রমাদানময় সিরাত; সিরাতময় রমাদান

হিন্দু পরিবারের মেয়ে হওয়ার সুবাদে শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার কমতি ছিলোনা মোটেই। বাবা নিজেই পূজো সাজাতেন। আমাদের বাড়িতেই বসতো পূজোর জমজমাট আসর।
তুলকালাম টা বাঁধল আমার ব্যাগে সিরাতের বই পাওয়ার পর!
হিন্দু ব্রাহ্মণের ব্যাগে মুসলমানদের সিরাতের বই। এ কি চলে!

আমার এই কাজটাই যেন পুরো গোষ্ঠীকে জাত থেকে বেজাত করে দিলো সেদিন! ব্যাগটাকে ফেলে দিয়ে নতুন ব্যাগ কিনে দেয়া হলো! সম্পূর্ন বাড়ি ধুঁয়ে মুছে পরিষ্কার করা হলো! বইটাকে পুড়িয়ে ছাঁই করে ফেলা হলো! বাড়ির সবাইকে ধরে ধরে গোসল করানো হলো! মা সাফ সাফ বলে দিলেন, এগুলো যেন আর না আনি বাড়িতে! এগুলো নাকি অচ্ছুত!

বললাম,
“পড়তে ভালো লেগেছিল, একজন বিখ্যাত কিংবদন্তীর জিবনী! ভালো জিনিস! তাই পড়ছিলাম।”
ব্যস, কথা শেষ হওয়ার আগেই গালে একটা চড়ের দাগ বসিয়ে দেয়া হলো! যে আমাকে কোনোদিন একটা ফুলের টোকাও দেয়া হয়নি, সে আমাকেই কেন একটা বইয়ের জন্য চড় দেয়া হলো, তা বুঝতে বেশ কয়েক ঘন্টা লেগেছিল সেদিন।
সে যাকগে!

এরপরের সময়টা ছিল রমাদান। আমার ফিরে আসা মুসলিম জীবনের প্রথম রমাদান। আগের দিন ইসলাম গ্রহণের সুবাদে শুধু শেষ রোযাটাই রখতে পেরেছিলাম। এবার আর সিরাতের বই ব্যাগে রাখিনি, রেখেছিলাম আমার ধোঁয়া জামার ভাঁজের ভিতর।
কড়া নজরদারীতে রাখা হতো আমাকে। শেষ রোযা রাখাটা একটু কঠিন হলেও আল্লাহ পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন। সিরাত পড়তাম গভীর রাতে জেগে। বাড়ির সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আমি তখন মুখ গুঁজে রাখতাম সিরাতের বইয়ে। প্রত্যেকটা পৃষ্ঠার ঘ্রাণকে মনে হতো শুভ্র! পবিত্র! কতো উষ্ণ!
তাহাজ্জুদের নিয়ম আমার পুরোপুরি জানা ছিলোনা। যতোটুকু জেনেছিলাম সেটুকু দিয়েই কোনোমতে পড়ে নিয়েছিলাম ওদিন। ২৯ রোযার রাত; পরদিনই রোযা শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনের প্রথম তাহাজ্জুদ!

অনেক দোয়ার সাথে সিরাতের বইটা পড়ে শেষ করার দোয়াও করেছিলাম আল্লাহর কাছে। চেয়েছিলাম, যদি পুড়িয়েও ফেলা হয়, তাহলে যেন আমার পড়া শেষ হলে পোড়ানো হয়! আলহামদুলিল্লাহ! বইটা শেষ হয়েছিলো সে রাতেই।
একটা বই ঠিক কতোটা তন্ময় হয়ে পড়লে সেটাকে বই পড়া বলা হয়, আমার জানা ছিলোনা। শুধু মনে হচ্ছিলো, বইটা শেষ না হলে জীবন থেকে পিছিয়ে যাবো লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। হারিয়ে ফেলবো সোনালী মানুষটির হেঁটে যাওয়া সোনালী পথ! যে পথে হাঁটতে শুরু করেছি, অত সহজে সেটা হারাতে চাবো, অতোটা বোকা আমি নই আলহামদুলিল্লাহ!

যার সত্যবাদীতায় ঘোর শত্রুরও কোন সন্দেহ ছিলোনা; যার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বিন্দুমাত্র ভাবতোনা তাঁরই বিরুদ্ধাচরণকারী আরবগোত্রপ্রধানরা; যে মানুষটা নিজের মৃত্যুষড়যন্ত্রণাকারীদের সম্পদও রেখেছিলেন নিজ জিম্মায় অক্ষত ও সুরক্ষিত; এমনকি হিজরতের আগেও ফিরিয়ে দিতে ভুলেননি গচ্ছিত নির্ভুল, নির্ঝঞ্জাট আমানত; সে মানুষটা কি করে মিথ্যাবাদী হতে পারেন আমার জানা ছিলোনা!

এক হাতে চাঁদ আর এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আল্লাহর স্মরণ থেকে তিলমাত্র গাফেল করতে পারতোনা যাকে কেউ; ক্ষমতার দাপট থেকে শুরু করে সুন্দরী নারীর লোভ, কোন কিছুই যাকে ইসলাম থেকে দূরে সরাতে পারেনি এতটুকুও; সবশেষে এতকিছুর পরেও মক্কার কাফেরদের অবলীলায় মাফ করে দিয়েছিলেন যে নিষ্কলুষ মানুষটা; তিনি কি করে একটা মিথ্যা নবুয়্যাতের দাবীদার হতে পারেন সেটা আমি জানতে চাইনা, বুঝতেও চাইনা!

তায়েফবাসীর নির্মম প্রস্তরাঘাতেও উম্মতের জন্য মুখ থেকে যার একটি অভিশাপের রা পর্যন্ত বের হয়নি; মৃত্যুর আগমুহূর্তেও উম্মতের চিন্তায় বিভোর ছিলো যার কোমল বিষণ্ণ অন্তর; সারা জীবনের অনেকটা সময় শুধু উম্মতকে নিয়েই পেরেশান ছিলেন যে নবি; সেই নবিরই উম্মত হয়ে তাঁকে অস্বীকার করার দুঃসাহস আমি দেখাই কি করে!

সব ছেড়ে কিসের আশায় কিসের ভরসায় মিসকিনদের মতো নির্লোভ জীবনকে বেঁছে নিয়েছিলেন এই মানুষটা?

কিসের লোভে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার পরেও, ক্ষুদ্র কুঁড়েঘরেই বিলাসবহুল খাদ্য আর আসবাব ছেড়ে বেঁছে নিয়েছিলেন পার্থিব জীবনের দরিদ্র, রিক্ত বেশ!

প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য বেশিদূর যেতে হয়নি আমাকে। সবাইকে হারিয়ে এই মানুষটারই নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত আর পাগল খ্যাত হওয়ার পিছনের কারনটা আমি ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম।

এই সহজ সত্যগুলো বুঝার জন্য আমার অন্তরকে তিলে তিলে প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন যে একক স্রষ্টা, তাঁর প্রতি সিজদায় লক্ষ কোটিবার অবনত হলেও ঋণ শোধ হবেনা। কিন্তু তবুও তো নিরবে অন্ধকারে বসে চোখের পানি শেষ হচ্ছিলোনা সেদিন!

চাপা কান্না ছেড়ে মা জেগে গেলে বিপদ হবার সম্ভাবনা না থাকলে হয়তো চিৎকার করেই কেঁদে কেঁদে বলতাম,

“হে নবী(স), আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল! দায়িত্ব পালনে আপনি তিলমাত্র কার্পণ্য করেননি! আপনার চিরসত্য দাওয়াত সযত্নে সুরক্ষিত অবস্থায় বিলকুল পৌঁছে দিতে চেয়েছেন আমাদের কাছে। আজ এত এত যুগ পরেও আপনার আমানতদারিতার নিষ্কলুষ নদী বহমান! নবুয়্যাতের অকাট্য সাক্ষ্য এখনও বহন করে চলেছে আপনার অক্ষত আখলাক। রাসূল, আপনিই শেষ; আপনার পর আর কেউ আসবেনা– সাক্ষ্য দিলাম।”
সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
(আংশিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

রমাদানময় সিরাত; সিরাতময় রমাদান।

লিখেছেন

আপনি কি জানেন জাহান্নামের আগুন কী?
তা কাউকে জীবিতও রাখবে না, মৃত অবস্থায়ও ছেড়ে দেবে না
চামড়া ঝলসে দেবে

Exit mobile version