Writing

আসমাউল হুসনা – মালিকুল-মুলক

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি উপলক্ষে নিজেকে মালিকুল-মুলক — নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের অধিকারী, আধিপত্যের মালিক – বলেছেন। তিনিই সৃষ্টির একমাত্র মালিক ও অধিপতি। মালিকুল-মুলকের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব এবং শাসন ক্ষমতা রয়েছে যেকোনো কাজ করার, আদেশ করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার, যে উপায়ে তিনি পছন্দ করেন!

একই মূল م-ل-ك থেকে এসেছে مَالِك ، مَلِك, এবং مليك – যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল দখল বা মালিকানা; দ্বিতীয় অর্থ হল ক্ষমতাবান এবং সক্ষম হওয়া; এবং তৃতীয় অর্থ হল কোন কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব থাকা।

এই মূলটি কুরআনে ২০৬ বার দশটি উদ্ভূত এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল – مَلَكَتْ -মালাকাত (“অধিকার”), مُلْكُ – মুলকু (“আধিপত্য”), এবং الْمَلَائِكَةُ – আল-মালাইকাতু (“ফেরেশতা)”।

ভাষাগতভাবে, مَالِك একটি তীব্র রূপ এবং এটি কেবল রাজত্ব নয়, প্রভুত্বকেও বোঝায়। مَلِك (বাদশাহ) শব্দটি মানুষের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে মালিকুল-মুলক নামটি শুধুমাত্র আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জালের জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি সমস্ত রাজাদের রাজা, সমস্ত মালিকদের মালিক, এবং সমস্ত শাসকদের শাসক। যা কিছু ছিল, আছে এবং যা তৈরি হবে তার সবকিছু নিয়েই গঠিত তাঁর রাজ্য!

মালিকুল-মুলক নিজেই বলেছেন –

قُلِ ٱللَّهُمَّ مَٰلِكَ ٱلۡمُلۡكِ تُؤۡتِى ٱلۡمُلۡكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلۡمُلۡكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُۖ بِيَدِكَ ٱلۡخَيۡرُۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ قَدِيرٌ
বল, ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’।1

বিচার দিবসের মালিক:

সূরা আল-ফাতিহায় আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল নিজেকে মালিকি ইয়াওমিদ-দ্বীন বলেছেন। তিনি প্রতিদান দিবসের মালিক এবং সেদিন সমস্ত আদেশ একমাত্র আল্লাহরই হবে। কোন রাজা বা শাসক কাউকে কোন কিছুর আদেশ দিতে পারবে না, এবং কোন ব্যক্তির অন্য কারো জন্য কিছু করার ক্ষমতা থাকবে না। আমাদের উপর তাঁর সম্পূর্ণ মালিকানা ও প্রভুত্ব প্রদর্শন করে সুরা আল-ইনফিতার এ মালিকুল-মুলক বলেছেন –

إِنَّ ٱلۡأَبۡرَارَ لَفِى نَعِيمٍ
নিশ্চয় সৎকর্মপরায়ণরা থাকবে সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যে।2
وَإِنَّ ٱلۡفُجَّارَ لَفِى جَحِيمٍ
আর নিশ্চয় অন্যায়কারীরা থাকবে প্রজ্জ্বলিত আগুনে।3
يَصۡلَوۡنَهَا يَوۡمَ ٱلدِّينِ
তারা সেখানে প্রবেশ করবে প্রতিদান দিবসে।4
وَمَا هُمۡ عَنۡهَا بِغَآئِبِينَ
আর তারা সেখান থেকে অনুপস্থিত থাকতে পারবে না।5
وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا يَوۡمُ ٱلدِّينِ
আর কিসে তোমাকে জানাবে প্রতিদান দিবস কী?6
ثُمَّ مَآ أَدۡرَىٰكَ مَا يَوۡمُ ٱلدِّينِ
তারপর বলছি, কিসে তোমাকে জানাবে প্রতিদান দিবস কী?7
يَوۡمَ لَا تَمۡلِكُ نَفۡسٌ لِّنَفۡسٍ شَيۡئًاۖ وَٱلۡأَمۡرُ يَوۡمَئِذٍ لِّلَّهِ
সেদিন কোন মানুষ অন্য মানুষের জন্য কোন কিছুর ক্ষমতা রাখবে না। আর সেদিন সকল বিষয় হবে আল্লাহর কর্তৃত্বে।8

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে?

প্রতিদান দিবসকে স্মরণ করুন। নিজেকে সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দিন যেদিন মালিকুল-মুলক আপনার মুখোমুখি হবেন:

يَوۡمَ هُم بَٰرِزُونَۖ لَا يَخۡفَىٰ عَلَى ٱللَّهِ مِنۡهُمۡ شَىۡءٌۚ لِّمَنِ ٱلۡمُلۡكُ ٱلۡيَوۡمَۖ لِلَّهِ ٱلۡوَٰحِدِ ٱلۡقَهَّارِ
যে দিন লোকেরা প্রকাশ হয়ে পড়বে। সে দিন আল্লাহর নিকট তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। ‘আজ রাজত্ব কার’? প্রবল প্রতাপশালী এক আল্লাহর।9
ٱلۡيَوۡمَ تُجۡزَىٰ كُلُّ نَفۡسٍۢ بِمَا كَسَبَتۡۚ لَا ظُلۡمَ ٱلۡيَوۡمَۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَرِيعُ ٱلۡحِسَابِ
আজ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অর্জন অনুসারে প্রতিদান দেয়া হবে। আজ কোন জুলুম নেই। নিশ্চয় আল্লাহ দ্রুত হিসাবগ্রহণকারী।10

আপনি যখনই আপনার নামাজে মালিকি ইয়াওমিদ-দ্বীন বলেন, তখন কল্পনা করুন একদিন তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে, এবং সেই দিনের জন্য আপনি কি আমল করছেন এই পৃথিবীতে তাও একবার চিন্তা করে দেখুন !

তাঁর রাজত্ব নিয়ে চিন্তা করুন। আজকাল আমারা বেশিরভাগ মানুষ শহরে বাস করি। ইট, কাঠ, কংক্রিটের এই পৃথিবীতে আমরা ভুলে যাই মনোনিবেশ করতে প্রকৃতির মাঝে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জালের মহৎ প্রকাশ। যখন আপনি দৈনন্দিন জীবনের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন, ছোটখাটো সমস্যাগুলো যখন জটিল আকার ধারণ করে, আল্লাহর সাথে আপনার সম্পর্ক যখন দুর্বল অনুভব করেন, তখন ঘর থেকে বের হয়ে প্রকৃতির মাঝে চলে যান। একটা পাতা কুড়িয়ে হাতে নিন, এর বিন্যাস অনুভব করুন। প্রকৃতি আপনার হৃদয়কে বিনম্র হতে সাহায্য করবে। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করাও ইবাদতের একটি রূপ।

মালিকুল-মুলক এর কাছে প্রার্থনা করুন। তাঁর কাছে কুরআনের এই সুন্দর দু’আটি করুন:

ٱلَّذِينَ يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ قِيَٰمًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمۡ وَيَتَفَكَّرُونَ فِى خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ رَبَّنَا مَا خَلَقۡتَ هَٰذَا بَٰطِلًا سُبۡحَٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ
যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে ও কাত হয়ে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে। (বলে) ‘হে আমাদের রব, তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র মহান। সুতরাং তুমি আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা কর’।11

জান্নাতে প্রবেশ করার মুহূর্তটি কল্পনা করুন; দরজায় ফেরেশতারা আপনাকে সালামুন আলাইকুম বলে স্বাগত জানাবে- তারা আপনাকে শান্তির সাথে অভিবাদন জানাবে, সেই শান্তি – যা আপনি আপনার সারা জীবন কামনা করেছেন। তারপর আপনি আপনার বাড়িতে ছুটে যাবেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ
‘সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাণ, প্রত্যেক ব্যক্তি তার দুনিয়ার বাসস্থানের তুলনায় জান্নাতের বাসস্থানকে উত্তমরূপে চিনতে পারবে’12

জান্নাতকে আপনার জীবনে বাস্তবে পরিণত করুন, এবং প্রতিটি দিনের শুরুতে এটিকে একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য করুন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল বলেছেন –

وَإِذَا رَأَيۡتَ ثَمَّ رَأَيۡتَ نَعِيمًا وَمُلۡكًا كَبِيرًا
আর তুমি যখন দেখবে তুমি সেখানে দেখতে পাবে স্বাচ্ছন্দ্য ও বিরাট সাম্রাজ্য।13

জান্নাতে সেই মহান রাজ্যের প্রথম দৃষ্টির কথা কল্পনা করে নিজেকে অনুপ্রাণিত করুন!
মালিকুল-মুলকের রাজত্বে নিজে দায়িত্বশীল হন।

وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّى جَاعِلٌ فِى ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةًۖ
আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করছি’.....14

আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে তাঁর রাজত্বে পাঠিয়েছেন: একমাত্র তাঁর ইবাদত করতে এবং এই পৃথিবীতে একজন সংস্কারক হিসেবে কাজ করতে। আপনি কিভাবে জানবেন যে মালিকুল-মুলক তাঁর রাজ্যে আপনার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করেন?
কুরআন এবং সুন্নাহ অধ্যয়ন করুন যাতে প্রথমে আপনি তাঁর আদেশ ও সীমা সম্পর্কে জানতে পারেন, যা দিয়ে তিনি আপনাকে পথপ্রদর্শন করেছেন।
দ্বিতীয় ধাপ হল দ্বীন বোঝার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করা, এবং
তৃতীয় ধাপ হল সঠিক জ্ঞান অনুসারে কাজ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা!

একজন ভালো নেতা হোন। রাসূল (সা.) বলেছেন,
“তোমরা প্রত্যেকেই মেষপালক এবং সবাই তার পালের প্রতি দায়বদ্ধ। একজন নেতা অভিভাবক হিসেবে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। একজন পুরুষ তার পরিবারের অভিভাবক হিসেবে নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল। একজন মহিলা তার স্বামীর সংসারের অভিভাবক হিসাবে তার সংসারের এবং সন্তানাদি দেখাশোনার ব্যাপারে দায়িত্বশীলা। একজন ভৃত্য তার প্রভুর সম্পত্তি দেখাশোনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল। কোন সন্দেহ নেই যে তোমরা প্রত্যেকেই মেষপালক এবং যে যার পালের প্রতি দায়বদ্ধ।”15

অন্য কারো উপর আপনার কর্তৃত্বের অপব্যবহার করবেন না। আপনার স্ত্রী, এবং সন্তানদের প্রতি, এমনকি পশুদের প্রতিও ন্যায় বিচার করুন, এবং নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে মালিকুল-মুলকের দ্বারা আপনার নেতৃত্ব সম্পর্কে আপনি জিজ্ঞাসিত হবেন!

হে আল্লাহ, মালিকুল-মুলক, আমরা জানি যে আপনিই আমাদের একমাত্র মালিক ও শাসক। আপনি আমাদের তৌফিক দান করুন যেন আমরা আমাদের কথায় এবং কাজে প্রতিদান দিবসকে স্মরণ করতে পারি, আপনার রাজত্ব নিয়ে সত্যিকার অর্থে চিন্তাভাবনা করতে পারি, এবং এর দ্বারা নিজেদের বিনীত করতে পারি, এই পৃথিবীতে দায়িত্বশীল হতে পারি, এবং আমাদের অধীনস্থদের প্রতি ন্যায় বিচার করতে পারি।
হে আল্লাহ, মালিকুল-মুলক, আপনি আমাদেরকে আপনার চিরস্থায়ী সুখের রাজত্ব জান্নাতের প্রবেশ করার তৌফিক দিন। আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

মালিকুল-মুলক

আসমাউল হুসনা

লিখেছেন

Picture of ফাহমিনা হাসানাত

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

  1. সূরা আলি-ইমরান-৩: আয়াত -২৬ ↩︎
  2. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৩ ↩︎
  3. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৪ ↩︎
  4. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৫ ↩︎
  5. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৬ ↩︎
  6. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৭ ↩︎
  7. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৮ ↩︎
  8. সূরা আল-ইনফিতার-৮২: আয়াত -১৯ ↩︎
  9. সূরা গাফির-৪০:আয়াত-১৬ ↩︎
  10. সূরা গাফির-৪০:আয়াত-১৭ ↩︎
  11. সূরা আলি-ইমরান-৩: আয়াত-১৯১ ↩︎
  12. সহীহ বুখারী – ৬৫৩৫ ↩︎
  13. সূরা আল-ইনসান-৭৬: আয়াত-২০ ↩︎
  14. সূরা আল-বাকারাহ-২: আয়াত-৩০ ↩︎
  15. রাসূল (ﷺ) : সহি বুখারী : ৭১৩৮, সহিঃ মুসলিম : ১৮২৯ ↩︎
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture