নারীদের চিন্তা
এক
গ্রামের একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা, মাসে ১০-১২ হাজার টাকা বেতন পায়। ঈদ, নববর্ষে বোনাস পায়। বিয়ের আগে এই মেয়েকে তার বাপের বাড়ির লোকজন কদর করে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সমীহ করে। বিশেষ করে, দেবর-ভাসুরের ‘গৃহিণী’ বউয়েরা ‘টিচার’ জা কে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ঈদের আগে সে যখন শ্বশুরের জন্য পাঞ্জাবি, শাশুড়ির জন্য শাড়ি কিনে আনে, তখন তার মর্যাদা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে অন্য বউমার চেয়ে বেশি থাকে।
ওহ, মাঝেমধ্যে শ্বশুর-শাশুড়ি বা ননদ/জা হাতখরচ বা ধার চাইতে গেলে এই টিচার বউমা/ভাবির কাছেই চান।
দুই
তিন ভাই ঢাকায় তিনটি বাসায় থাকে। এক ভাইয়ের বউ MNC তে চাকরি করে, সিক্স ডিজিটের আশেপাশে স্যালারি। এক ভাইয়ের বউ ডাক্তার, নিজস্ব চ্যাম্বার আছে। মেজো ভাইয়ের বউ ক্লাস এইট পাশ। এমন ‘শিক্ষিত’ পরিবারের বউ হবার পেছনে তার অন্যতম যোগ্যতা ছিলো সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সে অন্য ভাই বউদের এগিয়ে।
মাসে একবার তিন ভাই, তিন ভাই-বউ একত্রিত হয় বা কোনো ফ্যামিলি প্রোগ্রামে যায়।
আশেপাশের সবাই চাকরিজীবী দুই বউকে যেভাবে সমীহ করে, চাকরিজীবনের খোঁজ-খবর নেয়, মেজো ভাইয়ের বউয়ের সাথে এমন কথা বলে না। হাই-হ্যালো বলেই ঐ সমাজের লোকেরা কী কথা বলবে খুঁজে পায় না।
তিন
মধ্যবিত্ত পরিবারের মা। স্বামীর উপার্জন দিয়ে সংসার চলে, তিনি বাসায় সেলাই করেন, মুরগি পালেন, শাক-সবজি চাষ করেন। মাস শেষে ২ হাজার টাকা আসে হাতে৷ সন্তানদের ছোটোখাটো আবদার পূরণ করেন। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাবার জন্য ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছেলেকে বাবা বলেছেন ৫০০ টাকা দিতে পারবেন না। ছেলে মাকে ম্যানেজ করে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।
যেসব সন্তানরা মায়ের হাত থেকে সামান্য হলেও হাতখরচ পায়, সেসব সন্তানরা বেশ গর্বভরে বন্ধুদেরকে বলে,
“আজ আব্বা ২০ টাকা দিয়েছেন, আম্মা আব্বাকে লুকিয়ে আরো ১০ টাকা দিয়েছেন।”
যে বন্ধুর সাথে গল্প করছে, সেই বন্ধু তার মায়ের কাছে কোনোদিন টাকা পায়নি। পাবে কিভাবে?
মাকে তার বাবা প্রয়োজনীয় খরচ বাদে একটাকাও হাতখরচ দেন না।
বলতে গেলে নারীর অর্থ ব্যয়ের কোনো খাতই নেই। একজন অবিবাহিত নারীর কাছে ২০০০ টাকা থাকলে সে এই টাকা দিয়ে কী করবে?
জামা লাগলে বাবা/ভাইকে বলবে। খাবার লাগলেও তাদেরকে বলবে।
বিবাহিত নারীর কসমেটিক্স লাগবে স্বামীর জন্য সাজুগুজু করতে। এটা সে নিজের টাকায় কিনবে কেনো? স্বামীকে বলবে। বাপের বাড়ি যাবার সময় মিষ্টি নিতে হবে। এটাও স্বামী নিয়ে যাবে।
তাহলে সে টাকা দিয়ে করবে কী?
আমি অনেক ভেবেছি। একজন নারীর টাকা ব্যয়ের খাত আসলেই নাই।
কিন্তু, ইসলাম নারীকে কেনো অর্থনৈতিক দায় দায়িত্ব না দেবার পাশাপাশি তাদেরকে অর্থনৈতিক অধিকারও দিয়েছে? তারা বাবার সম্পত্তির ভাগ পায়, স্বামীর সম্পত্তিরও। আবার মোহরানাও।
খুব ভালোভাবে এগুলো পরিশোধ করলে দেখা যাবে যে, একজন মধ্যম গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবী পেনশনের সময় যতো টাকা পায়, একজন নারী তার মধ্যবয়সেই সমপরিমাণ বা তার অর্ধেক টাকা পেয়ে যায়।
মানুষজনের সরকারি চাকরি করতে চাবার পেছনে অন্যতম মোটিভেশন হলো জীবন সায়াহ্নে মোটা অংকের পেনশন ভাতা পাবে।
আর একজন নারীকে যথাযথভাবে অর্থনৈতিক অধিকার দেয়া হলে সে ২৫ বছর বয়সেই বিপুল অর্থের ‘একক’ মালিক হতে পারে। একক মালিক কথাটি এজন্যই বললাম, বেশিরভাগ পুরুষ ১০০ টাকা উপার্জন করলে সেটার একক মালিক সে হতে পারে না। সেটাতে ভাগ থাকে পরিবারের।
উপরের তিনটি উদাহরণ আমাদের আশেপাশে অহরহ দেখতে পাই। যেসব নারীরা স্বাবলম্বী, তার পরিবারের লোকজন, তার সমাজের লোকজন তাকে সমীহ করে। যেসব নারী গৃহিণী, তারা অনেকটাই চাকরিজীবী নারীর কাছে মিনমিন সুরে কথা বলে।
আমরা হয়তো অনেক কিছু চাই। কিতাব পড়ে অনেক থিওরি দেই।
কিন্তু, আমাদের ছোটো বোনের কথা চিন্তা করুন। সে এতো কিতাব পড়েনি, এতো তত্ত্বের সাথেও পরিচিত না। সে যখন দেখে তার চাচি স্কুলের টিচার হবার কারণে দাদা-দাদী চাচীকে কটুকথা বলে না, কিন্তু তার মায়ের পান থেকে চুন খসলেই বকাঝকা করে, তার তখন কেমন লাগে?
সে যখন দেখে তার ডাক্তার বোনের হাতের দিকে মা-বাবা এবং অন্যান্য বোনেরা তাকিয়ে থাকে, তখন সে কি সিদ্ধান্ত নেয়?স
‘আমিও আমার ডাক্তার আপুর মতো হবো’।
মেয়েটি যখন দেখে অফিস শেষে তার বাবা এসে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা মাকে বলে-
‘সারাদিন ঘরে কী করো?
আমি পরিশ্রম করে খাওয়াই বলেই তো খাচ্ছ?’
তখন সে নিজের ক্যারিয়ার ডিসিশন কী নেয়?
সে চায় না মায়ের মতো গৃহীণী হয়ে স্বামীর ‘সারাদিন কী করো’ খোটা শুনতে।
আমরা অনেককিছুই চাই। আমরা চাই সবাই ইসলামি অনুশাসন মেনে চলুক।
কিন্তু, আমাদের সব চাওয়ার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাবো এটা জরুরি না।
ফেসবুকে নারী ইস্যুতে কেউ আমার সাথে একমত না হলেই সে ‘নারীবাদী/ফ্যামিনিস্ট’ হয়ে যায় না।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, নারীরা নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেছে। ১২-১৫ বছর বয়সী মেয়ে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার মা, চাচী, বোনের অবস্থা দেখেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কী করবে।
‘ধর্মের কথা’ বলে যদি মনে করেন তাকে আটকাবেন, তাহলে হয়তো আপনি তার তেজোদ্দীপ্ত জবাব এখনো শুনেননি।
সে বলছে- আমার আব্বা যখন আম্মাকে এসে ‘কিছু করছো না’ বলে খোটা দিতো, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
আমার মা বিয়ের অনুষ্ঠানে একপাশে বসে থাকতো, আর সেই ডাক্তার চাচিকে নিয়ে সবাই আহ্লাদী করতো, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
গৃহিণী বলে কেনো আমার মাকে সোশ্যাল ডেসক্রিমিনেশনের স্বীকার হতে হলো?
ধর্মপ্রধান বাংলাদেশের সমাজে নারীকে যেরকম সম্মান দেখানো উচিত ছিলো, সেই সম্মান দেখানো তো হয়ইনি, বরং নারীকে নানানভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে- তুমি পরিবারের বোঝা।
‘ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে?’
প্রশ্নের জবাবেই বাবা, চাচা, ফুফুদের মুখ কালো জবাব থাকে- ‘মেয়ে‘। প্রশ্নকারী নবজাতকের লিঙ্গ শুনেই অংক করতে থাকে- ‘তাইলে তো ৪-৫ লাখ রেডি রাখো মেয়ের বিয়ের জন্য‘।
একজন মেয়ে নবজাতককে তার পরিবার দুনিয়াতে স্বাগত জানায় ‘৪-৫ লাখ টাকা রেডি রাখো’ এমন উপদেশ মাথায় রেখে।
শুধুমাত্র কিতাব খুললেই সে জানতে পারে, মেয়ে হওয়াটা তার জন্য দুর্ভাগ্যজনক না, দুশ্চিন্তার না, অর্থনৈতিক কন্ট্রিবিউশান করতে পারছে না বলে এটা তার অসম্মানের না; বরং এটাই স্বাভাবিক। সে দেখে এসব কথা শুধু কিতাবেই আছে।
কিন্তু, তার বাবা, ভাই, স্বামী, আশেপাশের লোকজনের আচরণ দেখে নিজেকে এই প্রশ্ন করতে থাকে-
“সবাই মিলে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিতাবে যা আছে, তার বিপরীতটাই আমাদের ‘নারীদের’ সাথে করবে?”