চোর থেকে আলেম!
আগেই বলেছি এই সিরিজে আমাদের ধার্মিক পূর্বসূরীদের কুরআনের সাথে সম্পর্ক এবং প্রতিক্রিয়ার গল্পগুলি রয়েছে। সুবহানাল্লাহ, আমরা প্রায়ই অতীতের বড় বড় আলেমদের কথা শুনে থাকি, এবং আমাদের একটি সহজাত ধারণা হলো এইসব মহৎ ব্যক্তিরা হয়তো সারাটি জীবন এরকম মহান ছিলেন। এই সিরিজের বিগত পর্বগুলো থেকে এই পর্যায়ে এসে আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন অনেক মহৎ আলেমরাই এসেছেন জীবনের রুক্ষপথ অতিক্রম করে। অনেকেরই অতীত জীবন ছিল সত্যিই কদর্য, আর এমনই একজন হলেন আজকের পর্বের আলোচিত ব্যক্তিত্ব ফুদাইল ইবনে ইয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ওয়া রাহিমাহুল্লাহ তা’য়ালা।
তার সম্বন্ধে একটু ধারণা দেই, তার ডাক নাম হল ইমামুল হারামাইন – দুই হারামের ইমাম। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে তাসকিয়া অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার প্রত্যেকটি বইতে উল্লেখ রয়েছে, যিনি পরবর্তী জীবনে তপস্যার জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
অনেকেই হয়তো জানেন না, সুবহানাল্লাহ, এই লোকটির ইমাম হওয়ার আগের জীবনটা কেমন ছিল। তিনি ছিলেন সিরিয়া এবং খোরাসানের মধ্যবর্তী এলাকায় রাজপথের কুখ্যাত এক ডাকাত। তিনি এই পথে যাতায়াতকারী কাফেলাদের উপর আক্রমণ করতেন, ডাকাতি করতেন, তাদের সাথে হিংস্র আচরণ করতেন। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো তিনি যিনা করতেন, কাফেলার নারীদের সাথে তিনি অবাধ ব্যভিচার চালিয়ে যেতেন। এছাড়া ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে উপত্যকার পেছনে এক রমণীর বাড়িতে তিনি প্রায়ই যেতেন।
সুবহানাল্লাহ, একবার কল্পনা করে দেখুন একজন মানুষ যিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে পাপের সাগরে নিমজ্জিত করে রেখেছেন, দিনের বেলা সবচেয়ে হারাম কাজ তিনি করছেন – রাজপথে ডাকাতি, এবং রাতের বেলায় কদর্য সময় অতিবাহিত করছেন যিনা ব্যভিচার করে। তিনি বলেন, এক রাতে তিনি যিনার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন, এবং পথ চলতে চলতে এক পুরুষের কণ্ঠস্বর তিনি শুনতে পেলেন। একটি বর্ণনায় এসেছে সেই কণ্ঠস্বর ছিল ওই মহিলার পরিবারের কারো, যিনি তেলাওয়াত করছিলেন সূরা হাদীদের (পারা:২৭, সূরা: ৫৭) ১৬ নং আয়াত। বস্তুত এই আয়াতটির সাথে অতীতের অনেক লোকের তওবা এবং অনুতাপ জড়িত।
اَلَمۡ یَاۡنِ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ تَخۡشَعَ قُلُوۡبُهُمۡ لِذِکۡرِ اللّٰهِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الۡحَقِّ ۙ وَ لَا یَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلُ فَطَالَ عَلَیۡهِمُ الۡاَمَدُ فَقَسَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ ؕ وَ کَثِیۡرٌ مِّنۡهُمۡ فٰسِقُوۡنَ
যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি ? আর তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে ইতঃপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারপর তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে গেল। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক।
[৫৭:১৬]
এই আয়াতটি শোনার পরে ফুদাইল (রা:) বললেন, ‘হ্যাঁ, হে আমার প্রভু! এখনই সময়, এখনই সময়।’ তিনি উপত্যকার পিছনে ওই রমনীর বাসায় আর গেলেন না, তিনি ফিরে আসতে লাগলেন। ফিরে আসার পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি একদল কাফেলাকে দেখতে পেলেন। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছিল তারা সামনে এগিয়ে যাবে, নাকি যাবে না। এক দল বলল সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, আরেক দল বলল অপেক্ষা করার জন্য, কারণ ফুদাইল এখন এই রাস্তায় আছে, এবং তারা চাচ্ছে না ফুদাইলের আক্রমণের শিকার হতে।
এভাবে ফুদাইল (রা:) একদল মুসলিমের (খুব সম্ভবত তারা ছিল একদল হুজ্জাজ) কথোপকথন শুনলেন, যারা তাকে ভয় পায়, এমনকি তার সংস্পর্শেও আসতে চায় না। তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে কি যাবে না তা নির্ভর করছে ওই রাস্তায় ফুদাইলের উপস্থিতির উপর।
ফুদাইল (রা:) তখন নিজের দাড়ি ধরে বলতে লাগলেন, ‘আমি আমার রাত অতিবাহিত করছি আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার অবাধ্যতায় ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে, এবং দিনের বেলায় এমন জঘন্য কাজ করছি যে মানুষ আমার ভয়ে ভীত। আল্লাহ সুবাহানাহু তা’য়ালা আমাকে এই কথোপকথন শোনার সুযোগ দিয়েছেন, কারন তিনি চান আমি ফিরে আসি। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে তওবা করছি, এবং মসজিদুল হারামের সান্নিধ্য লাভের জন্য ফিরে আসছি।’
ফুদাইল (রা:) মক্কায় চলে আসলেন কাবার উপস্থিতিতে এবং মক্কার আলেমগণের সাহচর্যে থাকবেন এই প্রত্যাশায়। তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন এবং সুবহানাল্লাহ শেষ পর্যন্ত দুই হারামের ইমাম হলেন। কিন্তু এর আগে তিনি কিছুটা সময় ব্যায় করেছিলেন তার প্রতিটি শিকারকে খুঁজে বের করতে। যারা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং যাদের কথা তিনি মনে করতে পেরেছিলেন তাদের প্রত্যেকের কাছে তিনি গিয়ে তাদের জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন। এরপর তিনি বায়তুল হারামে চলে আসলেন, আর বাকিটা ইতিহাস।
সুবহানাল্লাহ, এই আয়াতটির মাধ্যমে — এখনো কি সময় হয়নি? এখনো কি সময় হয়নি….. আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা প্রতিনিয়ত আমাদের ডাকছেন। আমার, আপনার হৃদয় কি বিগলিত হয়নি?
আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের সময় কি এখন নয়?
জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আসার সময় কি এখনো হয়নি? আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার সময় কি এখন নয়?
ফুদাইলের (রা:) মতো একজন আলেম হয়তো আমরা হতে পারবো না, কিন্তু একজন নম্র এবং ভদ্র মু’মিন হিসেবে তওবা করে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় তো আমরা আশ্রয় পেতে পারি, বিচার দিবসে সিদ্দিকদের, শহীদদের এবং আম্বিয়াদের অনুকূল সঙ্গ তো আমরা পেতে পারি। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের ক্ষমা করেন, আমাদেরকে নির্বোধদের অন্তর্ভুক্ত না করেন। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার কাছে আরো প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর আহবানে সাড়া দেওয়ার এবং সেই আহবানের উপর মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করেন। আল্লাহুম্মা আমীন!
চোর থেকে আলেম!
কুরআনের মানুষ
পর্ব : ২৭
মূল: ড. ওমর সুলাইমান