রোজাদার স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব
ইফতারের সময় টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি কোথাও বেলের শরবত নেই। আমি আমার স্ত্রী সুমাইয়াকে ডেকে বললাম,
— শুধু লেবুর শরবত আছে। বেলের শরবত কোথায়?
সুমাইয়া মাথা নিচু করে বললো,
বেলের শরবতটা বানানোর সময় পাই নি।
কথাটা শুনার পর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। সুমাইয়াকে ধমক দিয়ে বললাম,
— তুমি কি রাষ্ট্র পরিচালনা করো; যে শরবত বানানোর সময় পাও নি?
সারাদিন রোজা রাখার পর একটু যে বেলের শরবত খাবো সেটাও আমার কপালে নেই।
সুমাইয়া আর কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এই মেয়েকে নিয়েই এক সমস্যা ও কোন কাজ পরিপূর্ণ ভাবে করতে পারে না।
দুপুরের দিকে সুমাইয়াকে বললাম,
— ফ্রিজে কি মুরগির গোশত আছে?
সুমাইয়া বললো,
-হ্যাঁ আছে
আমি বললাম,
— এক কাজ করো তো; আজ ইফতারিতে মুরগির গোশত দিয়ে চপ বানিও।
আমার কথা শুনে সুমাইয়া হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি কিছুটা ধমকের স্বরে বললাম,
–এইভাবে বোকার মত হা করে তাকিয়ে আছো কেন?
সুমাইয়া আমতা আমতা করে বললো,
মুরগির গোশত দিয়ে কিভাবে চপ বানায়?
এমনিতেই রোজা রেখেছি আর এখন মধ্য দুপুর। গরমে মেজাজ এমনিতেই খারাপ তার উপর সুমাইয়ার এই কথা শুনে মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। সুমাইয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
— তোমার মা কি তোমায় রান্না বান্না কিছু শিখিয়ে বড় করে নি?
যেটা বানাতে বলি সেটাই দেখি পারো না। আমি জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি তোমাকে বিয়ে করে।
সুমাইয়া কিছু না বলে চুপচাপ আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি অন্য রুমে চলে গেলাম। এইমেয়েটাকে দেখলেই আমার আজকাল রাগ লাগে। দিন দিন আমার ওকে অসহ্য মনে হচ্ছে…
সেহরির সময় ভাতে হাত রাখতেই বুঝালাম ভাতগুলো ঠান্ডা। আমি কিছু না বলে শুধু সুমাইয়ার দিকে তাকালাম। আমার রাগী চেহারা দেখে সুমাইয়া ভয়ে মাথা নিচু করে বললো।
আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। এখন গরম ভাত রান্না করলে আযান দিয়ে দিবে। আজ একটু কষ্ট করে ঠান্ডা ভাত খেয়ে নাও। কাল থেকে আর এমন হবে না।
সুমাইয়ার কথা শুনে আমি আর ওকে কিছু বললাম না। চুপচাপ ভাতের প্লেটটা ফেলে দিয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়লাম…
আমার বন্ধু খালিদের বাসায় আজ ইফতারের দাওয়াত আছে।
আমাদের বাসা কাছাকাছি হওয়ার কারণে আমি ওর বাসায় একটু তাড়াতাড়িই চলে গেলাম। কলিংবেল বাজাতেই খালিদ দরজা খুললো। খালিতে অবস্থা দেখে খুব অবাক হলাম।
ওর সারা মুখে সাদা পাউডানের মত কি যেন লেগে আছে। আমি খালিদকে বললাম….
— তোর এই অবস্থা কেন?
খালিদ মুচকি হেসে বললো,
তানিয়াকে (খালিদের স্ত্রী) একটু ইফতারি বানানোর কাছে হেল্প করছিলাম।
আমি তখন বললাম,
— তুই রোজা রেখে রান্না বান্না করছিস?
খালিদ আবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
তুই গাধা না কি? আমি তো শুধু একা রোজা রাখি নি; তানিয়াও তো রেখেছে। অফিস যেহেতু ছুটি সেহেতু আমি রোজা রেখে সারাক্ষণ বাসায় শুয়ে বসে দিন পার করি কিন্তু তানিয়ার কোন ছুটি নেই। ও রোজা রেখে ঘর পরিষ্কার করছে, কাপড় ধুঁয়ে দিচ্ছে, রান্না বান্না করছে আবার ইফতারিও বানাচ্ছে। বেগুনী, আলুর চপ, বুট-ভরা খেতে যতটা মজা এইসব বানানো ঠিক ততটাই কঠিন। ও একা হাতে সব কিছুই সামলায় আমি মাঝে মধ্যে একটু হেল্প করি এই যা।
ইফতারের সময় আমি আড়চোখে খালিদ আর তানিয়াকে দেখছিলাম। তানিয়ার প্রতি খালিদের ভালোবাসা দেখে নিজেকে তখন অমানুষ মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ তানিয়া খালিদকে বললো,
~ তোমার শরবতে তো ইসুপগুলের ভুসি দিতে ভুলে গেছি
খালিদ তখন মুচকি হেসে বললো
আরে দূর একদিন ইসুপগুলের ভুসি না খেলে কিছু হবে না।
নিজেকে খালিদের জায়গায় দাঁড় করালাম। আজ যদি সুমাইয়া এমন ভুলটা করতো আমি হয়তো ওকে প্রচন্ড রকম গালি গালাজ করতাম। অথচ একদিন বেলের শরবত না খেলে কিছুই হতো না। আমি শুধু আমার দিকটাই ভেবে দেখেছি অথচ আমার পাশে একজন রোজাদার মানুষ কত কাজ করছে সেটা আমার কখনো চোখেই পরে নি।
সেহরির সময় সুমাইয়ার কপালে হাত রেখে ওকে ডাক দিতেই ও তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠলো। আমাকে দেখে কিছুটা ভয়ে ভয়ে বললো,
আমি আজকেও দেরি করে ফেললাম তাই না?
কিছু মনে করো না প্লিজ। আমি এখনি রান্না করছি
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— আমি রান্না করে ফেলেছি। তবে মাছের তরকারীটা মনে হয় খুব বেশি ভালো হয় নি। আজ একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও। আর হ্যাঁ,কাল আমায় মাছের তরকারী রান্না করা শিখাবে বিনিময়ে মুরগীর গোশত দিয়ে কিভাবে চপ বানাতে হয় সেটা তোমায় শিখাবো।
আমার কথা শুনে সুমাইয়া আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে ওর হাতটা ধরে বললাম,
— আমার এতদিনের ব্যবহারের জন্য আমায় প্লিজ মাফ করে দিও। কথা দিচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্বামী হয়ে তোমাকে দেখাবো। তখন তোমার চোখে আমার প্রতি ভয় না; শুধু ভালোবাসা দেখা যাবে।
রোজাদার স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব
বিঃদ্রঃ- আসছে রামাদান এই মর্মে সকল মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার একটা অনুরোধ রইলো, আপনি যেমন রোজা রাখেন তেমনি আপনার মা বোন স্ত্রী ওরাও রোজা রাখে। তাই ইফতারে দুই একটা আইটেম কম হলে রাগারাগি না করে বরং ইফতার বানানোর কাজে উনাদের যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেন। বেশি কিছু না পারলেও অন্তত শরবত বানানোর দায়িত্বটা নিজে নেন।
সবাইকে পবিত্র রামাদান এর অগ্রীম শুভেচ্ছা।
লেখা সংগৃহীত
আলহামদুলিল্লাহ্