স্কলারশিপ হলো একধরণের কলোনিয়াল প্রজেক্ট। একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের দায়িত্ব এমনি-এমনি নেয় না। ভীনদেশী একজন ছাত্রকে পড়ার সুযোগ করে দিবে, থাকা-খাওয়ার সুযোগ করে দিবে, মাসে-মাসে তার ব্যাংক একাউন্টে টাকা পাঠাবে এমনিতে? কোনো স্বার্থ ছাড়া?
ব্যবসায় একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘There is no such thing as a free lunch’. কেউ যখন ফ্রি-তে আপনাকে কিছু দিবে, সেটার পেছনে অবশ্যই তার স্বার্থ আছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি কেউ দান করে, সেটার পেছনে থাকে পরকালীন স্বার্থ।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বর্তমান নিয়ে যতোটা না ভাবে, তারচেয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি ভাবে। বর্তমানের ভাবনা থেকে ব্যয়কে বলা হয় ‘খরচ’, ভবিষ্যতের ভাবনা থেকে ব্যয়কে বলা হয় ‘বিনিয়োগ’। একজন ছাত্রের অনার্স-মাস্টার্স-পিএচডির পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি লক্ষ-লক্ষ টাকা ব্যয় করে। এই ব্যয়টা তাদের কাছে ‘খরচ’ না, তাদের কাছে ‘বিনিয়োগ’।
ধরুন, বাংলাদেশে মেধাবীদের সংখ্যা ১০,০০০। এই দশ হাজার মেধাবীকে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে পড়ানোর জন্য চার-পাঁচটি দেশ চেষ্টা করবে, বিভিন্ন অফার দিবে। দেখা যাবে, দেশের শীর্ষ ২০০০-৩০০০ মেধাবী (২০-৩০%) বাইরের দেশে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে। দেশের মানুষ যেমন তাদেরকে বাহবা দেয়, আত্মীয়স্বজনও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে৷ ব্যক্তিগতজীবনে এই অর্জন নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়, গৌরবের।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয়ভাবে মেধাবীদেরকে ধরে রাখতে না পারা, মূল্যায়ন করতে না পারাটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অবশ্য এটা মোটেও আফসোসের নয়, বরং এটাই প্রত্যাশিত। কারণ, এদেশের মেধাবীরা যদি দেশের মধ্যে ‘প্রতিষ্ঠিত’ হয়ে যায়, মেধাবীদেরকে রাষ্ট্র যেভাবে গাইড করার কথা (সরকারি চাকরি, MNC -তে চাকরি ধরিয়ে দেয়া) সেভাবে গাইড করতে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা তো দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে যাবে!
এটা বুঝার জন্য সহজ একটি উদাহরণ দেয়া যায়। একজন উচ্চশিক্ষিত যুবককে গ্রামের মানুষ সমীহ করবে, মাঝেমধ্যে তাকে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু, সে যদি গ্রামে এসে কোনো উদ্যোগ নিতে চায়, কোনো বিষয়ে কর্তৃত্ব দেখায়, তখন কিন্তু গ্রামের মুরব্বিরা তাকে ফ্লোর দিতে চাইবে না। তারা বলবে- ‘ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেতে চাও?’
ঠিক তেমনি, শীর্ষ মেধাবীরা যে রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর, বিষয়টি সবসময় এমন না। এতোটা সহজ হিশাব না। রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মেধাবীকে ফ্লোর দিবে, এরবেশি না। তা-ও সেটা রাষ্ট্রের স্বার্থে। রাষ্ট্র যেভাবে চাইবে, সেভাবেই মেধাবীদের গাইড করবে।
মেধাবীরা যদি চাকরিমুখী হয়, তাহলে তো তাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে গেলো। চাকরিমুখী মেধাবী মানেই রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়, সরকারপক্ষীয় বা সরকারের সুনজরপ্রার্থী। বিসিএসের স্বার্থে তার টাইমলাইন থাকবে চকচকে, কখনোবা তেল ছিপছিপে!
অন্যদিকে স্কলারশিপ পেয়ে যারা বাইরে যায়, তাদের অনেকের অবস্থা হয়- ‘যার নুন খাই, তার গুণ গাই’। বলা বাহুল্য, যারা স্কলারশিপ দেয়, তাদের অন্যতম উদ্দেশ্যও এটা। যে রাষ্ট্র স্কলারশিপ দেয়, তারা স্কলারশিপ প্রাপ্ত ছাত্রদেরকে নিয়ে দুইভাবে পরিকল্পনা সাজায়।
১. পড়ালেখা সমাপ্ত হলে লোভনীয় অফার দিয়ে ঐ রাষ্ট্রের স্বার্থে মেধাবীদের রেখে দিবে। রাষ্ট্র গঠনে তাদেরকে কাজে লাগাবে।
২. পড়ালেখা শেষে যাদেরকে রাখতে চাইবে না অথবা যারা থাকতে চাইবে তারা সেই রাষ্ট্রের কাছে ‘লস প্রজেক্ট’ না কিন্তু। তাদেরকে তাদের নিজ দেশে পাঠাবে, পাঠানোর পরও হয়তো মাসে-মাসে ভাতা দিবে কিংবা দিবে না। কিন্তু, ঐ রাষ্ট্র তাদেরকে ঠিকই ‘কলোনিয়াল প্রোডাক্ট’ বানিয়ে নিজ দেশে পাঠিয়েছে।
এই দুই শ্রেণীর বাইরে খুব স্বল্পসংখ্যক একটি শ্রেণী আছেন, যাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঐভাবে ‘ব্যবহার’ করতে পারেনি। এটার কারণ হলো, ঐসব ছাত্রের স্বাধীনচেতা এবং কলোনিয়াল প্রজেক্ট সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা। তাদেরকে নিজ রাষ্ট্র যেমন কিনতে পারেনি, তেমনি কলোনিয়াল রাষ্ট্রও কিনতে পারেনি।
বাইরে থেকে পড়ালেখা করে আসা মেধাবীদের কথার টোনের মধ্যে যথেষ্ট মিল আছে। যে যেই দেশ থেকেই পড়ালেখা করে আসুক না কেনো, তার কথা বলার ভঙ্গিতে সবসময় কিছু বিষয় ফুটে উঠে।
১. সে দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থার উপর বিরক্ত। শিক্ষা ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জনগণের স্বভাব; সবকিছুই তার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়।
২. সে সবসময় বেঞ্চমার্ক হিশেবে ধরে তার নুন-দানকারী দেশকে। কথা বলা শুরু করলেই সে স্মৃতি রোমন্থন করে। সে চলে যায় ইউরোপ, অ্যামেরিকা, মিসর, তুরস্ক বা সৌদি আরবে। ঐদেশের ব্যবস্থা কতো ভালো ছিলো, আর এই দেশের অবস্থা কতো নিকৃষ্ট এই নিয়ে সে আফসোস করে।
৩. যেকোনো ইস্যুতে তাকে স্কলারশিপ দেয়া রাষ্ট্র যদি সমালোচনার শিকার হয় (হোক সেটা নৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে), সে তখন ঐ রাষ্ট্রকে ‘উদ্ধার’ করা নিজের কর্তব্য মনে করে। ঐ রাষ্ট্র যদি নির্মমভাবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নাগরিক হত্যা করে, তবুও সে যুক্তি দেখাবে, কাজটির বৈধতা নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি টানবে।
সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের স্বার্থকতা ঠিক এই জায়গায়। তার পক্ষের কিছু মানুষ তৈরি করা। যারা দেখতে অন্যদেশী হলেও চিন্তা করবে সাম্রাজ্যবাদী দেশের পক্ষে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দেহ কিনে না, সে মাথা কিনে। সেই মাথায় সে তার পক্ষের চিন্তাকে ইনপুট করায়, অতঃপর সেটা ছেড়ে দেয়। আউটপুট দুই ধরণের হয়। হয় সেটা তার পক্ষে কথা বলে, নতুবা তার বিপক্ষে কথা বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে।
বাংলাদেশের মেধাবীরা মূলত ইউরোপ, অ্যামেরিকা, মিসর, তুরস্ক, সৌদি আরবে পড়ালেখা করতে যায়। বেশিরভাগ ফিরে এসে ঐসব দেশের গুণকীর্তন গেয়েই অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দেয়, বাকি অর্ধেক জীবন কাটায় স্বজাতির দোষকীর্তন গেয়ে।
আপনি যদি এর ব্যতিক্রম কাউকে দেখতে পান, তাহলে ধরে নিবেন ঐ এক-দুইটি মগজ এখনো অবিক্রিত। ধারাবাহিকভাবে হক্ব কথা যদি বের হয়ে আসে, তাহলে তাদের মুখ থেকেই আসে।