সহু সিজদাহ বা সাহু সিজদা কি কি কারণে দিতে হয়
সহু সিজদাহ বা সাহু সিজদা কি কি কারণে দিতে হয়? নামাজ কম বা বেশি বা কয় রাকাত পড়েছি সন্দেহ হলে কিভাবে পড়বো?
সহু সিজদা বা সিজদা-এ সাহও (ভুলের সিজদাহ) ফরয বা নফল নামাযে ভুল করে কোন ওয়াজেব অংশ ত্যাগ করলে ঐ ভুলের খেসারত স্বরুপ এবং ভুল আনয়নকারী শয়তানের প্রতি চাবুক স্বরুপ দুটি সিজদাহ করতে হয়। ভুল অনুপাতে সিজদার আগে বা পরে হাদীসে বর্ণিত নিয়মানুসারে সিজদাহ করা জরুরী।
Table of Contents
নামায কম পড়ে সালাম ফিরে দিলে :
ভুলবশত: ১ বা ২ রাকআত নামায কম পড়ে সালাম ফিরে থাকলে যদি অল্প (৫/৭ মিনিট) সময়ের মধ্যে মনে পড়ে, তাহলে (মাঝে কথা বলে থাকলেও) নামাযী বাকী নামায সম্পন্ন করে সালাম ফিরার পর তকবীর ও তাসবীহ সহ্ দুটি সিজদাহ করে পুনরায় সালাম ফিরবে।
এ ব্যাপারে যুল-য়্যাদাইনের হাদীস প্রসিদ্ধ। একদা মহানবী (সাঃ) যোহ্র কিংবা আসরের নামায ভুল করে ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরে উঠে অন্য জায়গায় বসলেন। লোকেরা ভাবল, নামায সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আবূ বাক্র, উমার কেউই ভয়ে তাঁর সাথে কথা বললেন না। অবশেষে যুল-য়্যাদাইন বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি ভুলে গেছেন, নাকি নামায কম হয়ে গেল?’ তিনি বললেন, “আমি ভুলিও নি, নামায কমও হয় নি।” অতঃপর সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “যুল-য়্যাদাইন যা বলছে তা কি ঠিক?” সকলে বলল, ‘জী হ্যাঁ।’ সুতরাং তিনি অগ্রসর হয়ে বাকী নামায পূরণ করে সালাম ফিরলেন। অতঃপর তকবীর দিয়ে অনুরুপ অথবা তার চেয়ে লম্বা সিজদা দিলেন। তারপর আবার তকবীর দিয়ে মাথা তুললেন। পুনরায় তকবীর দিয়ে অনুরুপ অথবা তার চেয়ে লম্বা আরো একটি সিজদাহ করলেন। তারপর আবার তকবীর দিয়ে মাথা তুলে সালাম ফিরলেন।
(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১০১৭নং)
অবশ্য দীর্ঘ সময়ের পর মনে পড়লে নূতন করে পুরো নামাযটাই পুনরায় ফিরিয়ে পড়তে হবে।
নামাযের কোন রুক্ন
(যেমন কিয়াম, রুকূ, সিজদাহ প্রভৃতি) ভুলে ত্যাগ করলে নামাযই হবে না। যে রাকআতের রুক্ন ত্যক্ত হবে, সে রাকআত বাতিল গণ্য হবে। ঐ ভুল নামাযের মধ্যে প্রথম রাকআতের রুক্ন ছেড়ে দ্বিতীয় রাকআতে মনে পড়লে, দ্বিতীয়কে প্রথম রাকআত গণ্য করে বাকী নামায সম্পন্ন করবে নামাযী। অতঃপর সালাম ফিরার পর দুই সিজদা করে পুনরায় সালাম ফিরবে।
(মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৭/৩৯)
পক্ষান্তরে নামাযের সালাম ফিরার পর মনে পড়লে এক রাকআত নামায পড়ে ঐরুপ সিজদাহ করবে।
নামায বেশী পড়লে :
নামাযে ভুলবশত: ১ রাকআত বা ১টি সিজদাহ বা বৈঠক অতিরিক্ত হয়ে গেলে সালাম ফিরার পর ২টি সহু সিজদা করে পুনরায় সালাম ফিরবে নামাযী।
একদা মহানবী (সাঃ) ৫ রাকআত নামায পড়ে সালাম ফিরলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, নামায কি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? তিনি বললেন, “ব্যাপার কি?” লোকেরা বলল, ‘আপনি ৫ রাকআত নামায পড়লেন।’ এ কথা শুনে তিনি দুটি সিজদাহ করলেন। (অতঃপর সালাম ফিরলেন।)
(বুখারী, মুসলিম, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ১০১৬নং)
রাকআতে সন্দেহ্ হলে :
নামায পড়তে পড়তে কয় রাকআত হল -এই সন্দেহ্ হলে যেদিকের সঠিকতার ধারণা অধিক প্রবল হবে, তার উপর ভিত্তি করে নামায শেষ করে সালাম ফিরার পর ২টি সিজদাহ করে পুনরায় সালাম ফিরবে।
যদি দুই দিকের মধ্যে কোন দিকেরই সঠিকতার ধারণা প্রবল না হয়, তাহলে দৃঢ় প্রত্যয়ের উপর আমল করবে নামাযী। অর্থাৎ, কম সংখ্যার উপর ভিত্তি করলে নামায অসম্পূর্ণ হওয়ার আশংকা থাকবে না। সুতরাং সেই প্রত্যয়ের সাথে বাকী নামায সম্পন্ন করে সালাম ফিরার পূর্বে দুটি সিজদা-এ সাহও করে সালাম ফিরবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাযে সন্দেহ্ করে এবং বুঝতে পারে না যে, সে কয় রাকআত পড়েছে; ৪ রাকআত, না ৩ রাকআত?
তখন তার উচিৎ, সন্দেহ্ দূর করে দিয়ে যা একীন (দৃঢ় প্রত্যয়) হয় তার উপর ভিত্তি করা। অতঃপর সালাম ফিরার পূর্বে দুটি সিজদাহ করা। এতে সে যদি ৫ রাকআত পড়ে থাকে তাহলে ঐ সিজদাহ মিলে তার নামায জোড় হয়ে যাবে। অন্যথা যদি পূর্ণ ৪ রাকআত পড়ে থাকে, তাহলে ঐ সিজদাহ শয়তানের জন্য লাঞ্ছনাকর হবে।”
(আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১০১৫নং)
প্রথম তাশাহহুদ ত্যাগ করলে :
নামাযী নামাযের প্রথম তাশাহহুদের বৈঠকে বসতে ভুলে গেলে যদি অর্ধেক উঠে খাড়া না হয়ে যায়, (হাঁটুদ্বয় মাটি ত্যাগ না করে) তাহলে মনে পড়লে পুনরায় বসে ‘আত্-তাহিয়্যাত’ পড়ে নেবে। আর এতে সাহও সিজদার প্রয়োজন নেই। অর্ধেকের বেশী উঠে খাড়া হয়ে গেলে এবং সম্পূর্ণ খাড়া না হয়ে মনে পড়লে পুনরায় বসে ‘আত্-তাহিয়্যাত’ পড়ে নেবে এবং শেষে সহু সিজদাহ করবে। কিন্তু যদি সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে যায়, তাহলে আর পুনরায় না বসে বাকী নামায পূর্ণ করে সালাম ফিরার পূর্বে দুই সিজদা করে সালাম ফিরবে।
অবৈধ জানার পরেও সম্পূর্ণ খাড়া হওয়ার পর পুনরায় বসে তাশাহহুদ পড়লে নামায বাতিল নয়। কিন্তু ক্বিরাআত শুরু করার পর বসলে নামায বাতিল গণ্য হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৫১১-৫১৩)
একদা মহানবী (সাঃ) নামাযে প্রথম বৈঠকে না বসে উঠে পড়েন। লোকেরা তাসবীহ বললেও তিনি না বসে নামায শেষে দুই সিজদাহ করে সালাম ফিরেন। (বুখারী, মুসলিম, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ১০১৮নং)
তিনি বলেন, “ইমাম ভুলে গিয়ে (তাশাহহুদ না পড়ে) সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে গেলে তাকে ২টি সহু সিজদাহ করতে হবে। অবশ্য সম্পূর্ণ খাড়া না হলে সহু সিজদাহ করতে হবে না।” (ত্বাবারানী, মু’জাম জামে ৬২৩নং)
প্রকাশ যে, ৪ রাকআত পড়ে ৫ রাকআতের জন্য ভুলে উঠে সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে গেলেও স্মরণ হওয়া বা করানোর সাথে সাথে নামাযী বসে যাবে। কিন্তু প্রথম বৈঠকের জন্য স্মরণ হওয়া বা করানোর পরেও বসবে না।
সহু সিজদার আনুষঙ্গিক মাসায়েল :
ভুলবশত: যে কোনও ওয়াজেব (যেমন রুকূ বা সিজদার তাসবীহ ইত্যাদি মূলেই) ত্যাগ করলে ঐ একই নিয়মে সিজদাহ করতে হবে।
ইমাম সহু সিজদাহ করলে মুক্তাদী ভুল না করলেও তাঁর অনুসরণে তাঁর সাথে সিজদাহ করতে বাধ্য। ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদী ভুল করলে যদি সে প্রথম রাকআত থেকেই ইমামের সাথে থাকে, তাহলে তাকে পৃথকভাবে সিজদাহ করতে হবে না। কারণ, তার এ ভুল ইমাম বহন করে নেবে। অবশ্য মসবূক (জামাআতে পিছিয়ে পড়া মুক্তাদী) হলে, ইমামের সালাম ফিরার পর তার বাকী নামায আদায় করতে উঠলে শেষে ভুল অনুসারে যথানিয়মে সিজদাহ করবে।
কিন্তু যদি ইমাম সালাম ফিরার পর সিজদাহ করেন, তাহলে তাঁর সাথে মসবূকের সহু সিজদাহ করা সম্ভব নয়। কারণ সে সালাম ফিরতে পাবে না। তাই সে উঠে বাকী নামায আদায় করে শেষে যথানিয়মে একাকী সিজদাহ করে নেবে। অবশ্য সে যদি ইমামের ভুলের পর জামাআতে শামিল হয়ে থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে সিজদাহ করতে হবে না।
ইমাম ভুল করে এক রাকআত নামায বেশী পড়লে এক রাকআত ছুটে গেছে এমন মসবূক (পিছে পড়ে যাওয়া) নামাযী সেই রাকআত গণ্য করতে পারে না। সে রাকআত যেহেতু ইমামের বাতিল, সেহেতু তারও বাতিল। তাকে নিয়ম মত উঠে বাকী এক রাকআত কাযা পড়তে হবে।
(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০৯)
সতর্কতার বিষয় যে, ভুল করে নামাযের কোন রুক্ন ছুটে গেলে নামাযই হয় না। কোন ওয়াজেব ছুটে গেলে সিজদা-এ সাহও দ্বারা পূরণ হয়ে যায় এবং কোন সুন্নত ছুটে গেলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না তথা সহু সিজদারও প্রয়োজন হয় না।
ক্বিরাআত করতে করতে ভুলে গেলে অথবা কাশিতে ধরলে যদি পরিমাণ মত পড়া হয়ে থাকে, তাহলে ইমাম তখনই রুকূতে চলে যাবেন। অবশ্য ক্বিরাআত ছোট মনে হলে অন্য সূরাও পড়তে পারেন। আটকে যাওয়ার পর সূরা ইখলাস পড়েও রুকূ যেতে পারেন। অবশ্য ক্বিরাআত ভুল পড়লে শেষে ঐ সূরা পড়তে হয় -এ কথা মনে করা ঠিক নয়।
শাইখ আব্দুল হামীদ ফাইজি।