Writing

আবার নিজেকে খুঁজে পাওয়া

ফজরের সালাত আদায় করে নিরিবিলি এক স্থানে বসে আছেন আবান। আকাশ দেখছেন। ঝিরিঝিরি বাতাসে তার উষ্কশুষ্ক চুল গুলো বাতাসের সাথে লুকোচুরি খেলছে। এই হতাশা পূর্ণ জীবন নিয়ে অনেক অভিযোগ আবানের। কিছুই যেন ভালো লাগছে না তার। মনে মনে ভাবছেন-

সালাত না হয় পড়ছি কিন্তু এত সকল গুনাহের ভিড়ে যে নিজেই তলিয়ে যাচ্ছি। এই তাওবা করছি তো আবার এই গুনাহের কাজে লিপ্ত হচ্ছি। আমার এই দ্বীনদারীতা ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয় তো? উফ…. আমার দ্বারা কিছুই আর হবে না! এদিকে নিজের নাফসের লাগাম কোনভাবেই যেন টেনে ধরতে পারছিনা। কোনভাবেই যেন থামাতে পারছি না আমার এই তাওবার পরেও গুনাহকে। জাহান্নাম ছাড়া যে চোখে আর কিছুই দেখি না। এত এত গুণাহ গুলো কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? ইয়া আল্লাহ এই পাপিষ্ঠ কে ক্ষমা করুন”!

কিন্তু এই ক্ষমা চাওয়ার মাঝে যেন কোন আশা নেই আবানের। কেমন যেন ‘হলে হলো না হলে নেই’ অনেকটা এই অবস্থার মতো।

সকালের এই মনোরম পরিবেশে প্রকৃতির সকল কিছু সজীব দেখালেও নিস্তেজ দেখাচ্ছে আবানকে। যেন মনে হচ্ছে খরায় চৌচির বড় বড় ফাটল ধরেছে আবানের হৃদয়ে। এবং কাক ডাকছে কা কা করে। একাকীত্বও যেন অত্যন্ত পরিতাপের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২.

উঠে দাঁড়ালেন বসা হতে আবান। সকালে পাখির কিছির মিছির , পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠার লাল মিষ্টি আভা, হালকা মানুষের আনাগোনা মাঝে যেন আবান ভালো নেই। অনেকটা পানির অভাবে নেতিয়ে পড়া কচি গাছের মতো দেখাচ্ছে আবানকে।

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন আবানের কাঁধে হাত রেখে বলেন-
“কি ভাইজান! একা একা কি করছেন?”
আগন্তুক এক লোক। যাকে এর আগে কখনো আবান দেখেনি। আবান বললেন-
-আসসালামু আলাইকুম। কে ভাই আপনি?
-ওয়ালাইকুমুস’সালাম। আমি একজন মুসাফির (কিছুটা মুচকি হেসে)।
-মুসাফির ,মানে! আপনি কে আর কোথায় হতে এসেছেন?

-আরে আরে ভাই উত্তেজিত হবেন না। আমি আজাদ আপনাদের এলাকার মসজিদে তাবলীগে এসেছি। অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করলাম আপনি একা একা এখানে বসে আছেন। তাই সঙ্গ দিতে নিজ দায়িত্বেই চলে এলাম।
-আচ্ছা….।

আজাদ খুবই চমৎকার একজন। যার মুখে সব সময় মুচকি হাসি লেগেই থাকে ।যার কথাবার্তায় সবসময় এক প্রফুল্ল মেজাজ অনুধাবন করা যায়। এক প্রকার খুব মজার মানুষ। আবানের এমন অস্থিরতা অবস্থা দেখে আজাদ নিজ থেকেই আবানকে বলছেন-

-তা ভাইজান আপনি দেখি একলা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন! চলুন না ভাইজান একসাথে বসে গল্প করি? (কিছুটা ইতস্ততার সাথে)

-কি গল্প করতে চান ভাই। (অন্যমনস্ক হয়ে)
-আপনি যা বলতে চান।
-আচ্ছা ভাইজান আপনি তো এখানে তাবলীগে এসেছেন! তো আমার সাথে কথা বলে আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করছেন না তো?

-মানে ভাইজান বুঝিনি।যদি কিছু মনে না করেন ,আপনি কি খুলে বলতে পারেন আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?

-(একটি বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে) না ভাইজান !আসলে বলতে চাচ্ছি। আমি অনেক গুনাহগার বান্দা। আমার সাথে গল্প করে তো আপনার কোন লাভই হবে না।
– (কিছুটা মুচকি হেসে) মাশাল্লাহ ভাইজান! লাভ ক্ষতির হিসাব করতে গেলে তো আমাদের অনেক আলাপ আলোচনা করা উচিত একসঙ্গে বসে।
– (ভ্রু কুঁচকে মলিনতার হাসির সাথে) তাই! চলুন তবে বসা যাক!
– (উদ্ভূত হয়ে ) আসেন ভাই ,আসেন, বসি!

৩.

আবান এবং আজাদ উভয় পাশাপাশি বসলেন। আজাদ আবান কে বলছেন-
– ভাই! আপনাকে আজ ফজরের সালাত আদায় করতে দেখেছিলাম। কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছিলো আপনাকে। এরপর সালাত শেষে যখন বের হলাম দেখলাম আপনি একা এখানে বসে আছেন। আপনি কি ভাই কোন সমস্যায় ভুগছেন, আমাকে কি বলা যাবে? (ইতস্ততার সাথে)

-(অস্থিরতার সাথে) গুনাহ ভাই গুনাহ! গুনাহ আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমার ইবাদতের স্বাদ কেড়ে নিচ্ছে। সকল ভাল লাগার কাজ হতে আমাকে বঞ্চিত করে দিচ্ছে ভাই। এই তওবা করছি তো আবার গুনাহে লিপ্ত হচ্ছি। জাহান্নাম ছাড়া যে ভাই চোখে আর কিছুই দেখিনা!

-ভাই আপনার মধ্যে যেন আমি দুইটা জিনিস দেখতে পাচ্ছি! প্রথমত “তাকওয়ার ছাপ”এবং দ্বিতীয়ত “নিরাশার ছাপ”!

– তাকওয়া! নিরাশা! ঠিক বুঝলাম না ভাই!

– জ্বী! বলছি শুনুন তবে, জানেন ভাই আমরা মানুষ জাতি বড্ড অদ্ভুত। জীবনে চলার পথে প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু সমস্যা হয়। হোঁচট খায়, ছোটখাটো কিংবা বিশাল। অনেক সময় রক্তক্ষরণ হয়, কাছে সব মানুষকে অসহ্য লাগে। ভালো সব কথা তিক্ততায় রূপ নেয়। ভালো লাগে না তখন কিছু, হৃদয় কম্পিত হয় বিষাদে বিষাদে। হারামে ডুবে থাকার সত্বেও হুশ আসে না। কেমন যেন এক, একঘেয়েমি কাজ করে। ইবাদতের স্বাদ পেয়েও যেন পাওয়া যায় না। অন্তর তখন অসুস্থ হয়ে পড়ে। মূলত তখন আমাদের নাফস কলুষিত হয়ে যায়। অনুভূতিরা সব মার্জিত রূপ হারাই। রবের কথা স্মরণে এলেও যেন নিজেকে সারিয়ে নিতে পারি না।

-ভাই আপনার বলা প্রতিটি কথা আমার সাথে মিলে যাচ্ছে, তারপর বলুন ভাই তারপর…(আগ্রহের সাথে)।

-(মুচকি হেসে) ঠিক তখনই আমাদের গ্রাস করে বসে একাকীত্ব বিষন্নতা আর হতাশা। নিজেকে তখন চারপাশ থেকে আলাদা রাখতে ইচ্ছে করে।কোলাহলে নিজেকে জঞ্জাল মনে হয়। তাই মনে মনে এমন একটি স্থান খুঁজে বেড়াই যেখানে থাকলে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। চেনা পরিচিত একটি মুখ ও সেখানে থাকবে না এমন। এমনটা আমাদের অনেকের সাথে হয়।

-(মাথা নিচু করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে) আমার সাথে যে এমনই হচ্ছে…..!

-(আবানের কাঁধে হাত রেখে)আমার নিজের সাথেও এমনটা হয়েছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে কি হয় বলুন? এর একটা অবশ্যই বিহিত হওয়া চাই!
-হ্যাঁ কিন্তু কিভাবে? শত শত সীমালংঘন সেগুলোর কি হবে?
-(কিছুটা মুচকি হাসছেন)
-হাসছেন কেন ভাই? সত্যিই তো এত সকল গুনাহ সীমালংঘন সেগুলো কি উবে যাবে!
-বলছি ভাই আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর! কিন্তু তার আগে আপনাকে একটি আয়াত শোনাতে চাই,

“আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের অন্তরের রোগ নিরাময় করেন”
(সূরা তাওবা আয়াত১৪)

উক্ত আয়াতের মাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টা করুন ভাই‌। স্বয়ং মহান আল্লাহ আমাদের অন্তরসমূহের রোগ নিরাময় করে দেন। আমাদের শত শত সীমালংঘন, গুনাহের জন্য আমাদের অন্তরে যখন কালো দাগ পরে, আমাদের অন্তর যখন কঠিন থেকে কঠিন হয়ে যায়, স্বয়ং আল্লাহ তখন আমাদের অন্তরের চিকিৎসা করেন। এবং রোগ মুক্ত করে দেন। তাঁর নিকট একটিবার তওবা করার ফলে!

-সুবাহানাল্লাহ, সত্যি !আল্লাহ আমাদের অন্তরের রোগ নিরাময় করে দেন!

-নিঃসন্দেহে! চলুন তবে, এবার আপনার প্রশ্ন ফিরে যাওয়া যাক। এত সকল গুনাহ কি হবে তাই তো? জানেন কি ভাই কি হবে! মহান রাব্বুল আলামিন চাইলে আপনার এত সকল গুনাহ নেকীতে পরিণত করে দিবেন!

-গুনাহ আবার নেকিতে! এ কিভাবে সম্ভব?

-হ্যাঁ সম্ভব! এটি আল্লাহর ওয়াদা।

“তওবা করে ফিরে আসলে পূর্বের গুনাহ আল্লাহ তায়ালা নেকি দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিবেন।”
(সূরা ফুরকান আয়াত ৭০)

বাকরুদ্ধ আবান হা করে চেয়ে আছে আজাদের দিকে। এবং অবাক দৃষ্টিতে বলছেন-
-আল্লাহ এতো মহান ও দয়ালু!
-হ্যাঁ অবশ্যই! তিনিই তো রহমান। মহান রাব্বুল আলামিন কুরআনুল কারিমে এরশাদ করেন-

“তিনিই তো তাঁর দাসদের তওবা কবুল করেন এবং সকল পাপ কাজ মুছে দেন।আর তোমরা কি করছো তিনি তা জানেন।”
(সূরা আশ-শূরা৪২:২৫)

-সুবহানাল্লাহ! কিন্তু ভাই আমার যে অনেক জঘন্য জঘন্য গুনাহ আছে। যা আমি ভাষায় কি বলবো ভাবতেই ঘৃণা লাগে নিজেকে!

-হতাশ হবেন না ভাই (মুচকি হেসে)। জানেন কি, এই নিয়ে মহান আল্লাহর ফয়সালা কি? শুনুন তবে-

“যে-ই খারাপ কাজ করেছে অথবা নিজের নাফসের প্রতি জুলুম করেছে তারপর আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, সে দেখবে আল্লাহ অত্যাধিক ক্ষমাশীল অতিরিক্ত দয়াময়।
(সুরা নিসা ৪: আয়াত ১১০)

এখানেই শেষ নয় ভাই! তিঁনি আরো বলেন-

“তোমরা রবের কাছে ক্ষমা চাও, তারপর তার কাছে ফিরে যাও। তাহলে তিনি নির্দিষ্ট সময় ধরে তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন।”
(সূরা হূদ ১১: আয়াত ৩)

৪.

টপ টপ করে অশ্রু গড়ে পড়ছে, আবানের গাল বেয়ে। স্তব্ধ আজাদ চেয়ে আছেন আবানের দিকে। বাচ্চাদের মত কাঁদছেন এবং বলছেন-

-কি শোনালেন ভাই কি শোনালেন! আমার সিনাহ যে ফেটে যাচ্ছে। সুবহানাল্লাহ আল্লাহ এত দয়ালু!

-শান্ত হোন ভাই আমার! মুমিনদের হতাশ হতে নেই।

-(প্রবল কান্নার সাথে) আমার মত জঘন্য পাপী মানুষ কিভাবে মুমিন হতে পারে?

-আপনি কি ভুলে গেলেন ভাই ,প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর বলা হাদীসটি!

“আপনার নেক আমল যখন আপনাকে আনন্দিত করে এবং বদ আমল যখন আপনাকে ব্যতীত করে তবেই আপনি মুমিন।”
(মুসনাদু আহমাদ-২২১৬৬)

আবানের কান্নার বেগ যেন আরো তীব্র কর হতে থাকলো। আবেগ আপ্লুত আবান কান্না ছাড়া বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। আর ঠিক তখন, আবানকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আজাদ বলছিলেন-

-ভাই এভাবে বাচ্চাদের মতো আর কতক্ষণ! ( অশ্রুসিক্ত চোখে)
জানেন ভাই একটি আয়াতের কথা মনে পড়ে গেল

“সেই বড় শাস্তির পূর্বে আমি এই দুনিয়াতেই ছোট শাস্তির স্বাদ তাদেরকে দিতে থাকবো।হয়তো তারা ফিরে আসবে।”
(সূরা আস-সাজদাহ ৩২: আয়াত ২১)

উক্ত আয়াত পাঠ করে আজাদ চোখের অশ্রু লুকাতে চাইছেন। সাথে তিনি আরো পাঠ করতে থাকলেন-

“জমিন ও সাগর জুড়ে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যা মানুষ তার কৃতকর্মের মাধ্যমে অর্জন করেছে। যেন তারা তাদের কাজের পরিণতি কিছুটা বুঝতে পারে। যার ফলে হয়তো তারা ফিরে আসবে।”
(সূরা রূম আয়াত ৪১)

৫.

খন পড়ে উঠে দাঁড়ালেন আবান এবং আজাদ। আবান আজাদকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন,
-নিঃসন্দেহে এটি আমার রবের পক্ষ হতে আমার জন্য উত্তম নাসিহা ছিল। এবং মহান আল্লাহ আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।
-আলহামদুলিল্লাহ! শুকরিয়া ভাইজান! আপনার সাথে কিছু সময় কাটাতে পেরে নিজেকে অনেক প্রফুল্ল লাগছে!
– আলহামদুলিল্লাহ! চলুন ভাই তবে শুকরিয়া সালাত আদায় করে আসি দুই ভাই মিলে।
– চলুন…
এই বলে উভয়ে মসজিদের দিকে রওনা হলেন।

লিখেছেন

Picture of মাহাবুবা সুলতানা মীম

মাহাবুবা সুলতানা মীম

❤️O'My Allah O' My Lord , You are My creator
None is your partner , let's Forget that NEVER ❤️

All Posts
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture