আসমাউল হুসনা – আল-হাইয়্যু
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে পাঁচবার নিজেকে ٱلْحَىُّ – আল-হাইয়্যু – চিরঞ্জীব- বলেছেন। আল-হাইয়্যু হলেন চিরন্তন এবং অমর, তাঁর থেকে সমস্ত জীবন উদ্ভূত হয়। আল-হাইয়্যু ছিলেন, আছেন এবং সর্বদা বেঁচে থাকবেন!
হাইয়্যুح-ى-ى এর মূল থেকে এসেছে, যা চারটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ বেঁচে থাকা, দ্বিতীয় অর্থ হল স্পষ্ট বা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠা। তৃতীয় অর্থটি হল পুনরুজ্জীবিত হওয়া, প্রাণবন্ত হওয়া, এবং চতুর্থ অর্থ হল স্থির বা সম্পূর্ণ হওয়া।
এই মূলটি কুরআনে ১৮৪ বার ১২টি উদ্ভূত আকারে রূপে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল یُّحۡیِ (“জীবন প্রদান”), حيّان (“জীবিত”) এবং حَیٰوۃُ (“জীবন”)
আল-হাইয়্যু হলেন তিনি, যার নিরন্তন একটি জীবন রয়েছে – যার কোন শুরু বা শেষ নেই। তাঁর জীবন, এবং তাঁর সমস্ত গুণাবলী নিখুঁত, তাঁর জীবন স্বাবলম্বী এবং এর কোনো বাহ্যিক উৎস নেই, অথচ আমাদের জীবন সৃষ্টিকর্তা আমাদের দিয়েছেন। আল-হাইয়্যু সমস্ত জীবনকে অস্তিত্বে আনেন এবং তিনিই সেই উৎস যেখানে প্রতিটি জীবন প্রত্যাবর্তন করবে!
আল-হাইয়্যু নিজেই বলেন –
وَ عَنَتِ الۡوُجُوۡهُ لِلۡحَیِّ الۡقَیُّوۡمِ ؕ وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ حَمَلَ ظُلۡمًا
চিরঞ্জীব চিরস্থায়ীর সম্মুখে সকলেই হবে অধোমুখী, আর সে ব্যর্থ হবে যে যুলমের (পাপের) ভার বহন করবে।
[সূরা ত্বহা:১১১]
وَ تَوَکَّلۡ عَلَی الۡحَیِّ الَّذِیۡ لَا یَمُوۡتُ
আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার উপর যিনি মরবেন না।
[সূরা আল-ফুরকান:৫৮]
هُوَ الۡحَیُّ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَادۡعُوۡهُ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ ؕ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা দ্বীনকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করে তাঁকে ডাক। সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি সৃষ্টিকুলের রব।
[সূরা গাফির: ৬৫]
পবিত্র কুরআনে আল্লাহর আল-হাইয়্যু (চিরঞ্জীব) নামটি প্রায়শই আল-কাইয়ুম (রক্ষক) নামের সাথে মিলিত হয়। এটি আল্লাহর গুণাবলী এবং তাঁর কর্মের পরিপূর্ণতার একটি সুন্দর সমন্বয়। আল-হাইয়্যু মানে যিনি নিখুঁত জীবনযাপনের অধিকারী, এবং তাই তাঁর সমস্ত গুণাবলী নিখুঁত: তাঁর শ্রবণশক্তি, তাঁর দৃষ্টিশক্তি, তাঁর সৌন্দর্য — সব। মানুষের জীবন সব দিক থেকে অপূর্ণ: আমাদের শ্রবণ, দৃষ্টি, বাকশক্তি ও কাজ সবই অপূর্ণ। আল্লাহর সমস্ত গুণাবলীই নিখুঁত, কারণ গুণাবলীর কোনো ঘাটতি জীবনের দুর্বলতা থেকে আসে এবং তাঁর জীবন পরিপূর্ণ!
আল্লাহ এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
চিরঞ্জীবীর উপর ভরসা করুন।
وَ تَوَکَّلۡ عَلَی الۡحَیِّ الَّذِیۡ لَا یَمُوۡتُ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِهٖ
আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার উপর যিনি মরবেন না। তাঁর প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ কর।
[সূরা আল-ফুরকান: ৫৮]
এই পৃথিবীতে আমাদের সমস্ত সমস্যা এবং দুর্দশা – হোক তা অর্থিক বা পারিবারিক – একদিন সব ধ্বংস হয়ে যাবে। উপরের আয়াতটি আমাদেরকে একটি ব্যাপার গভীরভাবে চিন্তা করতে শেখায়: যখন আপনি আল্লাহর উপর ভরসা করেন, তখন সত্যিই উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন তিনি কতটা মহান। আপনি আপনার কল্পনাশক্তি ব্যবহার করুন — একশো বছর, হাজার বছর, এক মিলিয়ন বা এক বিলিয়ন বছর পিছনে ফিরে যান ফিরে যান – তখনো আল্লাহ জীবিত ছিলেন। একইভাবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করুন – এবং তাঁর গৌরব এবং মহিমা অনুভব করুন।
নিজেকে ভালো কাজ করতে অনুপ্রাণিত করুন। এই আয়াতের শেষে বলা হয়েছ –
کَفٰی بِهٖ بِذُنُوۡبِ عِبَادِهٖ خَبِیۡرَا
তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে খবর রাখার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট।
[সূরা আল-ফুরকান:৫৮]
আপনি যেমন আপনার সমস্ত বিষয় আল-হাইয়্যুর উপর ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেছেন এবং আপনার ঠোঁট থেকে আসা তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ বলে) দ্বারা এই সচেতনতা প্রকাশ করছেন, আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে এবং আপনার কাজকর্মেও এর প্রতিফলন ঘটান। আল-হাইয়্যু আপনাকে ভাল কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেন। মানুষজন কিন্তু সারা জীবন আপনার সাথে ছিল না, আপনার সমস্ত খারাপ কাজ তারা দেখতে এবং শুনতে পায়নি। আল-হাইয়্যু তাঁর নিখুঁত শ্রবণ এবং দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আপনার সাথে ছিলেন এবং থাকবে যা তাঁর নিখুঁত জীবনের অংশ!
প্রত্যেক নামাযের পরে এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে আয়াতুল কুরসি পাঠ করুন। কুরআনের এই সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াতে আল-হাইয়্যু নামটি উল্লেখ করা হয়েছে এবং আয়াতুল কুরসি সম্পর্কে অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি বাক্যে আল্লাহর একটি বা দুটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে: যখনই আপনি এই আয়াতটি পাঠ করেন তখন আল্লাহর গুণাবলীর প্রতি চিন্তাভাবনা করুন এবং কিভাবে আল্লাহর এই গুণাবলীগুলো তাঁর নিখুঁত জীবন থেকে উদ্ভূত হয় তা আলোকপাত করুন — তিনিই আল-হাইয়্যু!
আল-হাইয়্যুর কাছে প্রার্থনা করুন। রাসুল (ﷺ) যখন কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন, তখন তিনি বলতেন –
يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ
মোটামুটি উচ্চারণ- ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু বিরাহমাতিকা আসতাগীস
অর্থ : হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্বচরাচরের ধারক! আমি আপনার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
[সূরা আল-ফুরকান:৫৮]
আল-হাইয়্যুর কাছ থেকে সান্ত্বনা লাভ করুন। যখন নিজেকে পরাভূত মনে করেন, যখন আপনার মনে হয় চারপাশের সবকিছু আপনি হারিয়ে ফেলছেন – জেনে রাখুন আল-হাইয়্যু সবসময় আপনার সাথেই আছেন। যখন আপনার সাথে অন্যায় আচরণ করা হয় এবং আপনার চারপাশে অবিচার দেখতে পান, তখনও আল-হাইয়্যুর আইন যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করুন, তবে এটাও জেনে রাখুন যে প্রত্যেক একক ব্যক্তির অবিচার পরকালে ব্যর্থতার কারণ হবে। কাজেই নিজেকেও অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করুন।
দৈনন্দিন জীবনের দিকনির্দেশনার জন্য আল-হাইয়্যুর কাছে প্রার্থনা করুন। রাসুল (ﷺ) একবার ফাতিমাকে (রা:) নিম্নোক্ত দু’আটি সকাল-সন্ধ্যা পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন –
ياَ حَيُّ ياَ قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أسْتَغِيْثُ أصْلِحْ لِيْ شَأنِيْ كُلَّهُ وَلاَ تَكِلْنِيْ إلَى نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ
উচ্চারণঃ ইয়া- হাইয়্যু ইয়া- কাইয়্যুমু বিরাহমাতিকা আস্তাগীস, আসলিহ্ লী- শা’নী- কুল্লাহু, ওয়ালা- তাকিলনী- ইলা- নাফসী ত্বারফাতা আইন।
অর্থঃ হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্বচরাচরের ধারক! আপনার কাছে আমি সাহায্য প্রর্থনা করছি, সুতরাং আমার সকল অবস্থা সংশোধন করে দিন, এবং এক পলকের জন্য হলেও আমাকে আমার নিজের উপর ছেড়ে দিয়েন না।
[সূরা আল-ফুরকান: ৫৮]
যদি আল-হাইয়্যু আপনাকে এক সেকেন্ডের জন্যও নিজের উপর ছেড়ে দেন, আপনি ধ্বংস হয়ে যাবেন।
হে আল্লাহ, আল-হাইয়্যু, আমরা জানি যে আপনিই চিরস্থায়ী এবং চিরঞ্জীব। জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে যেন আপনার উপর নির্ভর করতে পারি আমাদের আশীর্বাদ করুন। আমাদেরকে আপনার জীবনের পরিপূর্ণতা এবং নিখুঁত গুণাবলী সমূহ উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন, এবং এবং এই উপলব্ধিকে সম্বল করে আমাদের পথচলার নির্দেশনা দিন। আমাদের জীবনকে কল্যাণের উৎস করুন এবং আমাদের জীবনের একটি সুন্দর সমাপ্তি দিন, আমাদেরকে কেবল আপনার দিকে ফিরে আসতে অনুপ্রাণিত করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের উদ্যানে আমাদের অনন্ত জীবন দান করুন, আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আল-হাইয়্যু
Source: understandQuran