Table of Contents
সুখি দাম্পত্য জীবনের সন্ধানে – পর্ব ২
সুখী দাম্পত্য জীবন গড়তে স্ত্রীদের জন্য কিছু পরামর্শ শেয়ার করছি যেগুলোর অনুশীলনের ফলে আপনিও একজন দায়িত্বশীল ও সফল স্ত্রীরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ্!
স্বামীর বিশ্বাস ভঙ্গ হয় এমন কাজ করবেন না
স্বামী অগোচরে এমন কোন কাজ করবেন না, যাতে তার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। বিশেষ করে চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করে চলুন। আত্মীয়তার অজুহাতে, বন্ধুত্বের অজুহাতে, সহমর্মীতা দেখানোর ছলনায় অন্য পুরুষ হয়তো আপনার সাথে কারণে-অকারণে কথা বলতে চাইবে, কাছে আসতে চাইবে, অন্যায় সুযোগ নিতে চাইবে, কিন্তু বোন আপনি স্বামীর অবর্তমানে এমন কিছুই করবেন না, যা তার উপস্থিতিতে করতেন না।
স্বামী যেখানে যাওয়া, যাদের সাথে চলা, কথা বলা পছন্দ করেন না, একান্ত প্রয়োজন না হলে সেসব এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন আপনার ইগোর চেয়ে দু’জনের স্বাভাবিক বিশ্বস্তপূর্ণ সম্পর্ক যথেষ্ট মূল্যবান।
স্বামীর ছোট-খাটো দোষ উপেক্ষা করুন
মেয়েদের মধ্যে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এমন বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়েছেন যে, তারা চাইলে যে কোনো বিষয়েরই খুঁত খুঁজে বের করতে পারে। একজন মেয়ের স্বামী যতই তার সাথে ভালো আচরণ করুক না কেন, সে চাইলেই তার দোষ ধরতে পারবে– এই গুণ তার আছে।
কিন্তু, আল্লাহ্ সর্বপ্রথম এই কাজটিই মেয়েদেরকে করতে নিষেধ করছেন। তাই একজন স্ত্রীর সবচাইতে বড় গুণ হলো স্বামীর দোষ এড়িয়ে যাওয়া, দেখেও না দেখার ভান করা, ভুলে যাওয়া। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করা।
আপনি যদি তার মধ্যে এমন কোনও দোষ দেখেন যা আপনার জন্য বিরক্তি উদ্রেগ করে, তবে তখন আপনি তার এমন কোন গুণের কথা স্মরণ করুন যার জন্য আপনি তাকে ভালবাসেন। তবে স্বামীর কোন দোষ যদি একান্তই সহ্য করার মতো না হয়, তবে তাকে কটাক্ষ না করে উপযুক্ত ও সুবিধাজনক সময়ে বুঝিয়ে বলুন, সংশোধনের জন্য অনুরোধ করুন।
স্বামীর অবর্তমানে তার দোষের কথা অন্যের নিকট প্রকাশ করবেন না
স্বামীর অবর্তমানে মেয়েরা তার সম্মান রক্ষা করবে। তার দোষের কথা তৃতীয় কোন মানুষের নিকট প্রকাশ করবে না এবং অন্যের সামনে স্বামীর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে একে অপরের পোষাক সুতরাং নিজ পোষাকের দোষ-ত্রুটি অপরের সম্মুখে তুলে ধরে নিজেকেই হেয় প্রতিপন্ন করার মতো বোকামী করবেন না। আবার তৃতীর পক্ষের নিকট হতে স্বামীর নিন্দা শোনায় আগ্রহী হওয়া উচিত নয়- কারণ এতে নৈতিক অধঃপতন ঘটতে পারে।
স্বামীকে বাইরের কলুষতা থেকে রক্ষা করুন
পাঁজর যেমন হৃদপিণ্ডকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে, একজন ভালো স্ত্রীও তেমন তার স্বামীকে বাইরের কলুষতা থেকে রক্ষা করে। আপনার অবর্তমানে স্বামী কখন কোথায় যাচ্ছে তার সবটা কিন্তু আপনি জানেন না। এক্ষেত্রে স্ত্রীর দায়িত্ব হলো– যাদের সে দেখতে পাচ্ছে না তাদের থেকেও স্বামীকে রক্ষা করা। শয়তান পরনারীকে ছেলেদের চোখে সুন্দর করে দেখায়। কাজেই, একজন স্ত্রীর দায়িত্ব হলো তার স্বামী যাতে শয়তানের সাথে লড়াইয়ে বিজয়ী হয় সেজন্য তাকে সাহায্য করা।
স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরলে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য সেজেগুজে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকুন। তার মানে এই নয় যে, আপনাকে নায়িকার সাজ সাজতে হবে। কারণ স্বামীরা অন্ততঃ এটুকু জানেন যে, সংসারের দায়িত্ব পালন করতে একটা মেয়েকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়।
আর এতে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি লাভ স্ত্রীদেরই। কারণ, যখন স্বামী বুঝতে পারবে তার স্ত্রী তাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে, তখন সে তার প্রতি আরো বেশি ভালাবাসা ও আকর্ষণ বোধ করবে। আর যখন স্বামী দেখে যে, স্ত্রী তার জন্য নিজেকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে না– তখন ক্রমেই সে তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা হারাতে থাকে।
কারণ স্ত্রীর অপরিচ্ছন্নতার সুযোগে শয়তান এসে স্বামীর অন্তরের মাঝে রেকর্ড বাজাতে থাকে– আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, সে তোমাকে ভালবাসে না!
স্বামীকে সম্মান করুন এবং তার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করুন
স্বামী দরিদ্র কিংবা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অসুন্দর হওয়ার কারণে তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ভালবাসবে, সম্মান করবে ও তার মতামত অনুসারে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক (মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্’র নির্দেশিত হারাম কাজ ছাড়া)। তবে, স্বামীকে সম্মান করার অর্থ এই নয় যে, স্বামী কোন অন্যায়-অত্যাচার করলেও তা স্ত্রীকে মুখ বুঁজে মেনে নিতে হবে। সম্মান করার অর্থ এটাও নয় যে, স্ত্রী তার স্বামীর সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না।
বরং, স্ত্রী স্বামীর সাথে ভিন্নমত পোষন করতেই পারে, প্রয়োজনে যুক্তি সহকারে নিজের মতকে তুলে ধরবে, পরামর্শ দিবে; কিন্তু সবই করতে হবে সম্মানের সাথে, কটাক্ষ বা তাচ্ছিল্যের ছলে নয়। যে কোন অবস্থায় স্বামীকে কোনো গুনাহের কাজ করতে দেখলে আদবের সাথে তাকে বিরত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। সর্বোপরি দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় পক্ষ নয় স্বামীর সিদ্ধান্তকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন।
প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবি করা হতে বিরত থাকুন
সংসারের খরচ পত্রের যথাযথ হিসেব রাখা প্রত্যেক স্ত্রীর অবশ্য কর্তব্য। স্বামীর সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ করে তাকে মানসিক চাপে ফেলা উচিত নয়। স্বামীর বৈধ আয়ের অর্থেই সন্তুষ্ট থাকুন এবং আয় বুঝে ব্যয় করুন। কারণ আপনার চাপাচাপির কারণে সে অবৈধ উৎস হতে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হতে পারে।
আর প্রতিটা অবৈধ অর্থেই থাকে কোন না কোন মানুষের অন্তরের দীর্ঘশ্বাস আর মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্’র অসন্তুষ্টি। সুতরার আল্লাহ্’র অসন্তোষ আর মানুষের অভিশাপ নিয়ে সুখী থাকার চেষ্টা করাটা কতটুকু ফলপ্রদ একটু ভেবে দেখেছেন কি?
বরং স্বামীর স্বল্প আয়ের ওপর নিজেদের চাহিদা ও ব্যয়ের ব্যালেন্সড ছক তৈরী করুন যা থেকে সর্বোচ্চ মানসিক প্রশান্তি বেড়িয়ে আসে।
একান্ত মূহূর্তে সপ্রতিভ থাকুন
স্বামী শারিরিক সম্পর্কের জন্য ডাকলে একান্তই অসুবিধা না থাকলে আপত্তি করা উচিত নয়। স্বামী যখনই আপনার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে– তাকে ফিরিয়ে দিবেন না, এতে একজন স্বামী খুব কষ্ট পায়, তার মন ভেঙ্গে যায়।
কারণ আপনার সাথে শারিরিক সম্পর্ক তার বৈধ পাওনা। এবার আপনিই বিবেচনা করুন আপনি আপনার কোন নিশ্চিত বৈধ পাওনা থেকে বঞ্চিত হলে আপনার মনোকষ্ট কিরূপ হবে!
তবে শারিরিক সমস্যা বা মানসিক অতৃপ্তবোধের কারণে আপনার অনীহা থাকলে তা নিজের মাঝে পুষে না রেখে ফ্রিলি স্বামীর সাথে শেয়ার করুন, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হোন। এটা এমন এক সমস্যা যা দাম্পত্য জীবনকে ধবংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
যৌথ পরিবার হলে সবার সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন
অনেক মেয়েই যৌথ পরিবার পছন্দ করেন না। তবে যারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিয়ের পর যৌথ পরিবারে থাকছেন তারা মনে রাখুন মেয়েদের পক্ষে স্বামী ও শ্বশুরের ঘর হলো একটি বিরাট পরীক্ষাগার। তাই মেহেরবানী করে একটু ছাড় দিয়ে হলেও সবার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন।
বিশেষ করে আপনার স্বামীর বর্তমান অবস্থানে আসার পিছনে যাদের সময়, অর্থ, শ্রম, মেধা, স্নেহ, মায়া, মমতা আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা জড়িত সেই শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মানের পাত্র মনে করুন, তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করুন। বিশেষ করে স্বামীর সামনে শাশুড়ীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হতে বিরত থাকুন। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি তাদের মনে কষ্ট দিয়েই থাকেন তো সুযোগ বুঝে ক্ষমা চেয়ে নিন।
খুটি-নাটি সমস্যার সম্মুখীন হলে
একসাথে চলার পথে বা সংসারে হরেক রকম কথা বার্তা বা ঝগড়া হতে পারে, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যপার হতে পারে। তবে তা যেন বেশী মাত্রায় না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। তবে খুটি-নাটি সমস্যার সম্মুখীন হলে স্বামী স্ত্রী উভয়ে যা করতে পারেন…
১। সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য মনের মিল খুবই জরুরি। দু’জনের মনের দুরত্ব যথাসম্বভ কমিয়ে আনুন। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দু’জনে খোলাখুলি কথা বলুন। পরস্পরের পছন্দ–অপছন্দও জেনে নিন।
২। শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় সঙ্গীর অনীহা?
জোর করবেন না। অনেকেই মুখ ফুটে নিজের চাহিদার কথা বলতে পারেন না। ঠান্ডা মাথায় দরদ ভরা মন নিয়ে কথা বলুন। বুঝে নিন কী চান আপনার সঙ্গী বা সঙ্গীনি।
৩। সবসময় মনের মিল নাও হতে পারে। তাই বলে অন্য কারও তুলনা টেনে আনবেন না যেন। এতে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারেন সঙ্গী বা সঙ্গীনি।
একসময় কথাবার্তা বলাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৪। কোন কারণে ভুল বোঝাবুঝি হলে, মনের মধ্যে কষ্ট চাপা দিয়ে রাখবেন না। এতে সঙ্গী বা সঙ্গীনির প্রতি বিশ্বাস দুর্বল হয়ে যায়।
৫। সব সময় আমিত্ব নিয়ে পড়ে থাকবেন না। সঙ্গীর পছন্দকেও গুরুত্ব দিতে শিখুন। দুনিয়ায় আপনিই একমাত্র ব্যস্ত নন, সুতরাং কাজের ব্যস্ততায় মাঝেও সময় বের করে সঙ্গীর খোঁজ নিন, সালাম-কালাম বিনিময় করুন।
৬। দাম্পত্য জীবনের ভালবাসা যেন শুধু শরীরসর্বস্ব না হয়। শরীরের পরিবর্তে বরং একে অন্যের মন জয় করার প্রতিযোগীতা করুন। দেখবেন সুখ আপনা থেকেই ধরা দেবে।
৭। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া-ঝাঁটি হয়ে গেলে তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য উভয়কেই সময় দিতে হবে। ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগার জন্য যেমন সময়ের প্রয়োজন হয়, মন ভাঙলেও তা সারতে সময় লাগে।
সুতরাং, উভয়ে উভয়ের দোষগুলি উপেক্ষা করে, গুণের কথা মনে রেখে, ধৈর্য্য ধরে, উত্তম ক্ষমা আর ভালো ব্যবহার দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে যেতে হবে। সর্বোপরি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্’র কাছে মধুময় দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য দু’আ করতে থাকতে হবে।
৮। একান্ত অপারগ না হলে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যের মাঝে আপন হোক বা পর, কোন তৃতীয় পক্ষ ডেকে এনে তাদের সম্মুখে একে অপরের ভুলগুলো তুলে ধরে নিজেদেরকে হেয় করবেন না, লজ্জিত করবেন না। অভিমান, অভিযোগের মেঘ জমেছে?
জমতে দিন। ধৈর্য্য ধারণ করুন, একটু অপেক্ষায় থাকুন না, আজ হোক, কাল হোক অভিমানের মেঘ, অভিযোগের মেঘ, হতাশার মেঘ, জমাট বাধা সকল মেঘ ভেঙ্গে ভালোবাসার বৃষ্টি একদিন নামবেই নামবে।
পরিশেষে বলতে চাই-
মনে রাখবেন, কোনো কিছুই এমনি এমনি হয় না। চেষ্টা ছাড়া কোনো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। একটা সুন্দর, সুখী, মধুময় দাম্পত্য জীবন গড়ার জন্যও তেমনি চেষ্টা থাকতে হবে। একটি সুন্দর-সুখী পরিবার গড়ার জন্য স্বামী ও স্ত্রী দু’জনকেই চেষ্টা করতে হবে, নিজের থেকে ছাড় দিতে হবে।
হয়তো এর মধ্যে ভুল-ত্রুটিও হবে, মান-অভিমানও হবে, কিন্তু সেটাকে ধরে বসে থাকলে চলবে না। একে অপরের ভুল-ত্রুটিকে উপেক্ষা করে সুন্দর, সুখী, মধুময় দাম্পত্য জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে আরও সহনশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন এবং সকল দম্পতির সম্পর্কের মাঝে কল্যাণ ও বরকত ঢেলে দিন।
আমীন।