স্মরণীয় বরণীয় বাংলার বিদ্রোহীঃ কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র যে একজন কবি ছিলেন তা নয়। তিনি ছিলেন কখনো রাজনীতিবীদ আবার কখনো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বৃটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষে তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠস্বর যিনি সর্বপ্রথম লিখার মাধ্যমে উচ্চারণ করেছিলেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক।
নজরুলের এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সর্বপ্রথম প্রকাশ হতে শুরু করে ১৯২২ সালে। “দৈনিক নবযুগ” পত্রিকা সম্পাদনার সময় সম্পাদকীয় কলামে তিনি উল্লেখ করেন –
❝স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।❞
এই কলাম পড়ে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী কিছুটা নড়ে চড়ে বসলেন কেননা এমন জোড়ালো প্রতিবাদ এর পূর্বে শোনা যায়নি কোনো কবির মুখে। নজরুল পড়ে গেলেন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নজরে । এর আগে নজরুলের বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হলেও সেটিকে নিষিদ্ধ করতে পারেনি বৃটিশ সরকার। কবিতাটিতে কবি বৃটিশ ভারতীয় নাগরিকদের বীর বলে সম্বোধন করে লিখেন,
❝বল বীর, বল চির উন্নত মম শির।❞
হিন্দু-মুসলিমের পুরাণ প্রসঙ্গ এমনভাবে কবিতাটিতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন যে এটি বৃটিশ সরকারকে বিচলিত করতে পারলেও, এটিকে নিষিদ্ধ করতে পারেনি তারা। কেননা নজরুলকে রাজদ্রোহী বলতে গেলে ধর্মের উপরে আঘাত দেয়া হবে বলে প্রতিক্রিয়া হওয়ার তীব্র আশংকা ছিল। কবি উল্লেখ করেন –
❝মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ
ভীম রণভূমে রণিবে না—বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।❞
এই কবিতার মাধ্যমে তিনি “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর “ধূমকেতু” পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের বজ্রকণ্ঠের আরেক সৃষ্টিগাথা, কবিতা “আনন্দময়ীর আগমনে”। এই সেই কবিতা যার কারণে কবিকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। কবিতায় কবি হিন্দুদেবী দুর্গাকে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে রণক্ষেত্রে এসে ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার আহবান জানান।
❝আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?❞
কবিতাটি বৃটিশ শাসকদের মনে ভয়ের প্রসার বাড়িয়ে তোলে আর কবিকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায়। এরপর কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। কিন্তু কারাগারের বন্দি দশায় থেমে থাকেনি নজরুলের কলম। নজরুলকে কারাদণ্ড দেয়ার আগে তাঁর কাছ থেকে নেয়া হয় জবানবন্দী। এই জবানবন্দী পরবর্তীতে ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় “রাজবন্দীর জবানবন্দী” নামক প্রবন্ধ হিসেবে। বৃটিশ সরকারের অন্যায় ও শোষণ কবিকণ্ঠকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং তিনি সেই জবানবন্দীতেও প্রতিবাদের ঝড় তোলেন৷
❝আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…।❞
কবি নজরুলের বিচারক সুইনহো নিজে কবি হয়েও নজরুলকে ১ বছরের স্বশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। এতে নজরুল বলেন –
❝শুনেছি আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকট।❞
নজরুল এই লিখায় নিজেকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে উল্লেখ করেন। এমন দীপ্ত আওয়াজে ইংরেজ শাসকদের শঙ্কা আরো বেড়ে যায়। কারাগারেই কবির প্রতি অন্যায়,অবিচার এবং নিপীড়ন চলতে থাকে। এতে কবি মর্মাহত হন এবং অনশন শুরু করেন। তাঁর অনশনের খবর শুনে দেশের জনতা এবং কবি সমাজের মাঝেও তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসর্গ করে লিখেন “বাসন্তী” গীতিনাট্য, তাঁকে টেলিগ্রাম করে অনশন ভাঙার অনুরোধ জানান। তিনি লিখেন-
❝Live up hunger strike, Our literature claims you.❞
কিন্তু এই টেলিগ্রাম পৌঁছায় নি কবির কাছে। এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জেলে তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলেও তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি কারাগারে। নজরুল কারাগারে নিপীড়ন এবং শোষণের শিকার হয়েও চুপ করে থাকেন নি। এই কারাগারে বসেই তিনি রচনা করেন বিখ্যাত দুটি গান –
❝কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট রক্তজমাট
শিকল-পূজার, পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ! ধ্বংস-নিশান
উঠুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি।❞
এরপর কারাগারে কবিকে শিকল পরানো হলে তিনি পরানো শিকল বাজিয়ে গেয়ে ওঠেন,
❝এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।❞
নজরুলের বিখ্যাত এই গান দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদী কণ্ঠে বেজে ওঠে দুর্বার প্রতিবাদ।
গত ২৪শে ছিল এই বিদ্রোহী কবির ১২২তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা সমাজে কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র একজন কবি হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেননি, একজন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক এবং ঝাঁঝালো আওয়াজের কারণে তাঁর লেখনি মানব মনে এখনো স্থান করে আছে।