শশুর বাড়ির ইফতার উপঢৌকন
বিয়ের পর প্রথম রমজানটা আমার জন্য বিভীষিকায়ময় ছিলো শুধুমাত্র আমার শাশুড়ী নামক মানুষটার জন্য। আমি অবশ্য তাকে মাফ করে দিয়েছি। মৃত ব্যাক্তির উপর রাগ ক্ষোভ পুষে রাখার কোনো কারণ নেই।
শুরুটা হয়েছিলো সপ্তম রমজানে। আমার বড় জায়ের বাড়ি থেকে মহা আয়োজনে ইফতার এসেছিলো। আমার জা ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। তার বাড়ি থেকে এমন ঢাক-ঢোল পেটানোর মতো ইফতার আসাটা স্বাভাবিক হলেও আমার বাড়ি থেকে ছিটাফোটা আসারও কোনো উপায় ছিলো না।
আসলে আমি অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলাম। আমার বাবা পেশায় ছিলেন কেরানী। একজন কেরানীর পক্ষে সংসার চালানোই যেখানে কষ্টকর সেখানে ইফতারি পাঠানো তো বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। গরিব হওয়া সত্বেও আমার ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছিলো। কেননা আমি দেখতে সুন্দরী এবং শিক্ষিত ছিলাম। কিন্তু সামাজিক রীতিনীতির বেড়াজালে আমার শিক্ষা-দীক্ষা আর সৌন্দর্য চাপা পড়ে গেলো।
আমার বড় জা আমাকে খুব হেয় করে কথা বলতো। সবসময় কাজের লোকের মতো ব্যবহার করতো। আর আমার শাশুড়ী ও তাকে সাপোর্ট করতো। আমার স্বামী ছিলো চাপা স্বভাবের। সব বুঝেও সে চুপ করে থাকতো। আমাকে শান্তনা দিতো।
জা এর বাড়ি থেকে যেদিন ইফতার পাঠানো হলো সেদিন আমার প্লেট বাদে সবার প্লেটেই উনার বাড়ি থেকে আনা খাবার শোভা পাচ্ছিলো। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। খাওয়ার লোভে নয় অপমানে! আর এই কাজটা করেছে আমার শাশুড়ী নিজের হাতে। আমার বর সেদিনও কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুধু নিজের প্লেট থেকে দামি খাবার গুলো সরিয়ে আমার সমতুল্য খাবার গুলোই খেলেন। সবাই আড়চোখে দেখেও না দেখার ভান করলো।
সেদিন রাতে খুব কেদেছিলাম। সারারাত একফোটা ঘুম হয়নি। রাগে লজ্জায় সেহরীও খেতে যাইনি। তারা শুধু আমার স্বামীকে খেতে ডেকেছিলো। আমাকে ডাকেনি।
তারপর থেকেই শুরু হলো শাশুড়ীর প্রতিদিন খোটা দেওয়া। ভুল করেছে ছোটলোকের ঘরে ছেলের বিয়ে দিয়ে। রুপ দেখিয়ে এতো বড় ধোকা দিয়েছে আমার ফ্যামিলি। আরো নানা রকম কথা। আমার জা এগুলো শুনতে ভীষন মজা পেতো। মাঝে মাঝে নিজেও তাল দিতো। খুব কষ্ট হতো। নিজেকে পাপী মনে হতো কেন গরীব ঘরে জন্মালাম। আর কেনই বা ধনী পরিবারের বউ হলাম!
সাতাশ রোজার দিন আমি ইফতার বানাচ্ছিলাম। হঠাত হাত থেকে পায়েশের বাটিটা পড়ে যেতেই আমার শাশুড়ী হুংকার ছেড়ে বলল, ফকিন্নিরা আবার জিনিস অপচয় করে কোন সাহসে? টাকা গুলো কি তোমার বাপ এসে দিয়ে যায়? জা এসে আগুনে ঘি ঢেলে বলল, এতো দামি বাটিটা, আমার মা শখ করে কিনেছিলেন, আর তুমি এটা ভেঙে দিলে?
আমি কাপা কাপা গলায় বললাম মা ভুল হয়ে গিয়েছে, আমাকে মাফ করে দিন। শাশুড়ি তেড়ে এসে বললেন, ভুল তো আমি করেছি তোর মতো ছোটলোককে ঘরে এনে। এতো গুলো রোজা চলে গেলো তোর বাপের কি আক্কেল নাই যে মেয়ের বাড়তি খেয়ে না খেয়ে হলেও ইফতার পাঠাতে হয়!
আমার আর সহ্য হলো না। কী যেন হলো আমি সবার সামনে আমার মাকে ফোন করে চিতকার করে বললাম, তোমাকে টিউশনি করিয়ে যে সোনার আংটিটা কিনে দিয়েছিলেন সেটা বিক্রি করে এই মিসকিন পরিবারে ইফতারি পাঠাও মা। তারা না খেয়ে মরে যাচ্ছে। বলেই হাউমাউ করে কাদতে লাগলাম। আমার কথা শুনে ফোনের ওপাশে মাও কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
ফোন রাখার আগেই আমার শাশুড়ি আমার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিলেন। আর চিতকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুললেন এক ছোটলোকের বাচ্চা নাকি তাকে মিসকিন বলে গালি দিয়েছে। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন আমার এ বাড়িতে আর জায়গা হবেনা। আমাকে এক কাপরে বাপের বাড়ি চলে যেতে হবে।
আমি ভেবেছিলাম আমার সহজ সরল স্বামী এবারও চুপচাপ সহ্য করবে। কিন্তু না আমার স্বামী বিনাবাক্যে আমাকে নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন। বড়লোকের আদরের ছেলে আমার সাথে অতি সাধারণ জীবনে পাড়ি জমালেন। তারপর আমার জীবনে আর কোনো দুঃখ আসেনি। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষদের একজন হয়ে বেঁচে রইলাম। আমার সাথে ঐ পরিবারের যোগাযোগ না থাকলেও আমার স্বামীকে তার বাবা মায়ের কাছে যেতে বারন করিনি কখনো। তিনি মাঝে মাঝেই যেতেন। আমি নিজেই তাকে বলতাম যেন তাদের খোজ খবর নেন। সন্তান বলে কথা। এই জন্যই হয়তো শাশুড়ী মৃত্যুর আগে আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন শেষবারের মতো। আমার তখন ডেলিভারি ডেট এগিয়ে এসেছিলো তাই আর শেষ দেখাটা হয়নি। তবে আমার মনে হয়েছিলো তিন হয়তো তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতেন। তাই আমিই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
আজ তিরিশ বছর যখন আমিও শাশুড়ি তখন ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আমার বড় ছেলের বউ এর বাড়ি থেকে হরেক রকম ইফতারি এসেছে। আর তা দেখে আমার ছোট ছেলের বউ এর মুখটা একদম চুপসে আছে।
বড় বউএর খুশি খুশি মুখ দেখে আমার কেনো যেনো বিরক্ত লাগছে। আমি শান্ত গলায় বললাম, তমা তোমাকে প্রতিবার বলা হয় এতো ইফতারি আমার বাড়িতে না এনে গরিবদের খাওয়াতে, তবু বারবার একই কাজ কেন বার বার করো? তমা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, এগুলো রেওয়াজ মা। আমরা এটা মেইনটেইন করি সবসময়।
তমার কথা শুনে নিলা মুখটা অন্ধকার করে চলে গেলো। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো নাড়া দিয়ে উঠলো।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ছোট ছেলের রুমে পাশ কেটে যাওয়ার সময় হঠাত ছোট বউ নিলার কথা কানে আসলো। সে তার স্বামীকে আমতা আমতা করে বললো, মুহিব আমার খুব মন খারাপ লাগছে। এই যে দেখ ভাবির বাসা থেকে এতো কিছু পাঠালো, কিন্তু আমার বাসা থেকে কোনো কিছু দেওয়ার নাম নেই। আসলে মায়ের চিকিৎসা বাবদ অনেক খরচ হচ্ছে। এখন হয়তো এতো খরচ করতে পারবে না। তবে সামান্য কিছু তো পারবেই। কিন্তু কথা হলো এখন ভাবির সাথে তুলনা করলে তো আমি ছোট হয়ে যাবো। কি করি বলো তো?
আমার ছেলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল আরে ধুর মাকে তুমি চেনই না। আমার মা কিছুই ভাববেন না। আমার মায়ের মন অনেক বড়।
ছেলের মুখে একথাটা শুনে গর্বে বুকটা ভরে গেলো। কিন্তু নিলার জন্য মনটা খচখচ করতে লাগলো।
নিলা গলা নামিয়ে বলল, মা হয়তো ভাববেন না কিন্তু আমার যে খারাপ লাগছে। কোনো ভাবেই নিজেকে মানাতে পারছি না।
মুহিব কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার খারাপ লাগলে তুমি মায়ের সাথে ডিরেক্ট কথা বলো। আমি বুঝি না এতো কিছু। মুহিব এর উত্তর শুনে নীলা আর কিছু বলেছে কিনা জানিনা। আমি কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়েই নিজের ঘরে চলে আসলাম।
কয়েকদিন পর দুই বউকে ডেকে বললাম, তোমরা রেডি হও, আজকে এক বাসায় ইফতার এর দাওয়াত আছে। দুজনেই অতি উতসাহী হয়ে জানতে চাইলো কোথায়?
আমি বললাম আমার এক বোনের বাসায়। তারা আর কিছু বললনা। দুপুরের পর বউদের নিয়ে বাজার করলাম। সামর্থ্য অনুযায়ী দুহাত ভরে বাজার করলাম। তারাও খুব আনন্দ নিয়ে কেনাকাটা করলো দেখে শুনে। গাড়িতে উঠে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম আজকে আমরা ছোট বউমার বাড়িতে ইফতার করব। তোমাদের স্বামীরাও চলে যাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। তাই এতো বাজার সদাই। কথাটা শুনে ছোট বউ আতকে উঠল। তার চোখেমুখে ভয়। দেখে আমি তাকে শান্ত করে বললান চিন্তা করোনা। তোমার বাসায় কেউ জানে না আমরা যে যাবো। আর তুমিও জানিয়ো না। ছোট বউমা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। ভয় আর লজ্জা তাকে আকড়ে ধরেছে। কিন্তু ঐদিকে বড়জনের মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। যেনো আষাঢ়ে মেঘ জমেছে।
সে মুখ কালো করে বসে রইলো। ছোট বউমার বাড়ির গেটে নেমে বড় বউমার বিষ্ময়ের সীমা রইলো না। তার বাবা মা ভাই বোনকেও দাড়িয়ে থাকতে দেখে। তার অন্ধকার মুখটা হঠাতই বদলে গেলো। আমি বড় বউ এর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম। কে কার বাসায় ইফতার পাঠালো সেটা বড় কথা নয়। আমরা আজ তিন পরিবারে একসাথে ইফতার করবো। আল্লাহর কাছে দোয়া করবো, এটাই আসল। তুমি হয়তো মন খারাপ করেছো এটা শুনে যে, তোমার বাসায় ইফতার না পাঠিয়ে ছোট বউ এর বাসায় কেন? তুমি যেদিন থেকে ইফতার আনলে সেদিন থেকে এই মেয়েটা চিন্তায় মরে যাচ্ছে। আবার তার মা’টাও অসুস্থ। তাই এতো আয়োজন। আমি কিন্তু সব পরামর্শ তোমার মায়ের সাথেই করেছি।
আমি যখন বড় বউকে কথাগুলো বলছিলাম, ঐদিকে আমার ছোট বউ ঝরঝর করে কাদছিলো। বড় বউ এর চোখেও পানি টলমল করছে।
দুজনের একটু কাছে ঘেসে ফিসফিস করে বললাম, তোমরা ভাবছো আমি কতো ভালো মানুষ তাই না? আসোলে আমি এতো ভালো চিন্তা করতেই পারতাম না, যদি না আমার শাশুড়ী মা আমাকে শেখাতেন। তারা দুজনই কৃতজ্ঞতার হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোট বউ গলা নামিয়ে বলল, আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসীব করুন। আমি জোরে বললাম, আমীন। মনে মনে ভাবলাম আসলেই তো সেদিন যদি আমাকে আমার শাশুড়ী মা বাসা থেকে বের করে না দিতেন তাহলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না যে, অপারগতার কষ্টটা কি!
আমার ছেলের বউরা জানুক আমি শিখেছি। কিন্তু এটা জানা জরুরী না যে, আমার শেখাটা ভালো থেকে না মন্দ থেকে। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার শাশুড়ীর দোষ গোপন রাখার জন্য আমাকে পুরুষ্কৃত করবেন।
সংগৃহীত ও ঈষৎ সম্পাদিত।
উম্মে শারমিন নিহা।