মেয়েদের দিক থেকে চিন্তা করলে একটি বিয়ে যতোটা সুখের, ঠিক ততোটা না হলেও অনেকটা কষ্টের। নিজের চিরচেনা আবাস ছেড়ে অজানা, অচেনা একটি বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা। ‘কবুল’ বলার সাথে সাথে ‘বাড়ি কোথায়?’ প্রশ্নটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ হয়ে যায়। পাল্টা জিজ্ঞেস করতে হয় অথবা আলাদাভাবে বলতে হয়- ‘বাপের বাড়ি…,জামাইর বাড়ি…’।
একটি বাড়ি, বাড়ির জিনিসপত্রের সাথে আমাদের কতো স্মৃতি লুকিয়ে থাকে। বাড়ির প্রতিটি মানুষের রুচি, খাদ্যাভ্যাস, আচরণ সবকিছুই খুব পরিচিত। সবকিছুর সাথে এক-জীবন পার করার পর এগুলো আপন হয়ে যায়, এগুলোর প্রতি মায়া জন্মে যায়।
তারপর একদিন আসে…সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হয়। এতোদিনের পরিচিত এক পরিবেশকে বিদায় জানানোটা নিশ্চয়ই সুখকর হবে না।
ছোটোবেলা কমিউনিটি সেন্টারে পাত্রী বিদায়ের সময় পাত্রীর কান্না দেখতাম। চারিদিকে যখন উৎসব-উৎসব আমেজ, তখন একজন মেয়ে এভাবে কাঁদবে কেনো?
একটু আগেও তো সে হাসিখুশি ছিলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে শতকরা নব্বইজন মানুষ উৎফুল্ল থাকলেও দশজন মানুষের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যেতে চায়। কারো কাছে তার বোন চলে যাবার কষ্ট, কারো কাছে মেয়ে চলে যাবার কষ্ট। আর পাত্রীর থাকে মিশ্রানুভূতি। বিয়ের আনন্দের সাথে দীর্ঘদিনের লালিত-পালিত হওয়া জায়গা থেকে প্রস্থানের কষ্ট।
একসময় যে ঘরটি ছিলো নিজের ঘর, পরবর্তীতে ‘বেড়াতে এসে’ সেই ঘরে থাকতে হবে। বাবা-মায়ের মুখে তোলা খাবার খাওয়া, ছোটো ভাই-বোনদের সাথে দুষ্টুমি করা, ইচ্ছেমতো খাবার খাওয়া, ঘুমানো একটি মেয়ে হঠাৎ করে তার জীবনাচার পরিবর্তন করতে হয়। কথা বলতে হয় মেপে মেপে, হাসতে হয় বুঝেশুনে।
বিয়ের মাধ্যমে একজন মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে জামাইর বাড়ি স্থানান্তরিত হয়। পুরনো আবেগকে সাথে নিয়ে পথচলা শুরু হয় নতুন আবেগের। নতুন পরিবেশ তাকে যতোই সাদরে স্বাগত করুক না কেনো, সেটা কখনোই তার পুরনো পরিবেশের স্থানপূরণ করবে না। নতুন পরিবেশের ঘরের স্ট্রাকচার যদি হুবহু পুরনো স্ট্রাকচারেও সাজানো হয়, তবুও তো সেখানে নেই তার বাবা-মা, স্থানান্তরিত স্থানের সাথে নেই তার স্মৃতি। প্রথম দিন থেকে শুরু করতে হয় নতুন স্মৃতির চাষাবাদ।
সাহাবীরা মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনার নতুন পরিবেশে তো তারা সহজে, নিরাপদে ধর্মচর্চা করতে পারবেন। এটা সত্ত্বেও প্রথম-প্রথম মদীনার পরিবেশ তাঁদের ভালো লাগলো না। আবু বকর, বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) তো নতুন পরিবেশে এসে জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েন। বিলাল (রা:) জোরে জোরে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। কী ছিলো তাঁর কবিতায়? সেই চিরচেনা মক্কায় ফিরে যাবার আকুতি, কবিতার বিনিময়ে হলেও মক্কার প্রান্তরে অন্তত একটি রাত কাটানোর আবদার।
“হায়! আমি যদি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে মক্কার প্রান্তরে একটি রাত কাটাতে পারতাম,
আর আমার চারিদিকে থাকতো ইযখির এবং জালীস ঘাস…!”
মক্কায় ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা করছেন এমন একজন মানুষ, মক্কায় যাকে নির্যাতন করা হতো, যার গলায় কুকুরের মতো রশি পড়ানো হয়েছিলো ইসলাম গ্রহণের জন্য। সেই বিলাল (রা:) মক্কায় মাত্র একরাত থাকার জন্য কতো কাকুতি-মিনতি করছেন!
মানুষের এই সহজাত আবেগকে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীকৃতি দেন। জন্মভূমির প্রতি সহজাত ভালোবাসা থাকাটাই তো স্বাভাবিক। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ করেন,
“হে আল্লাহ! মদীনাকে আমাদের কাছে মক্কার মতো বা তারচেয়েও বেশি প্রিয় করে দাও।”
[সহীহ বুখারী: ১৮৮৯]
একজন মেয়ে তার সেই প্রিয় জন্মস্থান ছেড়ে জীবনের প্রায় মধ্যাহ্নে আরেক দিগন্তে হেলে পড়ে। সে উদিত হয় এক দিগন্তে, অস্ত যায় আরেক দিগন্তে। জীবনের মধ্যাহ্নে তার এই দিগন্ত পরিবর্তনকে আমরা ‘বিয়ে’ বলে অভিহিত করি।
মা-বাবা, যাদেরকে ছাড়া আমরা থাকতে পারি না, যাদের ছাড়া আমাদের অনাগত ভবিষ্যত কাটানো কল্পনাও করতে পারি না, একজন মেয়ে তার মা-বাবাকে ছাড়াই কাটাতে হয় জীবনের শেষ অধ্যায়। মাঝেমধ্যে মা-বাবার কাছে ‘বেড়াতে’ যাওয়া হয়; এই আরকী। একসময় ফোন আসে- “আপু, আব্বু/আম্মু নেই। তাড়াতাড়ি আয়!”
বাবা-মার জীবিত মুখ দেখে যে বাড়ি থেকে সে বিদায় নিয়েছিলো, একসময় সেই বাড়িতে ঢুকতে হয় বাবা-মার মরা মুখ দেখতে। জীবনের শেষভাগে বাবা-মার সেবা করার সুযোগটাও সে পায় না। অসুস্থ হলে সবসময় দেখতে যাবার অনুমতি, সুযোগও মিলে না।
বিয়ের মাধ্যমে একটি নতুন পরিবারে আসার সাথে সাথে একজন মেয়ে অনেক কিছু ত্যাগ করে আসে। সে ফেলে আসে তার সোনালী অতীতকে, ঘরজুড়ে দুষ্টুমির স্বাধীনতাকে। বিয়ের আনন্দের মধ্যে ঢেকে যায় এইসব কষ্টানুভূতি। ভাগ্য ভালো হলে নতুন পরিবেশ তাকে আপন করে নেয়, ভাগ্য খারাপ হলে নতুন পরিবেশ তাকে ‘অন্য কেউ’ হিশেবে দেখা শুরু করে; যে উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়।