Writing

হরেক প্রেমের প্রেমিক

মামুন হাত ধুতে বেসিনে গেল। এই ফাঁকে রবিন এসে শোয়েবের কানের কাছে মুখ রেখে বললো, ‘দেখেছিস, গর্দভটা এখানে এসেও সেই একি কাণ্ড করেছে। এজন্যই বলেছিলাম, ওকে নিয়ে আসার দরকার নেই। রেস্টুরেন্ট ভর্তি লোকজন। বা পাশের দ্বিতীয় টেবিল থেকে একজন তো এখনও এদিকে তাকিয়ে আছে। ছিঃ। লজ্জা করছে আমার। শোয়েব বললো, ‘হয়েছে থাক, মামুন শুনবে। রবিন বললো, ‘শুনলে শুনবে। ওকে বলে দিবি, এরপর আমাদের সঙ্গে এলে যেন এসব পাগলামি বাসায় রেখে তারপর আসে। মূর্খ কোথাকার! কথাগুলো বলেই রবিন চলে গেল।
মামুন এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘রবিন কোথায়?

শোয়েব সহজভাবে উত্তর দিল, ‘চলে গেছে।
‘চলে গেছে মানে! হঠাৎ চলে যাবে কেন? কোনো কাজ আছে নাকি ওর?
‘জানি না।
‘কিছু বলে যায়নি তোকে?

‘শোয়েব কোনো উত্তর দিলো না। সে গ্রিল চিবুচ্ছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা অন্যমনস্ক। হাতের খাবারটা শেষ করেই আচমকা বলে উঠলো, ‘আচ্ছা, তোর কি রেস্টুরেন্টে এসেও প্লেট চেটে খেতে হয়? এটা তো পাব্লিক প্লেস। এমন তো নয় যে খাবার খাওয়ার পর প্লেট চেটে না খেলে জাহান্নামে যেতে হবে। আমার জানামতে এটা একটা সুন্নত কাজ। আর সুন্নত তো ফরজের মতো অতটা গুরুত্বপূর্ণ না।

মামুন থমকে দাঁড়ালো। এসব কথা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। গলার স্বর নরম করে বললো, ‘রবিন কি তাহলে এজন্যই রাগ করে চলে গেছে? আসলে ব্যাপারটা অতটাও জটিল না যে এটা না করলে জাহান্নামে যেতে হবে। কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেছে তো তাই খেয়াল করিনি। স্যরি রে দোস্ত। আচ্ছা দাঁড়া আমি রবিনকেও স্যরি বলে দিচ্ছি। মামুন মোবাইল হাতে নিয়ে রবিনকে ফোন দিলো। কিন্তু ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো না।

শোয়েব বললো,
‘বিষয়টা যে আজকেই প্রথম ঘটেছে এমনটা না। গত সপ্তাহে নুরুর বিয়েতে গিয়েও তুই এমনটা করেছিস, মনে আছে? অনেকগুলো মানুষ আঁড়চোখে তোকে দেখছিল বারবার। লজ্জার কথা না?
তুই-ই বল?
মামুন জিভে কামড় দিয়ে ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টি কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না।

একটা সময় ওরা তিনজন খুবই ক্লোজ-বন্ধু ছিল। তাদের চলাফেরায় যেমন কোনো বৈপরীত্য ছিল না, তেমনি ঐক্যের মোড়কে ঢাকা ছিল তাদের চাহিদা আর প্রয়োজনগুলোও। বোধহয় এই নিয়মকে সাঙ্গ করতেই গত এক মাস ধরে মামুনের চলাফেরায় একরকম ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। প্রথমবার সে তিনদিনের জন্য তাবলীগে যায়, ওখান থেকেই পরিবর্তনের সূচনা। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে শুরু করে। কিছুদিন পর আবারো চলে যায় চিল্লায়। চিল্লা থেকে আসার পর পরিবর্তনের ছুঁয়া যেন পুরোপুরিভাবেই তাকে আবৃত করে নেয়। সেই থেকেই এমন কিছু কাজ তার থেকে প্রকাশ পাচ্ছে, যেগুলো তাদের নিগূঢ় বন্ধুত্বের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এতে সবচেয়ে বেশি রিয়্যাক্ট করছে রবিন। ও হচ্ছে মর্ডান ধরনের ছেলে। রবিন মনে করে সবকিছুর জন্য আলাদা একটা বয়স আছে। নির্দিষ্ট কাজটা তার জন্য নির্ধারিত সময়ে করাটাই একজন পারফেক্ট মানুষের আলামত। আর ধর্মকর্ম পালনের জন্য বয়স হচ্ছে বার্ধক্য। এর আগের সময়টা হচ্ছে এনজয় এবং সুখের সম্বল গড়ার জন্য। এ সময়ে অন্য কিছু নয়।

অনেক চেষ্টার পরেও রবিনকে সেদিন ফোনে পাওয়া গেল না। মামুন বুঝে উঠতে পারলো না এদেরকে কীভাবে দ্বীন সম্পর্কে বুঝানো যেতে পারে। বন্ধু হিশেবে তার সেটা করা উচিৎ। কিন্তু মন টানলেও একরকম জড়তার কারণে ঘটনাটা সে ঘটাতে পারছে না। ওরা যদি ঠাট্টাচ্ছলে হাসতে থাকে কিংবা দ্বীন নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসে, এই ভয়ে।

মামুনের তখন অনেক খারাপ লাগে যখন আজান শুনার পর সে একা উঠে মসজিদে যায় আর বাকি দু’জন বসে থাকে। ওরা অবশ্য মামুনকে বলে, ‘তুই নামাজ পড়ে আয় আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করছি। মামুন তখন নামাজে চলে যায়। কিন্তু তার খুব বলতে ইচ্ছে করে, ‘তোরাও চল না, একসঙ্গে নামাজটা পড়ে আসি। দেখ নামাজ পড়লে কেমন ভালো লাগে।’ কিন্তু কেন যেন এই সামান্য কথাগুলোও সে তখন বলতে পারে না। বলতে গেলেই মুখ আটকে যায়। কে যেন মুখ খুলতে দেয় না। এক অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা।

মামুনের ইচ্ছা ছিল ক’দিনের মধ্যেই ওদেরকে দ্বীনের দাওয়াতটা দিয়ে দিবে। এর জন্য সুযোগ বের করার চেষ্টাও সে করেছে। কিন্তু সে যতোই সামনে এগুতে চাচ্ছে সুযোগ যেন তাকে ততোই পিছনে নিয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিল আজই কিছু কথা সে তাদেরকে বলে ফেলবে। কিন্তু এই দিনেই তার সঙ্গে এমন একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। এরপর আবার কবে একসঙ্গে বসে কথা বলার সুযোগ হবে তাও জানা নেই। রবিন অনেক জেদি ছেলে। ওকে বুঝিয়ে বললেও তেমন লাভ হবে না। সে সবসময় নিজের জায়গাতে অনড় হয়ে থাকবে। কিছুতেই কোথাও দুর্বল হবে না।

তার অবশ্য একটা দুর্বলতার জায়গা আছে। সেটা হচ্ছে তিন্নি। তিন্নি হলো তার ভালো লাগার একজন মানুষ। তিন্নির জন্য সে সবকিছুই করতে পারে। এ পর্যন্ত অনেক পাগলামি সে তিন্নির জন্য করেও ফেলেছে। বোধকরি তিন্নি বললে রাস্তার মাঝখানে এসে একসঙ্গে একশোটা ডিগবাজিও সে দিতে রাজি হবে।

একদিন দুপুরবেলা রবিন আর তিন্নিকে পার্কের এক বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখা গেল। হেঁসে হেঁসে কথা বলছে দু’জন। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই দেখা গেল দুজন দুজনকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। পাশে বসে থাকা কিছু ছেলে মেয়েদের লোভাতুর দৃষ্টি তাদের উপর পরছে। রবিন কিংবা তিন্নি তাদের কেউই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করবার প্রয়োজন বোধ করছে না। তারা সহজভাবেই খেয়ে যাচ্ছে।

ভুল করেই হোক কিংবা ইচ্ছাকৃত— রবিনের একবার দৃষ্টি চলে যায় পাশের বেঞ্চে বসে থাকা একজন সুন্দরীর দিকে। মেয়েটাও দুষ্ট, রবিনকে হাই হ্যান্ডসাম বলে হাঁসতে লাগলো। এদিকে তিন্নির তো গা জ্বালাপোড়া অবস্থা। হাস্যজ্বল চেহারাখানা মুহূর্তেই অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল। শুরু হলো রবিনের কাকুতি-মিনতি আর নিজেকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা। কিন্তু তিন্নির কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে শুধু রাগে ফুঁসছে। অনেকক্ষণ ধরে রবিনকে তিন্নির সামনে গিয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে দেখা গেল। কিন্তু এতেও যেন তিন্নির মনে সামান্যতম দয়ার সঞ্চারও হলো না।

সবশেষে পার্কে থাকা সবগুলো মানুষের সামনেই রবিনকে কানে ধরে ওঠবস করতে হলো। এক-দু’বার নয়, গুনে গুনে দশ বার। রবিনকে শাস্তি দিতে পেরে তিন্নি যেন খুশিতে আটখানা। রবিনের ভাবটাও এমন যেন তারও কিছুই হয়নি। একটু আগেও যে এতগুলো মানুষ তাকে দেখে হেসেছে এতে যেন অস্বস্তির কোনই কারবার নেই। পূর্বেকার মতো আবারো খুনসুটিপূর্ণ প্রেমে মেতে উঠেছে দুজন। এই না হলে ভালোবাসা?

ফেরার সময় বাইকে বসতে যেয়ে সেখানে একটা কাগজের টুকরো পেল রবিন। কৌতুহল বশত হাতে নিয়ে সেটা সে পড়তে লাগলো। তাতে লেখা ছিল;
“আফসোস! প্রেমের তাগিদে যে প্রেমিক জনসম্মুখে দাঁড়িয়েও কান ধরতে দ্বিধা করেনি, সে কেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসায় প্লেট চেটে খাওয়ার প্রেমটা বুঝতে পারবে না?”

লাইনগুলো সে কয়েকবার পাঠ করল। কিছু একটা বুঝতে পেরেও যেন বুঝতে পারছে না। রবিন দেখলো গাঢ় উজ্জ্বলের সূর্যটা তখন হলদে হতে শুরু করেছে। পাখিরাও উড়ে যেতে শুরু করেছে আপন আপন নীড়ে। শহরের চারিদিকে মানুষের কোলাহল। সবাই ব্যস্ততার অজুহাতে ছুটে চলছে এখান থেকে ওখানে। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করছে না। রবিন হঠাৎ করেই অনুভব করলো তার চোখদুটো ভিজে উঠেছে।

লিখেছেন

Picture of নাজমুল হুদা

নাজমুল হুদা

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Visit all other posts by this author

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture