আল্লাহর ৯৯ নাম নিয়ে আজ কিছুটা আলোচনা করা যাক। আমি আপনাদের বলবো, কি কারণে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আপনি যদি পৃথক পৃথক ভাবে এই নাম গুলো নিয়ে চিন্তা করেন, তাহলে তা কিন্তু আপনাকে আল্লাহ তা’লার সাথে তেমন ভাবে সম্পর্কিত করবে না। আপনাকে ‘আর রাহমান‘ এর সাথে ‘আর রাহিম‘ এর সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, ‘আল গফুর‘ এর সাথে ‘আল ওয়াদুদ‘ এর সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, ‘আর রাজ্জাক‘ এর সাথে ‘আল ওয়াকিল‘ এর সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আল্লাহর এই ৯৯ নামের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো, এর যে কোনো একটি নামের সাথে যদি আপনি নিজের সম্পর্ক স্হাপন করতে পারেন, তাহলে কিন্তু আল্লাহর ৯৯ নামের সাথেই আপনি সম্পর্কিত হলেন। এই ৯৯ নামের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা কিন্তু পরিণামে এক সৃষ্টিকর্তার সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করা। আর এর সবই আপনাকে নিয়ে আসে আল্লাহ তা’লার কাছাকাছি। কাজেই আমাদের চিন্তা করতে হবে কতটা সমানুপাতিক ভাবে আমরা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত।
রাসুল (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহর ৯৯ নাম আছে। যে এই নামগুলো মনে রাখবে, বুঝবে, উপিলব্ধি করবে, নিজের জীবনে এর পূর্ণতা ও স্বীকৃতি দিবে, সে জান্নাতে যাবে।”
এর মানে হলো, যত বেশী আপনি এই ৯৯ নামের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করবেন, তত বেশী আল্লাহর সাথে আপনি আপনার সম্পর্কে দৃঢ় করবেন। আল্লাহর কোনো নামের সাথে যদি আপনার সম্পর্ক কম থাকে, তাহলে আল্লাহর সাথেও আপনি কম সম্পৃক্ত হলেন। কাজেই আমাদের উপায় খুঁজে বের করতে হবে, আমাদের পারিপার্শ্বিকতার উপর ভিত্তি করে, কিভাবে আমরা আল্লাহর প্রতিটি নামের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। আর কেন তা আমাদের জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ?
আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا ۖ
"আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সবচেয়ে উত্তম নাম। কাজেই সেই নাম ধরেই তাকে ডাকো।"
[৭:১৮০]
আপনাকে চিন্তা করতে হবে, আপনার দোয়ায়, প্রার্থনায় আল্লাহর কয়টা নাম আপনি ব্যবহার করছেন। আপনি কি শুধু আল্লাহ নামটির সাথেই নিজেকে সংযুক্ত করেছেন, নাকি পরম দয়াময়, করুনাময় ‘আর রাহমানুর রাহিম‘ এর সাথেও নিজের সংযোগ স্থাপন করেছেন। আপনি কি ‘আর রাজ্জাক‘ সহ আরো সব আল্লাহর সুন্দর নামাবলীর সাথে নিজের সংযোগ স্থাপন করেছেন, নাকি শুধু আল্লাহ নামটিই আপনার দোয়ায় বারবার ব্যবহার করছেন। কোরআনের এই আয়াতটি [৭:১৮০] দেখার পর, আমাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করা উচিত, আল্লাহর এই সুন্দর নাম গুলোকে কিভাবে আমাদের জীবনে, আমাদের প্রার্থনায়, দোয়ায় আমরা স্থান দিতে পারি। আল্লাহর এই নামাবলীর সাথে যদি আমরা নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলে আল্লাহ তা’লার সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হবে জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিকে। দিন শেষে আল্লাহর এই নিরানব্বইটি নামকে আমাদের অন্তরে, মননে, চিন্তায়, চেতনায়, জিহ্বায় একত্রীভূত করে, আমরা নিজেরাই নিজেদের জীবনকে করে তুলতে পারি মহিমান্বিত। এইভাবে আল্লাহ তা’লার ধ্যানে নিজেকে ব্যাস্ত রেখে, আমাদেরকে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে ভাবতে হবে, আরো ভাবতে হবে কোন আঙ্গিকে, কিভাবে আমরা আল্লাহর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারি। আমাদের খুব সচেতন ভাবে চিন্তা করতে হবে কিভাবে আমরা এই সবগুলো নামকে আমাদের দোয়ায় স্থান দিতে পারি।
আল্লাহর বিশেষ কোনো নামের সাথে আমি নিজের সংযোগ স্থাপন করলাম না, কারণ পবিত্র কোরআনে এই নামের ব্যাপারে আমি পড়েছি, জেনেছি, বা চিন্তা করেছি, কিন্তু আমার জীবনে বিশেষ কোনো পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার আগে, এই নামটি নিয়ে আমি হয়তো চিন্তায় করি নি বা চিন্তার প্রয়োজন মনে করি নি। উদাহরণ স্বরূপ, ধরা যেতে পারে, আগে আমার আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমি কখনো উদ্বিগ্ন ছিলাম না, কারণ আর্থিক ভাবে আমি স্বচ্ছল ছিলাম। তখন ‘আর রাজ্জাক‘ বা রিজিক দানকারী নামটি আমার মাথায় তেমন ভাবে ছিল না, বা তা আমার চিন্তা, চেতনাকে তেমন ভাবে আচ্ছন্ন করে নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, আর্থিক ভাবে আমি আগের মতো তেমন স্বচ্ছল নই। এখন প্রতিনিয়তই রিজিকের চিন্তা আমাকে করতে হচ্ছে। কাজেই আল্লাহর এই নামটিকে এখন শুধু ভালোভাবে বুঝলেই হবে না, আমার প্রতিদিনের দোয়ায় এই নামটিকে স্থান দিতে হবে।
এই ভাবেই আমার অবস্থান বা পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে আল্লাহর বিভিন্ন নাম নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হবে, এবং উপলব্ধি করতে হবে কিভাবে এই নামটিকে আমি আমার জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারি। আমাদের জীবনে অবস্থার পরিবর্তনের একটি বিশেষ আশীর্বাদ হলো, তা আমাদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করে ভিন্ন আঙ্গিকে। আপনি আল্লাহকে কষ্টের সময় এক ভাবে স্মরণ করেন, শান্তির সময় আরেক ভাবে স্মরণ করেন। ভয়ের সময় এক ভাবে স্মরণ করেন, আবার স্বস্তির সময় আরেক ভাবে স্মরণ করেন। আপনার জীবনের বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি আল্লাহকে স্মরণ করেন বিভিন্ন ভাবে। যদিও আপনি আল্লাহকে বিভিন্ন নামে ডাকেন না, কিন্তু আপনি তাকে স্মরণ করছেন বিভিন্ন ভাবে। আপনার প্রার্থনা বা দোয়ার প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে আপনার পরিবর্তিত অবস্থার উপর ভিত্তি করে। আপনার উচিৎ, খুব সচেতন ভাবে এই নাম গুলো আপনার দোয়ায় বা প্রার্থনায় অনুপ্রবেশ করানো, যাতে জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে আল্লাহ তা’লাকে আপনি সম্পর্কিত করতে পারেন।
তারপর, এর উপর যোগ করতে পারেন আরেকটি প্রলেপ। আপনার চারপাশে আপনি যাই পর্যবেক্ষণ করুন না কেন, তা আপনি সম্পর্কিত করতে পারেন আল্লাহ তা’লার যে কোনো নামের সাথে। যখন কারো মাঝে আপনি করুনা বা বদান্যতা দেখবেন, তখন সাথে সাথেই আল্লাহর ‘আল কারিম‘ নামটি আপনার মনে আসবে। যখন কারো মাঝে ভালোবাসা দেখবেন, তখন ‘আল ওয়াদুদ’ নামটি আপনার মনে এসে যাবে।
যখন কোনো সুন্দর নির্মান দেখবেন, তখন আল্লাহর ‘আল মুসাওয়ার‘ নামটি নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন। যখন সৃষ্টির বিশালতা দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন, তখন ‘আল খালিক‘ নামটা আপনার মাথায় আসবে। যখন কেউ আপনাকে বিশ্বাস করে বা আপনি কাউকে বিশ্বাস করেন, তখন ‘আল ওয়াকিল’ নামটি আপনার মনে আসে। এই নামগুলো স্বভাব বশতই আপনার মনে আসে, আপনার পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে।
আসুন, আমাদের প্রার্থনায় সচেতন ভাবে, আল্লাহর নাম গুলোকে আমরা স্মরণ করি, আজ বেতের নামাজ থেকেই শুরু করা যাক। প্রতিদিন বেতের নামাজ শেষে আল্লাহর একটি করে নাম জানুন ও শিখুন। Yaqeen website এ এই সিরিজ গুলো দেখতে পারবেন। “To Know Him is to Love Him” শেখ মুহাম্মদ এখানে নাম গুলো সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। আল্লাহর নাম গুলো সত্যিকার ভাবে যদি আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রতি আমাদের বিশ্বাস দৃঢ় হবে, আর তখন বিশ্বাস সংক্রান্ত কোনো সমস্যা যদি আমাদের মনে থাকে, তার সমাধান ও হবে। কাজেই প্রথমত, আমাদের সচেতন ভাবে, আল্লাহর নাম গুলোকে আমাদের দোয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নাম গুলোকে শুধু নাশীদ হিসাবে মুখস্ত করলেই চলবে না। আমার দোয়ায় বা প্রার্থনায়, আল্লাহর কোনো নাম যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, আমার জীবনের সেই বিশেষ আঙ্গিকে, আমি নিজেকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করতে পারি নি।
যদি আল্লাহর কোনো নামকে আমার দোয়ায় আমি ব্যবহার না করি, বা আমার পারিপার্শ্বিকতার সাথে সম্পর্কিত না করি, তাহলে বুঝে নিতে হবে, আমার সৃষ্টিকর্তার সাথে ঐ বিশেষ দিকটিতে আমি সম্পর্ক স্থাপনে ব্যার্থ হয়েছি। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে, সর্ব পরিস্থিতিতে, আমাদের আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, আর তা তখনি সম্ভব হবে, যখন আল্লাহর প্রতিটি নামের সাথে আমরা সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবো। আল্লাহর প্রতিটি নামই আসলে একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। প্রশ্ন হচ্ছে এই নাম গুলোকে তাৎক্ষণিক ভাবে আমরা আমাদের হৃদয়ে, মননে, চিন্তায়, চেতনায় জাগ্রত করতে পারি কিনা। প্রাথমিক ভাবে, এটাকে আমরা একটা assignment হিসাবে নিতে পারি। প্রতিদিন বেতের নামাজ শেষে, আল্লাহর নতুন কিছু নামকে আমাদের দোয়ায় স্থান দিয়ে, আল্লাহ তা’লার সাথে আমরা নিজেদের সম্পর্কিত করতে পারি বিভিন্ন আঙ্গিকে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে কিভাবে আমরা আল্লাহ তা’লাকে সম্পর্কিত করবো। যখন আমার জীবনে নতুন কোনো দিক উন্মচিত হবে, তখন আমাকে চিন্তা করতে হবে, এর সাথে আমি কিভাবে আমার সৃষ্টিকর্তাকে সম্পর্কিত করতে পারি।
তৃতীয়ত, আমি প্রথমেই ৯৯ প্রভু বনাম এক প্রভুর ৯৯ নামের পার্থক্যের প্রসঙ্গে বলেছি। যত বেশী আমি ‘আর রহমান’ এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবো, তত বেশী আমি ‘আর রাজ্জাক’ এর সাথে সম্পর্কিত হবো। যত বেশী আমি আল্লাহর প্রতিটি নামের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করবো, তত বেশী সামগ্রিক ভাবে আমি আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত হবো।
আমাদের জীবনের সব চেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো, প্রাপ্তি বা বঞ্চনা যাই হোক না কেন, কষ্ট বা স্বস্তি যে পরিস্থিতেই থাকি না কেন, তা কিন্তু আমাদের সাহায্য করে আল্লাহ তা’লার সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে। অনন্য সেই পরিস্থিতির এটাই হলো সবিশেষ আশীর্বাদ, কারণ তা আমাদের বাধ্য করে, ভাবতে ও পুনর্বিবেচনা করতে, আমাদের বিশ্বাসের কোন উপাদানকে আমরা বর্জন করবো, আর কোনটা গ্রহণ করবো। প্রথমত, আপনি পুনর্বিবেচনা করবেন, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কোন দিকটা আপনি অবহেলা করেছেন, যা আপনার জীবনের সাথে সম্পর্কিত ছিল। আবারো ফিরে আসি সেই আয়াতটিতে “আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সবচেয়ে উত্তম নাম। কাজেই সেই নাম ধরেই তাকে ডাকো।” [৭:১৮০]
পরিশেষে বলতে চাই, যা আমার প্রথমেই বলা উচিৎ ছিল, আল্লাহর নাম গুলোর সাথে সম্পর্কিত হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আপনার দোয়ায় নাম গুলোকে ব্যবহার করার পরে, পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নামগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার পরে, আল্লাহর নামের এই গুণাবলীকে নিজের মধ্যে রপ্ত করার চেষ্টা করা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, আল্লাহ হলেন ‘আল করিম’ অর্থাৎ মহানুভব। আমি ‘আল করিম’ হতে পারবো না, কারণ মানুষের মহানুভবতা আল্লাহর মহানুভবতার মতো হতে পারে না। কিন্তু আমি মহৎ হতে পারি। আমি যত বেশী মহৎ বা দয়ালু হবো, তত বেশী আমি আমি আল্লাহর ‘আল করিম’ নামটির সাথে সম্পৃক্ত হবো।
আমি দয়ালু হতে পারি, কিন্তু আমার দয়া কখনোই আল্লাহর দয়ার সমকক্ষ হবে না। কিন্তু, তারপরেও আমি যদি দয়ালু হই, নিঃসন্দেহে আমি পরম দয়াময় আল্লাহর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করলাম। আল্লাহর প্রতিটি নামের সাথেই কিছু মানবীয় গুণাবলী রয়েছে, (যদিও মানুষের পক্ষে আল্লাহর গুণাবলীকে ধারণ করা সম্ভব নয়) যা রপ্ত করার চেষ্টা করতে পারি আমাদের চরিত্রে। আমাদের ভাবতে হবে, কিভাবে এই নাম গুলোর গুণাবলীকে আমাদের জীবনে রপ্ত করার চেষ্টা করতে পারি। হোক না তা ন্যায়বিচার, ভালোবাসা বা করুণা, যেভাবেই হোক আমাকে তা রপ্ত করার চেষ্টা করতেই হবে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন,
“পৃথিবীতে সবার প্রতি দয়া পরাবশ হন, তাহলে জান্নাতে যিনি আছেন, তিনিও আপনার প্রতি দয়াশীল হবেন।”
হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সবাইকে আশীর্বাদ করুন, আপনার প্রতিটি নামের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে আপনার সাথে যেন আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়।
আল্লাহুম্মা আমিন।