের পরিভাষায় চাশ্‌তকে আও্‌ওয়াবীনও বলা হয়।
এমনিভাবে চাশ্‌ত ও ইশ্‌রাককে সালাতুদ দুহাও বলা হয়।1

সালাতুদ দুহা সংক্রান্ত হাদীস

এ অংশে হাদীসের অনুবাদগুলো হাফেয মুনযিরী কৃত “আত তারগীব ওয়াত তারহীব”-এর “আত্‌-তারগীবু ফী সালাতিদ-দুহা” অধ্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, অনুবাদে আমি “সালাতুদ দুহা”- ব্যবহার করেছি, কারণ আরবি ইবারাতে দুহা উল্লেখ করা হয়েছে, ইশ্‌রাক বা চাশ্‌ত উল্লেখ করা নেই (তবে সালাতুদ দুহা বলতে উভয়কেই বুঝায়)

কিন্তু উভয়ের শুরু ও শেষ সময় একই হলেও উভয়ের উত্তম সময়ের পার্থক্য রয়েছে, তাই আমি ইশ্‌রাক ও চাশ্‌ত অংশে সম্পর্কিত হাদীস সেই অংশেই উল্লেখ করেছি ফাতাওয়া-মাসাইলের কিতাব অনুসরণে, যাতে করে নিজ থেকে “বহির্ভূত কোন কিছু” যোগ-বিয়োগের আহাম্মকি না হয়ে যায়। আর রেফারেন্স দেওয়াই আছে, চেক করে নিতে পারেন।

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার বন্ধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তিনটি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। তা হলোঃ

১. প্রত্যেক মাসে তিনদিন সিয়াম পালন করার,
২. দুহা’র দুই রাকাআত সালাত আদায় করার এবং
৩. নিদ্রা যাওয়ার আগে আমি যেন বিতরের সালাত আদায় করে নিই।2

হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি অভিযান প্রেরণ করেন। তাঁরা বিপুল গণীমত সামগ্রী লাভ করেন এবং দ্রুত শত্রুসেনা পর্যদুস্ত করেন।
এক ব্যক্তি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! আমরা এ অভিযানের চেয়ে দ্রুত শত্রুসেনা পর্যদুস্তকারী ও বিপুল গণীমত সামগ্রী লাভকারী কোন অভিযান দেখিনি।
তিনি বললেনঃ এর চেয়ে অধিক দ্রুত শত্রুসেনা পর্যদুস্ত ও বিপুল গণীমত সামগ্রী লাভ করার উত্তম পন্থা আমি কি বলে দেবো? এরপর তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি উত্তমরূপে উযূ করে মসজিদে এসে ফজরের সালাত আদায় করলো। এরপর দুহার সালাত আদায় করে নিলো। ফলে সে যেন অতি দ্রুত শত্রুসেনা পর্যদুস্ত করলো এবং বিপুল গণীমত সামগ্রী লাভ করলো।3

হযরত আবুদ-দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি দুই রাকাআত দুহার সালাত আদায় করবে, সে গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আর যে ব্যক্তি চার রাকাআত আদায় করবে, সে হবে আবিদদের অন্তর্ভুক্ত।
আর যে ব্যক্তি ছয় রাকাআত আদায় করবে, ঐ দিনের জন্য তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।
আর যে ব্যক্তি আট রাকাআত আদায় করবে, সে হবে কানিতীনের অন্তর্ভুক্ত।
আর যে ব্যক্তি বারো রাকাআত সালাত আদায় করবে, আল্লাহ্‌ তা’আলা জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর তৈরি করবেন।
প্রত্যহ দিনরাতে বান্দার প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া বর্ষিত হয়। আর আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দার প্রতি যে অনুগ্রহ করেন, তা বান্দার প্রতি নিঃশ্বাসের যিক্‌রের চেয়েও উত্তম।4

সালাতুদ দুহা সম্পর্কিত একটি হাদীস ও এর ব্যাখ্যা

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (কখনো কখনো) দুহার সালাত (এমন যত্ন ও পাবন্দীর সাথে) আদায় করতেন যে, আমরা মনে মনে বলতাম যে, তিনি সম্ভবতঃ এ নামায কখনো ছাড়বেন না। আবার (কখনো কখনো) এভাবে ছেড়ে দিতেন যে, আমরা মনে মনে বলতাম যে, তিনি হয়তো এ নামায আর পড়বেন না। (তিরমিযী)

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিয়মিত চাশ্‌তের নামায না পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক সময় এমন আমলও ছেড়ে দিতেন, যা করা তাঁর কাছে খুবই পছন্দনীয় ও প্রিয় হতো। এমনটি তিনি এ আশংকার কারণে করতেন যে, লোকেরা তাঁকে এটি পাবন্দীর সাথে করতে দেখে নিজেরাও তাঁর অনুসরণে এমন করতে শুরু করবে এবং শেষ পর্যন্ত এটা ফরয হয়ে যাবে।

সারকথা, ইশ্‌রাক ও চাশ্‌তের মতো নফল নামাযগুলো তিনি কখনো কখনো এ হিকমতের কারণে ছেড়ে দিতেন। আর এ কথা স্পষ্ট যে, এ হিকমত ও কারণটি কেবল হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলায়ই ছিল, অন্য কারো ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়।5

সালাতুদ দুহাঃ ইশ্‌রাক ও চাশ্‌তের নামায

মূলত ইশ্‌রাক ও চাশ্‌তের নামাযের ব্যাপারে হাদীসে সালাতুদ দুহা শব্দ এসেছে।

সূর্যোদয়ের পর হতে সূর্য মধ্য আকাশে আসার পূর্ব পর্যন্ত সময়কে দুহা বলা হয়। এ সময়ের মধ্যে দুই থেকে বারো রাকাআত নামাযের কথা হাদীসে এসেছে। এর নাম সালাতুদ দুহা বা সালাতুল আও্‌ওয়াবীন।
কিন্তু সকালের দিকে পড়া হলে তাকে ইশ্‌রাকের নামায এবং আরও পরে পড়া হলে তাকে চাশ্‌তের নামায বলা হয়ে থাকে।
সূর্য উদয়ের পর যে দুই বা চার রাকাআত নফল নামায পড়া হয়, তাকে ইশ্‌রাক-এর নামায বলে।6

সালাতুদ দুহা সংক্রান্ত মাসআলা

মাসআলাঃ ইশ্‌রাক ও চাশ্‌তের শুরু এবং শেষ সময় একই। অর্থাৎ, সূর্যোদয়ের ১৫-২০ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত।
তবে ইশ্‌রাকের ক্ষেত্রে উত্তম হলো, শুরু সময়ে পড়া।
আর চাশ্‌তের ক্ষেত্রে উত্তম হলো, দিনের এক-চতুর্থাংশ চলে যাওয়ার পর পড়া।7

মাসআলাঃ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য হেলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইশ্‌রাকের সময়। সুতরাং কোনো ব্যক্তি দশ-এগারোটার সময় ইশ্‌রাকের নিয়তে নফল নামায আদায় করলে ইশ্‌রাক-ই আদায় হবে, চাশ্‌ত আদায় হবে না।8

মাসআলাঃ ইশ্‌রাকের নামাযের সময়ের পরিমাণ প্রত্যেক স্থান ও মওসুমেই উঠানামা করে।9

মাসআলাঃ ইশ্‌রাক ও চাশ্‌তের নামায দুই রাকাআত করে পড়তে পারবে; তবে চার রাকআত পড়া উত্তম।10

ইশ্‌রাকের নামায

ইশরাকের নামায সংক্রান্ত হাদীস

আবুদ-দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ্‌ বলেন, হে বনী আদম! তুমি দিনের প্রথমাংশে আমার জন্য চার রাকাআত নামায পড়, আমি দিনের শেষাংশে তোমার জন্য যথেষ্ট হবো। (অর্থাৎ, দিনের শেষাংশে তোমার নেক মাকসাদ পূর্ণ করবো)11

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতের সঙ্গে আদায় করবে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে যিক্‌র-আযকারে লিপ্ত থাকবে, তারপর দুই রাকাআত নামায আদায় করবে, তার এক হজ্জ ও এক উমরার মতো সওয়াব হবে।

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একটা পূর্ণাঙ্গ হজ্জ ও উমরার মতো, একটা পূর্ণাঙ্গ হজ্জ ও উমরার মতো, একটা পূর্ণাঙ্গ হজ্জ ও উমরার মতো।12

হযরত মুআয ইবনে আনাস আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামায থেকে ফারেগ হয়ে নিজ মুসাল্লায় বসে ইশ্‌রাকের নামায পড়বে, ইতিমধ্যে ভালো কথা ছাড়া কোনো কথা বলবে না, তার (সগীরা) গুনাহ্‌সমূহ মাফ করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্র-ফেনার চেয়েও বেশী হয়।13

হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্‌ তাআলার জিকিরে রত থাকে। অতঃপর দু’ রাকআত নামায আদায় করে; সে একটি হজ্ব ও একটি উমরার সওয়াব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে।14

হযরত আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
বনী আদমের প্রত্যেকটা জোড়ার উপর সদকা রয়েছে। যার সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় তাকে সালাম দেওয়া সদকা, নেক কাজের কথা বলা সদকা, মন্দ কাজ থেকে বারণ করা সদকা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা সদকা এবং স্ত্রীর যৌনাঙ্গ ব্যবহারেও সদকার সওয়াব। আর ইশ্‌রাকের নামায এই সবগুলো থেকে যথেষ্ট হয়।15

ইশ্‌রাকের নামায সংক্রান্ত মাসআলা

মাসআলাঃ ফজরের ফরয নামাযের পর হতে সূর্যোদয় এবং সূর্যোদয় হতে তা উজ্জ্বল হওয়া পর্যন্ত নামাযের সময় শেষ হওয়ার পরপরই যে নামায পড়া হয় তাকে ইশ্‌রাকের নামায বলে।16

মাসআলাঃ সূর্য উদয়ের আনুমানিক ১০/১২ মিনিট পর থেকে (যদিও সাধারণভাবে সূর্যোদয়ের ২৩ মিনিট পরের কথা প্রসিদ্ধ আছে) ইশ্‌রাকের ওয়াক্ত আরম্ভ হয় এবং দ্বিপ্রহরের আগ পর্যন্ত ওয়াক্ত বাকী থাকে। তবে ওয়াক্তের শুরুতেই পড়ে নেওয়া উত্তম।17

মাসআলাঃ ইশ্‌রাক সর্বনিন্ম দুই, সর্বোচ্চ চার রাকাআত18

মাসআলাঃ ফজরের নামায আদায়ের পর সেই স্থানেই বসে থেকে দুআ-দরূদ, যিক্‌র-আযকার ও তাসবীহ-তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকবে; দুনিয়াবী কোনো কথা বা কাজে লিপ্ত হবে না এবং সময় হয়ে গেলে ইশ্‌রাকের নামায আদায় করবে। এভাবে ইশ্‌রাক-এর নামায আদায় করাতে সওয়াব বেশী। দুনিয়াবী কথাবার্তা বা কাজে লিপ্ত হয়ে গেলেও সময় হওয়ার পর ইশ্‌রাকের নামায আদায় করা যায়, তবে তাতে সওয়াব কিছু কমে যায়।19

চাশ্‌তের নামায

চাশ্‌তের নামায সংক্রান্ত হাদীস

হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু একদল লোককে চাশ্‌তের নামায আদায় করতে দেখে বললেন, এরা কি জানে না যে, অন্য সময় অর্থাৎ আরো পরে গিয়ে নামায আদায় করা বেশি ফযীলতপূর্ণ?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আও্‌ওয়াবীনের নামায সে সময় হয় যখন উট শাবকের পায়ে গরম ছেকা লাগার সময় হয়ে যায়।20

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, চাশ্‌তের নামাযের ওয়াক্ত হলো সূর্যের তাপ বৃদ্ধি পেলে।
উল্লিখিত হাদীসসহ আরো অনেক হাদীসে চাশ্‌তের নামাযকে আও্‌ওয়াবীনের নামাযও বলা হয়েছে।21

হযরত উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাসুলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে মক্কা বিজয়ের দিন চাশ্‌তের সময় আট রাকাআত নামায আদায় করতে দেখেছেন। (বুখারী – ১১০৬) তবে এ নামায তিনি নিয়মিত পড়তেন বলে প্রমাণ মেলে না।22

চাশ্‌তের নামায সংক্রান্ত মাসআলা

মাসআলাঃ সূর্যোদয়ের পর মাকরূহ সময় অতিবাহিত হলে চাশ্‌তের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং সূর্য হেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওয়াক্ত বাকি থাকে।
তবে, চাশ্‌তের উত্তম সময় হচ্ছে দিনের এক-চতুর্থাংশ অতিবাহিত হওয়ার পর পর্যন্ত।23

মাসআলাঃ চাশ্‌তের নামায দুই রাকাআত থেকে বারো রাকআত পর্যন্ত পড়া যায়।24

সালাতুল আও্‌ওয়াবীন

আও্‌ওয়াবীনের নামায সংক্রান্ত হাদীস

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে মুনকাদির রহিমাহুল্লাহ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি মাগরিব এবং ইশার মাঝে নামায পড়বে সেটা হবে সালাতুল আও্‌ওয়াবীন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আও্‌ওয়াবীনের নামায হলো মানুষ ইশার নামাযের জন্য উঠার পূর্বে মাগরিব ও ইশার মাঝে নির্জন সময়ে যা আদায় করা হয়।25

হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগরিবের নামায শেষ করে ইশা পর্যন্ত নামায পড়তে থাকলেন। অতঃপর ইশার নামায পড়ে বের হলেন।26

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী –

كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ
(অনুবাদঃ তাঁরা রাতে খুব কম ঘুমাতেন)
– এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম মাগরিব এবং ইশার মাঝে নামায পড়তেন।

ইয়াহইয়ার বর্ণনায় আরো বাড়তি রয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী –

تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ
– এর ব্যাখ্যায়ও হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু অনুরূপ বর্ণনা করেন।27

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম ব্যাপকভাবে মাগরিব বাদ নফল নামায পড়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। সুতরাং এটা সুন্নাত।28

আও্‌ওয়াবীনের নামায সংক্রান্ত মাসআলা

মাসআলাঃ মাগরিবের পর এশা পর্যন্ত আও্‌ওয়াবীনের সময়।29

মাসআলাঃ সালাতুল আও্‌ওয়াবীন-এর ফযিলত পেতে হলে মাগরিবের সুন্নাতসহ কমপক্ষে ছয় রাকাআত নামায পড়তে হবে। আর এই নামায সর্বোচ্চ বিশ রাকাআত পড়া যায়।30

মাসআলাঃ আও্‌ওয়াবীন-এ ফাতিহার পর তিনবার ইখলাস পড়তে হয় – কথাটি সহীহ নয়, যেকোনো সূরা পড়া যায়।31

লিখেছেন

Picture of মুজাদ্দিদ হুসাইন রিজভি

মুজাদ্দিদ হুসাইন রিজভি

একজন সাধারণ মুসলিম, দ্বীনের খেদমত করে নিজেকে সৌভাগ্যবান করার বিষয়ে আল্লাহ্‌র তাওফিকের ভিখারি। চেষ্টা করি আলিমগণের খেদমত আরো ছড়িয়ে দিতে, সেই সাথে অনলাইনে লেখালেখিও করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন
  1. ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৯৯ ↩︎
  2. বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ↩︎
  3. আবু ইয়ালা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের সনদে সকল রাবীর বর্ণনা সহীহ। বায্‌যার ও ইবনে হিব্বান তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। বায্‌যার তাঁর বর্ণনায় উক্ত ব্যক্তির নাম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি তাঁর ‘জামে’ গ্রন্থের দাওয়াত অধ্যায়ে হযরত উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন। ↩︎
  4. তাবারানীর ‘কাবীর’; আরো দেখুনঃ হাফেয মুনযিরীর “আত তারগীব ওয়াত তারহীব”-এর ‘আত্‌-তারগীবু ফী সালাতিদ-দুহা’ অধ্যায়ের ১৪ নং হাদীস। ↩︎
  5. মাআরিফুল হাদীস, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২০০-২০১ ↩︎
  6. ফাযায়েলে জিন্দেগী, পৃষ্ঠা ১৫৩ ↩︎
  7. “রদ্দুল মুহতার, ২/৪৬৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া, ১/১১২; আহসানুল ফাতাওয়া, ৩/৪৬৭; খাইরুল ফাতাওয়া, ২/৪৮৭” -এর রেফারেন্সে “ফাতাওয়ায়ে মাদানিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬২” ↩︎
  8. “আদ-দুররুল মুখতার, ২/২২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া, ১/১১২; রদ্দুল মুহতার আলাদ্দুররিল মুখতার, ২/৪৬৫” -এর রেফারেন্সে “ফাতাওয়ায়ে মাদানিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬২” ↩︎
  9. আরো দেখুনঃ “রাদ্দুল মুহতার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫০৪-৫০৫; ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১১; আহ্‌সানুল ফাতাওয়া, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৭-৪৬৮” – এর রেফারেন্সে “ফাতাওয়ায়ে জামেয়া, খণ্ড ১ (ভলিউম ১-২), পৃষ্ঠা ৫৭৫-৫৭৬” ↩︎
  10. ফতোয়ায়ে উসমানী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৮৩ ↩︎
  11. আবু দাউদ, মুসনাদে আহ্‌মাদ ↩︎
  12. তিরমিযী ↩︎
  13. আবু দাউদ, মুসনাদে আহ্‌মাদ ↩︎
  14. আল মু’জামুল কাবীর লিত্‌ তবারানী – ৭৬৪২; আরো দেখুনঃ সলাতুন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পৃষ্ঠা ৬৯০; গ্রন্থনায়ঃ মুফতি গোলামুর রহমান, সম্পাদনায়ঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ↩︎
  15. আবু দাউদ ↩︎
  16. ফাতাওয়ায়ে জামেয়া ইউনুছিয়া, খণ্ড ১ (ভলিউম ১-২), পৃষ্ঠা ২৮৯ ↩︎
  17. ফাযায়েলে যিন্দেগী, পৃষ্ঠা ১৫৫ ↩︎
  18. ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৯৯ ↩︎
  19. ফাযায়েলে যিন্দেগী, পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬ ↩︎
  20. মুসলিম – ১৬১৯ ↩︎
  21. ইবনে আবী শাইবা – ৭৮৭৪; মুসনাদে আহমাদ – ১৯২৭০ ↩︎
  22. সলাতুন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পৃষ্ঠা ৬৯০-৬৯১; গ্রন্থনায়ঃ মুফতি গোলামুর রহমান, সম্পাদনায়ঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ↩︎
  23. “কিতাবুল ফাতাওয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১৯” – এর রেফারেন্সে “ফাতাওয়ায়ে জামেয়া, খণ্ড ৫ (ভলিউম ৯-১০)” ↩︎
  24. ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৪৭ ↩︎
  25. কিয়ামুল লাইল লিল মারওয়াযী, অধ্যায়ঃ মাগরিব এবং ইশার মাঝে নামাযের জন্য উৎসাহিত করা; আরো দেখুনঃ সলাতুন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পৃষ্ঠা ৬৯১-৬৯২; গ্রন্থনায়ঃ মুফতি গোলামুর রহমান, সম্পাদনায়ঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ↩︎
  26. মুসনাদে আহমাদ – ২৩৪৩৬ ↩︎
  27. আবু দাউদ – ১৩২২ ↩︎
  28. আরো দেখুনঃ সলাতুন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পৃষ্ঠা ৬৯২-৬৯৩; গ্রন্থনায়ঃ মুফতি গোলামুর রহমান, সম্পাদনায়ঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ↩︎
  29. ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৯৯ ↩︎
  30. “আদ-দুররুল মুখতার, ২/৪৫২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া, ১/১১২; মাজমাউল আনহুর, ১/১৯৫; হাশিয়াতুত তাহতাবি আলা মারাকিল ফালাহ, ৩৯১” -এর রেফারেন্সে “ফাতাওয়ায়ে মাদানিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬৩”; আরো দেখুনঃ ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৯৯ ↩︎
  31. ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৯৬ ↩︎
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture