সুপ্রভাত!
দেখতে দেখতে চারপাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ বাদেই বরকতময় ফজরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে আসবে তারই আভাস দিচ্ছে প্রকৃতি। অপরদিকে মসজিদে মুসল্লিরাও শেষ রাকাতে সালাম ফেরানোর অপেক্ষায়।
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ,আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ – দিনের প্রথম ওয়াক্তের সালাতের পরিসমাপ্তি ঘটলো।একে একে মুসল্লিরা উঠে চলেছে,যে যার ঘরের দিকে হাঁটা ধরেছে। এবং এঅবস্থায় আমাদের অধিকাংশের মনের বাস্তবতা হচ্ছে- বাড়ি গিয়ে আরো কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিতে হবে, কমপক্ষে যতক্ষণ পর্যন্ত না স্কুল-কলেজ-অফিসে যাওয়ার সময় হয়!
কিন্তু, আমাদের এই ভিড়ে কিছু মানুষ ঠিকই নামাজ আদায় করে মসজিদে চুপচাপ বসে রইলো। তারা একমনে যিকির করে চললো, কেউ কেউ তো কুরআন তেলাওয়াতে মনোযোগী হলো। এবং যখন সূর্য পরিপূর্ণভাবে উদিত হয়ে চারদিকে আলো ছড়িয়ে দিলো তখন তারা তাদের জায়গা ত্যাগ করলো। মূলত এরা যেন নবীজী ﷺ এর একটি অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করলো যার ব্যাপারে সাহাবী রা: বলেন,
“রাসূল ﷺ ভোরের সালাত আদায় করার সূর্য না ওঠা পর্যন্ত নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে যেতেন না। সূর্য ওঠার পর তিনি উঠতেন।”
অর্থাৎ,ফজরের সালাত আদায়ের পর সূর্যোদয় অব্দি সময় সালাত আদায়ের স্থানে অবস্থান করা নবীজী ﷺ এর একটি সুন্নাহ,বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে হারিয়ে যাওয়া সুন্নাহ।অথচ এই সুন্নাহটি এমন একটি সময়ের সাথে জড়িত যখন আল্লাহর বরকত নাজিল হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ফজরের পর পরই অর্থাৎ প্রভাতে অভিযান পরিচালনার জন্য মুসলমানরা বেরিয়ে পড়তো। এমনকি আল্লাহ পাক কুরআনে তীব্র বেগে ছুটে চলা ঘোড়ার কথা এভাবে বলেন,
“কসম ঊর্ধশ্বাসে ছুটে যাওয়া অশ্বরাজির, অতঃপর যারা ক্ষুরাঘাতে অগ্নি-স্ফূলিঙ্গ ছড়ায়,অতঃপর যারা প্রত্যুষে হানা দেয়, অতঃপর সে তা দ্বারা ধুলি উড়ায়,অতঃপর এর দ্বারা শত্রুদলের ভেতরে ঢুকে পড়ে।”
[সূরা আল আ’দিয়াত: ০১-০৫]
এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা সূরা ফাজরে,সূরা মুদ্দাসিরে,সূরা আদ-দুহায় ফজরের শপথ করেছেন।প্রভাতের যে একটা আলাদা গুরুত্ব আছে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার শপথের মধ্য দিয়েও স্পষ্টত। আর এজন্যই হারিয়ে যাওয়া সুন্নাহটিকে বাঁচিয়ে রাখা সালাফরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন ফজরের পরবর্তী এই সময়টির ব্যাপারে।
ইমাম আওযাঈ রাহি. বলেন,
“ফজরের সময় আমাদের সালাফরা এত শান্তভাবে বসে থাকতেন যেন তাদের মাথার ওপর পাখি বসে আছে। তারা এতটাই মন দিয়ে আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ করতেন যে, দূর থেকে তাদের কোনো প্রিয় মানুষ এলেও তারা তার দিকে ফিরে তাকাতেন না। সূর্য না ওঠা পর্যন্ত তারা এ অবস্থাতেই থাকতেন।”
[তারিখে দিমাশক লি ইবনে আসাকির: ৩৫/১৮৪-৮৫]
অথচ আমাদের অধিকাংশই প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ প্রভাতের ব্যাপারে উদাসীন। আমরা কোনোমতে বিছানা ত্যাগ করে ফজর নামাজটা পড়েই আবার বিছানায় ফিরে যাই, অথচ যেখানে আল্লাহ পাক আমাদের এই সময়ের ব্যাপারে সচেতন করেছেন, নবীজী ﷺ তাঁর অভ্যাসের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন।
শুধু কি এখানেই শেষ! এর পাশাপাশি যদি সূর্যোদয়ের পর আমরা দুই রাকাত সালাত আদায় করি তবে আমাদের জন্য হজ্জ ও ওমরার সাওয়াবের কথাও নবীজী ﷺ উল্লেখ করেছেন।
নবীজী ﷺ বলেন,
” যে জামাআতের সাথে ফজরের সালাত আদায় করে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত সেখানে বসে থেকে আল্লাহর যিকির করবে এবং এরপর দুই রাকাআত সালাত আদায় করবে, তার জন্য একটি হজ্জ ও উমরা পালনের সওয়াব হবে।
ওই ব্যক্তির জন্য হজ্জ ও উমরার পরিপূর্ণ সওয়াব হবে, পরিপূর্ণ সওয়াব হবে, পরিপূর্ণ সওয়াব হবে।”
[জামে আত তিরমিজী, হাদীস নং ৫৮৬]
সুবহানাল্লাহ! মহল্লায় বসে প্রতিদিন ভোরে হজ্জ ও উমরাহর সওয়াব লাভের সুযোগ। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় খেয়াল করুন, নবীজী ﷺ তিনবার বলেছেন,”পরিপূর্ণ সওয়াব হবে”। আর এতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে নবীজী ﷺ এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছেন, প্রচন্ড গুরুত্ব দিয়েছেন যা আমাদের জন্য সুসংবাদ।
এমনকি নবীজী ﷺ আমাদের জন্য আলাদা দু’আ ও করেছেন,
“হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য দিনের শুরুকে বরকতময় করুন।”
[আবু দাউদ, হাদিস ২৬০৬]
অথচ এরকম একটি আমলের থেকে এবং ভোর বেলার বরকত থেকে প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের অবহেলার দরুন বঞ্চিত হচ্ছি!
এমনকি আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করার, তাঁর রহমত ও নেয়ামত অনুভব করারও দারুন একটি সুযোগ ভোরবেলা আমাদের নিকট তুলে ধরে,এই সময়ে সেই সূর্যোদয়ের দেখা মিলে যাতে আল্লাহ বিবেকবোধসম্পন্নদের জন্য রেখেছেন নিদর্শন। এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসময় রিযিক বন্টিত হয়।
ফাতেমা রা: বলেন,
“একদা রাসুল ﷺ আমার ঘরে এসে আমাকে ভোরবেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন, তখন আমাকে পা দিয়ে নাড়া দিলেন এবং বললেন,
মা ওঠো! তোমার রবের পক্ষ থেকে রিজিক গ্রহণ করো! অলসদের দলভুক্ত হয়ো না। কেননা আল্লাহ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে রিজিক বণ্টন করে থাকেন।”
[আত-তারগিব, হাদিস নং ২৬১৬]
অর্থাৎ, আমাদের একটু সচেতনতা,অলসতা পরিহার এবং আল্লাহর অন্যতম সুন্দর নেয়ামত প্রত্যুষকে অনুভব করতে পারলে নবীজী ﷺ এর হারিয়ে যাওয়া সুন্নাহকে সহজেই পুনরুজ্জীবিত করতে পারবো এবং নিজেদের দিনের প্রথম প্রহরকে আল্লাহর বরকত দিয়ে সাজিয়ে নিতে পারবো ইনশাআল্লাহ।