রাসূলের জীবনী পড়বো কোন বই দিয়ে শুরু করবো?
সীরাত পাঠ: ভুল পাঠককে ভুল উত্তর (সাজেশন)
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী পড়বো। কোন বই দিয়ে শুরু করবো?
আপনি সীরাত বিশ্বকোষ (দশ খণ্ড) পড়ুন, সীরাত ইবনে হিশাম (চার খণ্ড) পড়ুন, আর-রাহিকুল মাখতুম’ পড়ুন…।
খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। মনে করুন, ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া এক ছাত্র বললো, “ভাই, আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যেতে চাই। কোথায় গেলে ভালো হবে?”
আপনি বললেন, “সবচেয়ে ভালো হয় তুমি এই ছুটিতে উমরাহ করে আসলে। আর যদি কোথাও ঘুরতে যাবার জন্য বলো, তাহলে তুমি কানাডা-আ্যমেরিকায় গিয়ে নায়াগ্রা ফলস দেখে আসতে পারো, মিসরের পিরামিড দেখে আসতে পারো, চীনের দ্যা গ্রেট ওয়াল দেখে আসতে পারো কিংবা ইংল্যান্ডে গিয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখে আসতে পারো।”
কোনো সন্দেহ নেই, আপনি যেসব জায়গার নাম বললেন সেগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা, পর্যটকদের পছন্দের তালিকার শীর্ষের জায়গা। কিন্তু, আপনি যাকে সাজেশন দিলেন তার তো এই মুহূর্তে সেইসব জায়গায় যাবার সামর্থ্য নেই; এমনকি তার পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। সে ইচ্ছে করলেই এসব জায়গায় ঘুরে আসতে পারবে না।
সে যদি ঢাকার অধিবাসী হয়, তাহলে আপনি বলতে পারেন- চিড়িয়াখানা ঘুরে আসো, নুহাশ পল্লী ঘুরে আসো, বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে আসো, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল ঘুরে আসো। সিলেটের অধিবাসী হলে বলতে পারেন- জাফলং, মাধবকুণ্ড, রাতারগুল, লাউয়াছড়া ঘুরে আসো।
আবার মনে করুন, ক্লাস নাইনে (আর্টসে) পড়ুয়া এক ছাত্র বললো, “ভাই, আমি মার্কেটিং পড়তে চাই, মার্কেটিং শুনেছি খুব মজার একটা সাবজেক্ট। কী বই দিয়ে শুরু করবো?”
আপনি তার হাতে ধরিয়ে দিলেন ফিলিপ কটলারের Principles of Marketing কিংবা Marketing Management বই দুটো। যে বইগুলো অনার্সে পড়ানো হয়, সেই বইগুলো যদি ক্লাসে নাইনে পড়ুয়া এক ছাত্রের হাতে দেন তাহলে সে কতোটুকু বুঝবে? বইগুলো কি পড়ে শেষ করতে পারবে?
হ্যাঁ, যদি খুব ট্যালেন্টেড হয়, একেবারে ব্যতিক্রম হয়, তাহলে হয়তো সে পড়ে ফেলতে পারবে। সেরকম ব্যতিক্রমী সংখ্য কতো? ১%, ৫%? এরচেয়ে তো বেশি না।
অথচ আপনি যদি তাকে ক্লাস নাইন-টেন বা ইন্টারের ‘উৎপাদন বিপনন ব্যবস্থাপনা’ বইটি সাজেস্ট করতেন, তাহলে হয়তোবা সে বইটা অন্তত একবার হলেও পড়তে পারতো। তারপর যদি আগাতে চায়, তাহলে ফিলিপ কটলারের কথা বলবেন।
তারমানে, কাউকে কোনো কিছু সাজেস্ট করার পূর্বে তার এভিলিটি অনুযায়ী সাজেস্ট করতে হয়। বিগিনারের জন্য একরকম সাজেশন থাকে, বিশেষজ্ঞের জন্য আরেক রকমের সাজেশন।
ফেসবুকে কেউ কোনো সাজেশন চাইলে আসলে তার এভিলিটি সম্পর্কে আঁচ করা যায় না। এজন্য অনেকেই ঐ বিষয়ের ‘বেস্ট’ জিনিসটাই সাজেস্ট করেন।
আবার, অনেকেই আছেন প্রশ্নকারী তার এভিলিটি স্পষ্ট করার পরও তার এভিলিটি অনুযায়ী সাজেশন না দিয়ে ‘বেস্ট’ জিনিসটি সাজেস্ট করেন। সেই বেস্ট জিনিসটি যে ঐ উমরাহ করা, নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাবার উদাহরণের মতো, সেটা পরামর্শদাতা বুঝতে পারেন না।
ফেসবুকে হরহামেশা দেখা যায়, কেউ সীরাত পাঠ শুরু করতে যাচ্ছেন। এর আগে কখনো রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী পড়েননি। তাকে যদি আপনি বলেন- সীরাত বিশ্বকোষ (দশ খণ্ড), সীরাত ইবনে হিশাম (চার খণ্ড), আর-রাহিকুল মাখতুম, সাল্লাবীর সীরাত (দুই খণ্ড) পড়ুন, তাহলে ঐ ব্যক্তির জীবনে সীরাত পড়া না-ও হতে পারে।
সন্দেহ নেই এই বইগুলো সীরাতের ‘বেস্ট’ বই। কিন্তু, এগুলো তো একজন বিগিনারের বই না, একজন বিশেষজ্ঞের বই, রেফারেন্স দেবার মতো বই। হ্যাঁ, কোনো কোনো ‘ভালো পাঠক’ যদি এগুলো দিয়ে সীরাত পাঠ শুরু করেন তাহলে হয়তোবা তার ক্লান্তি লাগবে না, সাত ঘাটের পানি খাওয়া লাগবে না, মূল বইগুলো পড়ে ফেলতে পারবেন। কিন্তু, এরকম ট্যালেন্টেড, ধৈর্যশীল পাঠকের সংখ্যাও তো অনেক কম। ১% থেকে ৫%।
আমি আমার পরিচিত এমন অনেককেই চিনি, যারা এই জীবনে এখনো একবারের জন্য হলেও নবীর জীবনীটা পড়েননি। কেন পড়েননি জানেন? অনেকেই চার খণ্ডের সীরাত ইবনে হিশাম কিংবা আর রাহিকুল মাখতুম দিয়ে সীরাত পাঠ শুরু করেছিলেন। আমি নিজেও আর রাহিকুল মাখতুম দিয়ে সীরাত পড়া শুরু করি। তিন বছর বইটি পড়ার সেল্ফেই ছিলো, কিন্তু সীরাত পাঠ শেষ হয়নি। একটু পড়ি, রেখে দেই। কিছুদিন পর আবার হাতে নেই, আবার রেখে দেই।
কিন্তু, যখন ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ বইটি পড়লাম, তখন সীরাত পাঠের প্রতি দারুণ আগ্রহ জন্মালো। দুই-চারটি তুলনামূলক ‘সহজ’ সীরাত পড়ার পর যখন আর রাহিকুল মাখতুমে হাত দিলাম, তখন বইটি একটানে শেষ করি।
আর রাহিকুল মাখতুম আমাকে, আমার পরিচিত বিগিনারদের টানেনি, তাই বলে অন্য কাউকে টানবে না এমন না।
তারমানে সীরাত পড়া শুরু করতে চাইলে বিগিনারদের জন্য ঐ বেস্টগুলো দিয়ে শুরু করাটা ফলপ্রসূ না। সীরাত পাঠের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য কিছু বই আছে। সেগুলো পড়ার পর যে কেউ সীরাত পাঠে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
তাহলে বইগুলো কি কি?
একেকজন একেক সাজেশন দিবেন। সবার সাজেশন ‘এক’ হতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই!
আমার কাছে মনে হয়, কেউ সীরাত পড়া শুরু করতে চাইলে তিনটি বই ধরে আগাতে পারেন। বইগুলো সুখপাঠ্য, উপস্থাপনা সাবলীল।
১। তোমাকে ভালোবাসি হে নবী
গুরুদত্ত সিং (আবু তাহের মিসবাহ হাফি. অনূদিত)
২। মহানবী
মাজিদা রিফা (রাহবার পাবলিকেশন)
৩। সীরাহ
রেইনড্রপস।
‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ বইটি মাত্র একশো (+) পৃষ্ঠার। খুব সংক্ষেপে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী বেশ আবেগী ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
মাজিদা রিফা (আপুর) ‘মহানবী’ বইটি সমসাময়িক সীরাত বইগুলোর মধ্যে সাহিত্যমানের দিক থেকে প্রথম সারিতে রাখবো বইটি বিগিনারের জন্য একটা মাস্টারপিস। এটা যতোটা না একটা সীরাতগ্রন্থ তারচেয়ে বেশি একটা উপন্যাস। শুধু উপন্যাসই না, থ্রিলার উপন্যাস। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে মনে হয় নতুন নতুন এডভেঞ্চার।
রেইনড্রপস এর ‘সীরাহ’ নিয়ে বেশি কিছু বলার নাই। নিয়মিত বই পড়েন, আমার কাছের এমন কোনো পাঠককে যখন জিজ্ঞেস করি, রেইনড্রপস এর সীরাহ পড়ছো? সে যদি বলে ‘না’ তাহলে আমার মনে হয়, আমি যেন আকাশ থেকে পড়ছি! তাকে শুধু বলি, এই বইটি তুমি পড়ো নি!?
সুতরাং, একজন বিগিনারকে সীরাত পাঠে আগ্রহী করার জন্য তার হাতে দশ খণ্ডের সীরাত বিশ্বকোষ তুলে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ না; ঠিক যেমন ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া একটা শিক্ষার্থীকে ছুটি কাটানোর জন্য কানাডা ঘুরে আসার কথা বলাটা বুদ্ধিমানের কাজ না।
কাকে, কী সাজেশন দিচ্ছেন একটু চিন্তা করে, তার এভিলিটি অনুযায়ী দিন।
আরিফুল ইসলাম
২৮ মার্চ ২০২০