শবে মেরাজ বা লাইলাতুল ইসরা। আমাদের প্রিয় নবীজি সা. এর জীবনে ঘটা এক অবিষ্মরণীয় ঐতিহাসিক রজনী। যে রাতে আমাদের নবীজি সা. উর্ধ্বজগত সায়র করেছিলেন। এটি আমাদের নবীজির জন্য মহা সম্মানের, আমাদের জন্য মহা গৌরবের। কিন্তু এ রাতের সাথে আমাদের দেশে কতেক অবাস্তব ও ভিত্তিহীন প্রথা জড়িত রয়েছে। মানুষ দ্বীনের নামে এগুলো পালন করে প্রতারিত হচ্ছে। অথচ এগুলো পালনের কোনো ভিত্তি নেই। এগুলোকে দ্বীনি কাজ বলা যাবে না। এসব ভিত্তিহীন আমল পালন করলে সওয়াব হওয়া তো দূরের কথা, বরং গোনাহগার হবে। আল্লাহ রাসূলের কাছে জবাবদীহী করতে হবে। আসুন জেনে নিই, এ রাত্রি কেন্দ্রিক কোনটি বাস্তব আর কোনটি অবাস্তব।
বাস্তবতা :
১)) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে একটি রজনী এমন গত হয়েছে, যাতে তিনি প্রথমে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়েছেন। যাকে কুরআনের ভাষায় ‘ইসরা‘ বলে। এ পর্যন্ত বিশ্বাস করা ফরয; অস্বীকার কুফর। কারণ এ অংশ কুরআন মাজীদ দ্বারা প্রমাণিত। এটাকে অস্বীকার করার অর্থ কুরআনকে অস্বীকার করা। আর কুরআন অস্বীকার করা কুফর।
তারপর সেখান থেকে তিনি সশরীরে আসমানে উর্ধ্বজগতে পরিভ্রমণ করেছিলেন। এর নাম ‘মিরাজ‘। এটিও বিশ্বাস করা জরুরি। তবে এ অংশে সন্দেহ পোষণ করা ইলহাদ ও যিন্দীকী, তথা ধর্মদ্রোহীতা হবে।
তিনি ঠিক কত তারিখে ইসরা ও মিরাজে গমন করেছিলেন, বিশ্বাসের জন্য তা নির্ধারণ করা জরুরি নয়। তবে ২৭রজব বেশ প্রসিদ্ধ। ঐতিহাসিকগণ আরও অনেক তারিখ উল্লেখ করেছেন।
মিরাজ যেমন আমাদের নবীজির জন্য সম্মান ও মর্যাদার, তেমনি আমাদের জন্য অনেক অনেক গৌরবের। এটি আল্লাহ তাআলার এক মহা নিদর্শন। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় তারিখ। এবং নবীজির জীবনের এটি এক জ্বলজ্বলে অধ্যায়।
ব্যস, এতটুকুই!
অবাস্তবতা
কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ভিত্তিহীন কাজকর্ম। যেমন :
- প্রতিবছর এটিকে একবার করে উদযাপন বা স্মরণ করা।
- এটিকে লাইলাতুল কদর বা লাইলাতুল বরাআত এর মতো মহিমান্বিত ও ফযীলতপূর্ণ মনে করা।
- এ তারিখে দিনের বেলা রোযা রাখা।
- এ রাতে ইবাদত বন্দেগী অন্য রাতের চেয়ে বেশি করা।
- এ রাতে বিশেষ নামায আছে মনে করা।
- এ রাতে মসজিদে জমায়েত হওয়া।
- এ রাত উপলক্ষে মসজিদে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা।
- মিষ্টি জিলাপী বিতরণের আয়োজন করা।
- ভালো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা, ইত্যাদী।
নবীজির কোনো সবল কিংবা দুর্বল হাদীস দ্বারা এর কোনো একটি প্রমাণিত নয়।
ফযীলতের কয়েকটি রাত বাদ দিলে বছরের অন্য সব রাত্রির মতোই একটি রাত এটি। শবে মেরাজ একটি ঐতিহাসিক রজনী, শরঈ রজনী নয়। শরঈ রজনী সেসব রাত, যেগুলোকে ইসলাম মহিমান্বিত ও বিশেষ ফযীলতের রাত্রি বলে ঘোষণা করেছে। যেমন, কদরের রাত্রি। আর ঐতিহাসিক রাত্রি হলো, যাতে ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা ঘটেছে। যেমন- বদর যুদ্ধের দিন, মক্কা বিজয়ের দিন।
শবে মেরাজের ইবাদত আর অন্য রাতের ইবাদতের সওয়াব সমান।
শাইখুল ইসলাম তাকী উসসানী দা.বা. বলেছেন : “বিশেষপদ্ধতিতে এ রাত উদযাপনের কোনো ভিত্তি নেই। এ রাত ইবাদতের ইহতেমাম করা বিদআত। এটি যদি ফযীলতের রাত হতো, তা হলে নবীজি আমাদের সেটা অবহিত করতেন। অথচ পঞ্চম নববী সনে তিনি মেরাজ গমন করেছেন। এরপর তিনি আরও ১৮বছর বেঁচে ছিলেন; কিন্তু তিনি একটি বারের জন্য তা পালন করেননি।
“এরপর সাহাবায়ে কেরাম আরও একশ’ বছর বেঁচে ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও এমন কিছু পালন করতে দেখা যায়নি। বরং কোনো কোনো অতি উৎসাহী লোক এ তারিখে রোযা রেখেছে বলে সংবাদ পেয়ে হযরত উমর রাযি. খুব ক্রোধান্বিত হয়েছেন। এবং লোকদেরকে প্রকাশ্যে খেতে বাধ্য করেছেন।”
(ইসলাহী খুতুবাত, প্রথম খন্ড)
কাজেই এ রাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করি। অতি উৎসাহে গোনাহ কামাই না-করি। আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নত আঁকড়ে ধরার এবং বিদআত পরিহার করার তাওফীক দিন।