Q/AAbdullahil Hadi

কাপল ভ্লগ: দাম্পত্য জীবনের কলঙ্কিত অধ্যায়

বর্তমানে আধুনিক কালে নিজ স্ত্রীর রূপ সৌন্দর্য দেখিয়ে টাকা পয়সা কামাই করাকে বলা হয় কাপল ভ্লগ। আগে যেমন বেকার ও অকর্মণ্য মানুষেরা কয়টা টাকা পয়সা কামানোর জন্য সার্কাস এবং পশুপাখির খেলা দেখাত, সময়ের পরিবর্তনে এখন সেই শ্রেণিটাই কাপল ভ্লগ করে।

যারা কাপল ভ্লগ করে, তাদের পেশা এবং একইসাথে নেশা হয়ে ওঠে এটা। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী করে ভিডিওতে উপস্থাপন করে থাকে কাপল ব্লগাররা। উদ্দেশ্য একটাই মনিটাইজেশনের মাধ্যমে টাকা কামানো। যেহেতু উপার্জন নির্ভর করে দর্শক সংখ্যার উপর, আর দর্শক সংখ্যা বাড়াতে আকর্ষণীয় দৃশ্যপটের প্রয়োজন হয়, তাই তারা প্রদর্শনীতে নিজ স্ত্রীকে উপস্থাপন করে। এটা বলা বাহুল্য যে, একজন নারীর চেহারা এবং কথাবার্তা স্বভাবতই আকর্ষণীয় হয়। ফলশ্রুতিতে বিপুল সংখ্যক পরপুরুষ একই ভিডিও বারংবার দেখে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামের দৃষ্টিতে এটি জঘন্য পাপ এবং স্বাভাবিক বিবেকবোধ ও মানবীয় আত্মমর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি গুরুতর অপরাধ।

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ ۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ-وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ ۚ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নি পুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, যৌনকামনা মুক্ত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া অন্য কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সজোরে পাদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।”
[সূরা নূর: ৩১]

কুরআনে নারীদেরকে বাইরে গমন কালীন মুহূর্তে পূর্ণ পর্দা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশ,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মু’মিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন (প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সময়) তাদের (পরিহিত) জিলবাবের একাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
[সূরা আহযাব: ৫৯]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

إيَّاكم والدُّخولَ على النِّساءِ . فقالَ رجلٌ منَ الأنصارِ : يا رسولَ اللَّهِ ! أفرأيتَ الحموَ ؟ قالَ : الحموُ : الموتُ
“তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। তখন এক আনসার সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দেবরের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, দেবর হচ্ছে মৃত্যুতুল্য।”
[বুখারী: ৫২৩২]

ইমাম তিরমিযী, লাইস ইবনে সা’দ, আল্লামা কাযী ইয়ায ও তাবারীসহ বহু আলেম অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ নারীর জন্য তার দেবর, ভাসুর, চাচা শ্বশুর, মামা শ্বশুর ও তাদের ছেলেদের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করা থেকে দূরে থাকতে হবে যেভাবে মৃত্যু থেকে দূরে থাকতে চায়।

নারী এতটা সস্তা নয় যে, তাকে পণ্য বানিয়ে উপস্থাপন করা যায়। এমন পুরুষের স্বামী হওয়া মহা অন্যায়, যে নিজে খাটাখাটনি করে নিজ স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে পারে না; উল্টো টাকা পয়সা কামানোর জন্য স্ত্রীকে পণ্য বানিয়ে পরপুরুষের চোখে লালসার শিকার হতে বাধ্য করে।

নিশ্চয়ই পিতারা তাদের এই কন্যাদের বহু কষ্টে গড়ে তুলেছেন। আদর্শ ও সুকন্যা বানিয়েই স্বামীদের অর্পণ করেছেন। স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে পিতা-মাতা ভারমুক্ত ও নিশ্চিন্ত থাকছেন। আর এরা স্বামী হয়ে করছেটা কী! পিতারা যদি মেয়েদের নিয়ে ভ্লগ করতেন, তাহলে হয়তো এই স্বামীরা তাদের বিয়ে করত না। বরং খারাপ ও ঘৃণা-র চোখে দেখত। এই কাপল ভ্লগ আমাদের দেশে ছোঁয়াচে অভিশাপ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

এটি বহু সুখী পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বহু পুরুষের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে। বহু শিক্ষার্থীর ফুলেল জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে।

কয়েকটি ঘটনা বলছি।

এক. আমার এক সহকর্মীর হঠাৎ দেখি মন খারাপ। বিষণ্নতায় ভরা চেহারা। আগে কখনও এমন দেখিনি। তাই অবাক হয়েই জানতে চাই — কী হয়েছে?
মন খারাপ নাকি?
আমতা আমতা করে না সূচক উত্তর দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে যাই ব্যাপারটা। কিন্তু! সময় যত গড়ায়, ততই দেখি তার অবস্থার বিরাট পরিবর্তন। বিষণ্ণতা থেকে রীতিমত কাজেকর্মে অনীহা। আমার সন্দেহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। শক্ত করে ধরি তাকে। বলি, কী হয়েছে জানাও। এক পর্যায়ে রহস্যের জট খুলে। হাফ ছেড়ে বলতে থাকে সব কথা। আমি অবাক হয়ে শুধু শুনি। সে জানায়, ফেসবুকে ভিডিওর ধারাবাহিকতায় একদিন জনৈক কাপলের ভ্লগ দেখে। তার চোখ আটকে যায় স্ত্রী লোকটির চেহারায়। ব্যস, সেই থেকে নিয়মিত দেখা শুরু। এখন সেটা একটা ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কল্পনায় শুধু ওই নারী। ব্লগার স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী লোকটির বলা একেকটি কথা, ভাব ভঙ্গি সবসময় তার মাথায় ঘুরপাক খায়। সে স্বস্তি পাচ্ছেনা কিছুতেই।

দুই. এমন বহু স্বামীর কথা জানা আছে— যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে শুয়ে থেকে কাপল ভ্লগ দেখে নিয়মিতই। ব্লগার স্বামী-স্ত্রীর মুহূর্তগুলো, তাদের আচরণগুলো কল্পনা করে সময় পার করে। নিজ স্ত্রীর সাথে খোশগল্পের তৌফিক তাদের হয় না। ওদিকে স্ত্রীদের কলজে ফেটে যেতে চায় দুঃখে কষ্টে। না পারে বলতে, আর না পারে সইতে।নাউজুবিল্লাহ।

বিবেকবানদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এমন বহু অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। ব্লগারদের মোটা অংকের উপার্জন দেখে দেখে বহু সভ্য ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরাও এসবের দিকে ঝুঁকছে। বহু সুপুরুষ এসব দেখে তাদের জীবন যৌবন সব ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখনই যদি এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে না দাঁড়াই, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই কাপল ব্লগের অভিশাপ থেকে বাঁচাতে পারব না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন আমিন।
লেখক: মুহাম্মাদ রাজ
[ourislam24]

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture