ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর সাথে স্বামীর নাম যুক্ত করার বিধান কি
ইসলামের সঠিক জ্ঞানের অভাব বা অন্য কোনও কারণে যদি কোনো নারীর নামের সাথে তার স্বামীর নাম যুক্ত হয়ে যায় এবং জাতীয় পরিচয় পত্র সহ সকল সরকারী-বেসরকারি কাগজপত্রে সেই নাম উল্লেখ থাকে-যা পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। তাহলে সে ক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে তওবা করার পাশাপাশি সেই নারীর করণীয় কী? তিনি জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য আর কী করতে পারেন? দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ।
খুব দুর্ভাগ্য বশত: আমাদের সমাজে মুসলিম নারীদের অনেকেই বিয়ের পরে নিজের নামের সাথে স্বামীর নামকে যুক্ত করে তা নিজের নামের অংশ বানিয়ে ফেলে। এটি একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অনেকে এটাকে স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করেন। প্রকৃত পক্ষে এটি আমাদের সমাজে পশ্চিমা ইহুদি-নাসারাদের কৃষ্টি-কালচারের ব্যাপক প্রচলন এবং ইসলামি সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। ইসলামি স্কলারদের মতে, ইসলামে জন্মদাতা পিতা ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে পরিচয় সম্বন্ধ করা নিষিদ্ধ। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম প্রথা।
যদি স্বামীর নামের সাথে স্ত্রীর নাম যুক্ত করা মর্যাদার বিষয় হত তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামের সাথে তাঁর প্রিয় সহধর্মিণীগণ নাম যুক্ত করাকে বিশাল মর্যাদার বিষয় মনে করতেন। কিন্তু তারা তা করেন নি। সাহাবি, তাবেয়ী বা তৎপরবর্তী কোনও কালেই মুসলিমদের মাঝে এমন প্রচলন ছিল না। কিন্তু অধুনা যুগে মুসলিমরা দীনের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে কাফেরদের সাংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ করতে গিয়ে একান্ত তাদের বিষয়গুলোকে নিজেরা গিলতে শুরু করেছে-যা খুবই দুঃখজনক। অথচ ইসলামি শিষ্টাচার হল, নিজের নামের সাথে নিজের পিতার নাম যুক্ত করা। যেমন: ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ অথবা ফাতিমা মুহাম্মদ (বিনতে দেয়া বা না দেয়া উভয়টি সঠিক)। [এটি পুরুষ-মহিলা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।]
মহান আল্লাহ মানুষকে তাদের পিতৃ পরিচয়ে ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ
“তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃ পরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত।”
[সূরা আহযাব: ৫]
এ আয়াতে ইসলামে একমাত্র পিতার সঙ্গেই পরিচয় নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যাহোক, যারা এমনটি করেন তাদের সচেতন হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত হাদিসগুলো যথেষ্ট হতে পারে:
আবু যার রা. হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ ادَّعَى قَوْمًا لَيْسَ لَهُ فِيْهِمْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
“যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে বংশ সম্পর্কিত দাবী করল যে বংশের সঙ্গে তার কোন বংশ সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়।”
[সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন) অধ্যায়: ৬১/ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য, পরিচ্ছেদ: ৬১/৫.মুসলিম ১/২৭]
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“مَنِ انْتَسَبَ إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ….فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ”
“যে ব্যক্তি নিজের পিতা ব্যতীত অন্যের সাথে জন্মসূত্র স্থাপন করে… তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল ও সকল মানুষের অভিসম্পাত।”
[সুনান ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: ১৪/ হদ (দণ্ড) পরিচ্ছেদ: ১৪/৩৬. কোন ব্যক্তি নিজের পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে পরিচয় দিলে এবং নিজের মনিব ব্যতীত অন্যকে মনিব বলে পরিচয় দিলে।]
এসব কঠোর হুমকি ঐ সকল ব্যক্তির জন্যও প্রযোজ্য যারা নিজের জন্মদাতা পিতার স্থানে অন্য কোনও ব্যক্তি বা বংশের নাম স্থাপন করে এবং সেই নামেই নিজের পরিচয় দেয়।
এটি কাফেরদের অন্ধ অনুকরণ:
ইসলামে অমুসলিমদের অনুসরণ-অনুকরণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ-চাই তা ইবাদতের ক্ষেত্রে হোক অথবা আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি বা কৃষ্টি-কালচারের ক্ষেত্রে হোক। কেননা হাদিসে এসেছে:
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।” [সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ হা/৪০৩১-হাসান সহিহ]
এছাড়াও হাদিসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের পূর্বে অনেক মুসলিম ইহুদি-খৃষ্টানদের রীতি-নীতি অনুসরণ করবে বলে ভবিষ্যতবাণী করেছেন-বর্তমানে যার বাস্তব প্রতিফলন আমরা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
সাহাবী আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حذو القذة بالقذة حَتَّى لَوْ دخلوا جُحْرَ ضَبٍّ لَدخلتتُمُوهُ قالوا: يَا رسول الله الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى. قَالَ: فَمَنْ؟»
‘‘তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী উম্মতদের অভ্যাস ও রীতি-নীতির ঠিক ঐ রকম অনুসরণ করবে, যেমন এক তীরের ফলা অন্য এক তীরের ফলার সমান হয়। অর্থাৎ তোমরা পদে পদে তাদের অনুসরণ করে চলবে। এমনকি তারা যদি শাণ্ডা (মরুভূমিতে বসবাসকারী গুই সাপের ন্যায় এক ধরণের জন্তু বিশেষ) এর গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে।”
সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী উম্মত দ্বারা আপনি কি ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বোঝাচ্ছেন?
তিনি বললেন: তবে আর কারা?
[বুখারী, অধ্যায়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: ”তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতির অনুসরণ করবে।” তবে বুখারীর বর্ণনায় حذو القذة بالقذة – এই শব্দসমূহ নেই। তার স্থলে شبرا بشبر وذراعا بذراع শব্দগুলো রয়েছে। অর্থাৎ এক হাতের বিঘত যেমন অন্য হাতের বিঘতের সমান হয় এবং এক হাতের বাহু অন্য হাতের বাহুর সমান হয়।]
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
لا يحل للمسلمين أن يتشبهوا بالكفار في شيء مما يختص بأعيادهم لا من طعام ولا لباس ولا اغتسال… ولا البيع بما يستعان به على ذلك لأجل ذلك.
“মুসলিমদের জন্য কাফেরদের উৎসবের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্য, পোশাক, গোসল..ইত্যাদি কোন কিছুর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে তাদের উৎসবের কাজে লাগানো হয় এমন জিনিসও এ উদ্দেশ্যে বিক্রয় করাও বৈধ নয়।”
আমাদের অজানা নয় যে, স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যে বা অন্য কোনও কারণে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে পারে, তারপর অন্যত্র বিয়ের মাধ্যমে স্বামী পরিবর্তন হতে পারে। তখন আগের স্বামীর এ নামের কোনও মূল্য থাকবে না। কিন্তু বাবা-মেয়ের রক্ত সম্পর্ক চিরকালীন। এটা কোনও অবস্থায় পরিবর্তন হবে না। তাছাড়া এটি নিজের পিতার প্রতি অকৃতজ্ঞতা, অসদাচরণ ও সম্মানহানীও বটে। অথচ ইসলামে প্রতিটি সন্তান তার পিতামাতার সাথে সদাচরণ, সুসম্পর্ক ও তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে নির্দেশিত। এটি একজন নারীর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বোধ ও আত্মমর্যাদা বির্সজনেরও শামিল।
সুতরাং এসব যৌক্তিক কারণেও আমাদের কর্তব্য, নিজের নামের সাথে পিতার নাম যুক্ত করার পাশাপাশি বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার এবং স্বামীর নামকে নিজের নামের অংশ বানিয়ে নেয়ার বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে সরে আসা।
যাহোক, অজ্ঞতা বা অসতর্কতা বশত: জাতীয় পরিচয় পত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদি সরকারী-বেসরকারি কাগজ-পত্রে এভাবে নাম যুক্ত হয়ে থাকলে তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা উচিৎ। কিন্তু এতে খুব বেশি সমস্যা বা ঝামেলা হলে বা চেষ্টা করার পরও অসম্ভব হলে ওভাবে থাকলেও গুনাহ নেই। কারণ আল্লাহ বান্দার উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কোনও দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। তবে এমন অজ্ঞতা সুলভ কাজের জন্য লজ্জিত হৃদয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করার পাশাপাশি সতর্কতা অবলম্বন করা কর্তব্য, যেন পরবর্তীতে নিজের সন্তান-সন্ততিদের ক্ষেত্রে এমনটি না ঘটে। নিশ্চয় আল্লাহ বান্দার নিয়ত সম্পর্কে অবহিত এবং ক্ষমাশীল।
আল্লাহু আলাম।