হাশরের ময়দানে পশু-পাখীদের অবস্থা এবং দশটি পশু-পাখীর জান্নাতে প্রবেশ।
পরকালে পশু-পাখীদেরকেও কি পুনরুত্থিত করা হবে? আর শোনা যায় যে, দশটি পশু বা প্রাণীও জান্নাতে যাবে। এ কথা কি সত্য?
এ কথা সঠিক যে, হাশরের ময়দানে মানুষের পাশাপাশি সকল পশু-পাখি ও জীব-জন্তুও পুনরুত্থিত হবে এবং দুনিয়াতে যে সব পশু-পাখী অন্য পশু-পাখীর উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছিলো বা একে অপরের প্রতি জুলুম করেছিলো সে দিন মহান আল্লাহ তাদের থেকে কেসাস বা সমপরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। তারপর আল্লাহর হুকুমে সেগুলো পুনরায় মাটিতে মিশে যাবে। অর্থাৎ সেখানেই তাদের যবনিকা ঘটবে। এরপর তাদের জান্নাত বা জাহান্নামে যাওয়ার আর কোনও প্রশ্ন থাকবে না।
পক্ষান্তরে মানুষের পাপ-পুণ্য হিসাব-নিকাশ ও পারস্পারিক জুলুম-অবিচারের বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর তাদেরকে চীর সুখের নীড় জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তির স্থান জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
কুরআন-হাদিস এবং সাহাবী ও মুসলিম মনিষীদের মতামতের আলোকে এটাই সঠিক কথা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَت
“আর যখন বন্য পশুদেরকে (হাশরের মাঠে) সমবেত করা হবে।”
(সূরা তাকবীর: ৫)
কাতাদা রহ. এ আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন,
هذه الخلائق موافية يوم القيامة، فيقضي الله فيها ما يشاء
“এ সকল সৃষ্টি জীবকে কিয়ামতের দিন মানুষের সাথে পুনরুত্থিত করার পর আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে তাদের মাঝে বিচার-ফয়সালা করবেন।”
(তাফসিরে ইবনে কাসির) তবে এর ব্যাখ্যায় ভিন্ন মতও আছে।
তিনি আরও বলেছেন,
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الأَرْضِ وَلا طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ
“আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখী দু’ ডানাযোগে উড়ে বেড়ায় তারা সবাই তোমাদের মতই একেকটি শ্রেণী। আমি কোন কিছু লিখতে ছাড়ি নি। অতঃপর সবাইকে তাদের প্রতিপালকের কাছে সমবেত করা হবে। (সূরা আনআম: ৩৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
يحشر كل شيء حتى الذباب
“সব কিছুকেই সমবেত করা হবে; এমনটি মাছিকেও।” (তাফসিরে ইবনে কাসির)
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَتُؤَدُّنَّ الْحُقُوقَ إِلَى أَهْلِهَا حَتَّى يُقَادَ لِلشَّاةِ الْجَلْحَاءِ مِنْ الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ-صحيح مسلم- كتاب الْبِرِّ وَالصِّلَةِ وَالْآدَابِ- بَابُ تَحْرِيمِ الظُّلْمِ- حديث رقم 4807
“তোমরা অবশ্যই প্রত্যেক পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করে দিবে। (অন্যথায় কিয়ামতের দিন অবশ্যই তা পরিশোধ করা হবে।) এমনকি একটি শিং বিশিষ্ট ছাগল যদি দুনিয়াতে কোনও শিং বিহীন ছাগলকে গুঁতা মেরে থাকে তাহলে তার থেকে শিং বিহীন ছাগলের জন্য প্রতিশোধ নেয়া হবে।”
[সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: সৎকর্ম, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, অনুচ্ছেদ: জুলুম করা হারাম]
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
يقضي الله بين خلقه الجن والإنس والبهائم ، وإنه ليقيد يومئذ الجمَّاء [التي: لا قرن لها ] من القرناء ، حتى إذا لم يبق تبعة عند واحدة لأخرى قال الله : كونوا ترابا ، فعند ذلك يقول الكافر : { يا ليتني كنت تراباً قال الشيخ الألباني : صحيح . انظر السلسلة الصحيحة.
‘আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন জিন, মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর মাঝে বিচার-ফয়সালা করবেন। এমনকি দুনিয়ায় কোনও শিং বিশিষ্ট জন্তু কোনও শিং বিহীন জন্তুকে আঘাত করে থাকলে সে তার প্রতিশোধ নিবে। যখন একটি পশুরও অন্য পশুর প্রতি কোনও দাবী-দাওয়া ও অভিযোগ থাকবে না তখন আল্লাহ বলবেন, “তোমরা মাটি হয়ে যাও।”
এ সময় কাফিররা আক্ষেপ করে বলবে, يَا لَيْتَنِي كُنتُ تُرَابًا “হায় আফসোস! আমিও যদি মাটি হয়ে যেতাম।”
(সূরা নাবা: ৪০)
[তাফসিরে তাবারি ২৪/৫৫, শাইখ আলবানি সিলসিলা সহিহা গ্রন্থে এ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
দুনিয়ার কিছু পশু-পাখী কি জান্নাতে প্রবেশ করবে?
কিছু কিছু তাফসিরের কিতাবে দুনিয়ার বেশ কিছু জন্তু-জানোয়ারের জান্নাতে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর পক্ষে হাদিসের কোন দলিল নাই। সুতরাং দলিল ছাড়া এ জাতীয় কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
যেসব প্রাণী জান্নাতে প্রবেশ করবে বলা হয় সেগুলো হল:
কিন্তু মুহাক্কিক আলেমদের মতে, এ সব প্রাণী জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে কোন হাদিস বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয় নি। তাছাড়া পূর্বোল্লিখিত হাদিসের আলোকে আমরা জেনেছি যে, হাশরের ময়দানে সকল পশুপাখিকে পুনরুত্থানের পর তাদের মাঝে বিচারকার্য সংঘটিত হবে। তারপর আল্লাহর হুকুমে তারা আবার মাটিতে মিশে যাবে। উক্ত হাদিসেও এই দশটি প্রাণীর জান্নাতে প্রবেশের কথা বলা হয় নি। সুতরাং দলিল ছাড়া এসব পশুপাখি জান্নাতে প্রবেশ করবে এমন কথা বলার সুযোগ নাই।
আল্লাহু আলাম।