যৌবনের তাড়না
মানবজীবনকে মোটাদাগে শিশুকাল, যৌবন আর বার্ধক্য- এই তিনটি স্তরে ভাগ করা হলেও যৌবনই আসল জীবন। কারণ জীবনকে উপলব্ধি করার, ভোগ করার, সৃষ্টিশীলতা স্থাপন করার বা ধ্বংসশীল আচরণে মেতে ওঠার এটাই সময়। জীবনের যৌবন-পূর্ববর্তী অধ্যায় শিশুকাল আর যৌবনের পরবর্তী অধ্যায় বার্ধক্য, দুটি অধ্যায়ই দুর্বলতা ও অসহায়ত্বে পূর্ণ। শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা-অক্ষমতা মানুষকে এ দুটি পর্যায়ে পরনির্ভর করে রাখে। ফলে নিজের ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্বের সক্ষমতা এ পর্যায়ে প্রমাণের কোনো সুযোগ থাকে না।
যৌবনই যে জীবনের শক্তি- এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের বাণী হলো,
‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে, এরপর জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। অতঃপর তোমাদের তিনি বের করেন শিশুরূপে, তারপর তোমরা যৌবনে পদার্পণ করে থাকো, অবশেষে বার্ধক্যে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ তার আগেই মৃত্যুবরণ করে। এটা এ জন্য যে তোমরা যেন তোমাদের নির্ধারিত সময়কাল পূর্ণ করতে পারো এবং তোমরা যেন অনুধাবন করতে পারো।’
[সুরা : মুমিন : ৬৭]
প্রায় সবকিছুরই মধ্যবর্তী অংশটুকু হয় বেশি শক্তিশালী, বেশি উপযুক্ত। মধ্যাহ্নের সূর্যটা হয় অত্যন্ত প্রখর। মানবজীবনে যৌবনকাল হলো মধ্যবর্তী সময়। শিশুকালে মানুষ থাকে দুর্বল, পরনির্ভরশীল। বৃদ্ধকালেও ঠিক তাই। মাঝের সময়টুকুই শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার সময়। প্রখরতার সময়।
এই মধ্যবর্তী সময়টায় একজন মানুষের সব উপশক্তি ব্যয় করে ক্ষমতা দেখানো সম্ভব। সৌন্দর্যের বিস্তার ঘটিয়ে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে পুরো সমাজ ও দুনিয়া জুড়ে। বুক ফুলিয়ে হাটতে ইচ্ছে করে কাউকে তোয়াক্কা না করে। ইচ্ছে জাগে সব নারীর ক্রাশ হয়ে থাকতে।
যৌবনকাল আমাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার এক বিশেষ রহমত। এটা যেমনটি রহমত তেমনি আসল পরীক্ষার সময়। মূলত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা দেখেন সর্বোচ্চ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে তার বান্দা কে বেশি নাফরমানী করে, আবার কে মাতা ঠেকায় তার কুদরতি পদার্পণে।
আর আমরা সে কথা ভুলে গিয়ে ঝুঁকে যাচ্ছি উল্টো দিকে। যৌবনে যখন পদার্পণ করি, শক্তির জোরে অন্ধ হয়ে পড়ি। ডুবে যায় অন্ধকারে। রাস্তাঘাট যেন হয়ে যায় আমারি। বুক ফুলিয়ে হাটতে গিয়ে পিসে ফেলছি কত দূর্বলদের। অন্যয় হবে আমার আর শাস্তি হবে সেই তাহার, যাহার নাই কোন বার্ধক্য। ক্ষমতার লোভে জড়িয়ে পড়ি নোংরা রাজনীতিতে। স্মার্ট বলে চালিয়ে দিচ্ছি কত অদ্ভুত কাটাকাটিতে, সেই কাটাকাটির প্রভাব পড়ে কিছুক্ষণ কাপড় চোপড়ের উপর আবার না হয় চুলের উপর। কত মূল্যবান সময় যে কাটিয়ে দিচ্ছি দিনকে দিন, বছরকে বছর বন্ধু বান্ধবের আড্ডায়। কুকুরের লালসার মতো ছুটে বেড়াচ্ছি নারীর পিছু পিছু। নারীর সঙ্গ পাওয়াই যেন হয়ে যাচ্ছে অতি মূল্যবান বিষয়।
আজকে মুসলিম যুবকরা অশ্লীলতার চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে। অবৈধ প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে জীবন-যৌবন সব নষ্ট করার পথ ধরেছে। যেই যুবকরা ছিল উম্মাহর মা-বোনের ইজ্জতের প্রহরী, আজকে তারাই ধর্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। যে যুবকেরা ছিল উম্মাহর বিজয়ের অগ্রসৈনিক, আজকে তারা নিজেদের সোনালি অতীত ভুলে গেছে। আজকে ভুলে গেছে তারা তাদের পূর্বপূরুষ মুহাম্মাদ বিন কাসিমদের ইতিহাস, মাত্র আঠার বছর বয়সে এক মুসলিম বোনের ইজ্জত রক্ষার্থে এসে যিনি জয় করেছিলেন সিন্ধু এবং পুরো ভারত উপ-মহাদেশ।
যে যুবকদের হাত ধরে বিশ্ব পেয়েছে মুক্তি, পেয়েছে নারীরা নিরাপত্তা, শান্তি বিলিয়ে ছিল সমাজে, চিনিয়ে নিয়েছিল অপব্যবহার কারী শাসকদের থেকে ক্ষমতা। আজ সেই যুবকের কারণে ধ্বংস হচ্ছে এই সমাজ, বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে গেছে পুরো বিশ্ব, অন্যায় বাড়ছে নিত্যদিন।
আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি যে আজকের তরুণদের অনেকেই ক্রোধ আর হতাশার মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছে। তারা যেন স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে। দেশের ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে নিজের উন্নয়নের এক অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি করে তারা মনে করছে, দেশের উন্নয়নটা যেন অন্য কারো কর্তব্য, যার জন্য বরাদ্দ আছে বিশেষ একদল, তাদেরকে তাচ্ছিল্য করা যায়, দোষারোপ করা যায় কোনো পরীক্ষা ছাড়া, শুধু রাজনীতিবিদ বলে শনাক্ত করেই। দেশের উন্নয়নের কথাতো দূরে থাক, নিজ ফিউচার নিয়েও ভাবতে ভুলে গেছে, মাথায় শুধু একটা ভাবনায় কাজ করে ‘নারী’/’পুরুষ’। যেন এই দুনিয়ায় সেক্স মেটাতে পারলে শেষ, খাওয়া দাওয়া, ফিউচার, আখিরাত কিছুর প্রয়োজন নেই।
জানি যুবকদের এখানে একটা অভিযোগ থাকবে, এমন ফেতনার যুগে, নারী পুরুষ মেলামেশা একদম কমন, কি করে নিজেকে সংযম রাখি। চলুন তাহলে একটা গল্প শুনা যাক কোরআন থেকে। যেটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সুন্দর তম গল্প বলেছেন।
কুরআনে বর্ণিত যুবকদের অন্যতম হলেন সাইয়িদুনা ইউসুফ আলাইহিস সালাম। প্রত্যেক যুগ ও শতাব্দির যুবকদের জন্য উত্তম নমুনা রয়েছে ইউসুফ আলাইহিস সালামের মাঝে। সৌন্দর্যতার জন্য এখনও পর্যন্ত তিনি পৃথিবীবাসীর কাছে অনুপম। যার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা ছিল স্বয়ং বাদশার স্ত্রী পর্যন্ত। কুরআন সেই ঘটনা তোলে ধরেছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে :
“আর সে যে মহিলার ঘরে ছিল, ঐ মহিলা তাকে ফুসলাতে লাগল এবং দরজাগুলো বন্ধ করে দিল। মহিলা বলল, শোনো! তোমাকে বলছি, এদিকে আসো।’ সে বলল, ‘আল্লাহ রক্ষা করুন; তোমার স্বামী আমার মালিক। তিনি আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন। নিশ্চয় সীমা লঙ্ঘনকারীরা সফল হয় না।’
অবশ্যই মহিলা তার বিষয়ে (খারাপ) চিন্তা করেছিল, সে-ও মহিলার বিষয়ে চিন্তা করত, যদি না সে তার পালনকর্তার মহিমা অবলোকন করত। এমনিভাবে, আমি তার কাছ থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মনোনীত বান্দাদের একজন।
তারা উভয়ে দরজার দিকে ছুটে গেল। মহিলা ইউসুফের জামা পিছন দিক থেকে টেনে ধরল। উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার কাছে পেল। মহিলা বলল, ‘যে ব্যক্তি তোমার পরিজনের সাথে কুকর্মের ইচ্ছা করে, তাকে কারাগারে পাঠানো অথবা কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া ছাড়া তার আর কি শাস্তি হতে পারে?’
ইউসুফ (আ.) বলল, ‘সে-ই আমাকে আত্মসংবরণ না করতে পেরে ফুসলিয়েছে।’
মহিলার পরিবারের জনৈক ব্যক্তি সাক্ষী দিল যে, যদি তার জামা সামনের দিক থেকে ছিন্ন থাকে, তবে মহিলা সত্যবাদী, সে মিথ্যাবাদী। আর যদি তার জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে, তবে মহিলা মিথ্যাবাদী এবং সে সত্যবাদী।
এরপর গৃহস্বামী যখন দেখলেন, তার জামা পেছন দিক থেকে ছেঁড়া, তখন তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় এটা তোমাদের ছলনা। নিঃসন্দেহে তোমাদের ছলনা খুবই মারাত্মক। ইউসুফ, এ প্রসঙ্গ ছাড়ো। আর হে নারী, এ পাপের জন্য তুমি ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিঃসন্দেহে তুমিই পাপাচারিনী।
নগরে মহিলারা বলাবলি করতে লাগল যে, বাদশার স্ত্রী স্বীয় গোলামকে কুমতলব চরিতার্থ করার জন্য ফুসলায়। সে তার প্রেমে উন্মত্ত হয়ে গেছে। আমরা তো তাকে প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে দেখতে পাচ্ছি।
যখন সে তাদের চক্রান্ত শুনল, তখন তাদেরকে ডেকে পাঠাল এবং তাদের জন্যে একটি ভোজসভার আয়োজন করল। সে তাদের প্রত্যেককে একটি ছুরি দিয়ে বলল, ‘ইউসুফ! এদের সামনে দিয়ে যাও।’ যখন তারা তাকে দেখল, হতভম্ব হয়ে গেল এবং আপন হাত কেটে ফেলল। তারা বলল, ‘অসম্ভব! এ ব্যক্তি কোন মানব নয়। এ তো কোন মহান ফেরেশতা!’
মহিলা বলল, ‘এ-ই তো সেই ব্যক্তি, যার জন্যে তোমরা আমাকে ভৎর্সনা করছিলে। আমি ওরই মন জয় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে। আর আমি যা আদেশ দেই, সে যদি তা না করে, তবে অবশ্যই সে কারাগারে প্রেরিত হবে এবং লাঞ্চিত হবে।’
ইউসুফ বলল, ‘হে আমার রব! তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। যদি আপনি তাদের চক্রান্ত আমার উপর থেকে প্রতিহত না করেন, তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব।’
এরপর তার রব তার দুয়া কবুল করে নিলেন। তাদের চক্রান্ত প্রতিহত করলেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।
[সুরা ইউসুফ: ২৩-৩৪]
এবার চিন্তা করে দেখি ইউসুফ আঃ কি করে একটা ফুসলানো নারী থেকে নিজেকে সংযম করেছিলেন। সেই নারীর রূপের দিক দিয়েও তো কম ছিল না। সে তো চাইলে পারতো আমি আপনার মতো একটু উপভোগ করে নিতে। তার কাছে এই কাজের চেয়েও জেল খানা শ্রেয় মনে হলো। তার কারণ সেই জানে এই অপকামের শাস্তি কত ভয়াবহতা। সে আল্লাহর আদেশকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ওঁত পেতে নিল শাস্তি হিসেবে কারাগার। আজ আমাদের মনে হচ্ছে এই পাপ যেন পাপে নয়। আরও ফেসবুকে এই ভালবাসা গুলোকে পবিত্র ভালবাসা নামে দিনরাত প্রমোট করে যাচ্ছি। কত বেশি নির্বোধ হলে এমনটা হয় ভেবে দেখুন।
এভাবে যারা নিজেকে নিবৃত্ত রাখবে যৌবনের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যাওয়া থেকে, তাদের জন্য সুসংবাদ ঘোষিত হয়েছে রাসুলের জবানিতে :
‘সাতশ্রেণির মানুষকে হাশরের মাঠে আল্লাহ তায়ালা তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে অন্যতম হলো ওই ব্যক্তি) যাকে উচ্চবংশীয়া রূপসী কোনো নারী অসৎকর্মের জন্য আহ্বান করে, কিন্তু সে বলে, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহকে ভয় করি।’
[বুখারি, আসসাহিহ : ৬৬০]
কত মূল্যবান যৌবনকালের এই সময় গুলো প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘন্টা। এই গুরুত্বপূর্ণ সময় গুলো ব্যয় করে আজকের যুবক অনর্থক পাপাচারে লিপ্ত হয়ে। জড়িয়ে পড়ছে নানা ফেতনা ফেসাদে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় ফেতনা হয়ে দাড়িয়েছে ইন্টারনেট , ভাল দিক বিবেচনায় ইন্টারনেটের যেমন তুলনা করা যায় না। তেমনি খারাপ দিকটাও বিবেচনা করলে ধ্বংসাত্মক যুবকের কথা না বললেই নয়। এ ক্ষেত্রে একজন যুবকের মধ্যে এই ইন্টারনেটের আকর্ষণ বেড়ে যায়। তার চিন্তা ভাবনার স্থান করে নেয় নগ্ন ও বিকৃত আপত্তিকর সাইটগুলোতে।
তাতে সময় নষ্টের পাশাপাশি Gonorrhea, Nocturnal Enuresis, Cubit Coitus ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। যার কারণে দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে অমবস্যার মত অন্ধকার। সৃষ্টি হচ্ছে নাজায়েজ প্রেম, ভালবাসা ও বন্ধুত্ব। যার কারণে বিয়ের পূর্বে হচ্ছে ধর্ষিতা নারীর খুণ, গুম। বিয়ের পর হচ্ছে ডিভোর্সসহ নিজ স্বামী ছেড়ে অন্য প্রেমিকের সাথে বেড়িয়ে যাওয়া। এসব পথ না পেলে তো আছেই আত্মহত্যা নামক পাপের বোঝা।
আমাদের দেশে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। তার মধ্যে বিশাল এক জনসংখ্যা রয়েছে যুব সমাজ। কত শিক্ষিত যুবক মানসম্মত কাজ না পেয়ে বেকার হয়ে আছে। এই বেকারত্বের সুযোগ শয়তান নিয়ে নেয়। তাকে নানান অপকর্মে লিপ্ত করে দেয়।
প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ বলেছেন- গরিব হয়ে জন্ম নেয়া পাপ নয়, বরং সুস্থ শরীরে গরিব থাকা পাপ। বাবা মা কষ্ট করে লেখা-পড়া শিখিয়ে সন্তানকে মানসম্মত কর্ম থেকে দুর্নীতিতে পিষ্ট হয়ে ফিরে আসে। যার কারণে সেই সুনাগরিক সন্তান (ছেলে বা মেয়ে) একমুঠো ডাল ভাত জোগার করতে অপরাধ ছাড়া আর কোন পথ খোঁজে পায় না।
সুশিক্ষার অভাবে জর্জরিত সমাজ। শিক্ষিত আছে বটে, মানসম্মত শিক্ষা না পেয়ে অহরহ ভুল, অন্যায়, খারাপ ও সমাজ এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় ফাসাদ সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের ধ্বংসের পায়তারা খোঁজতে চেষ্টায় থাকে। এভাবে জাহেলী যুগের ন্যায় মারামারি, কাটাকাটি, হত্যা, গুমসহ নানান অপরাধে ঢেলে দিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করছে। কিন্তু ইসলামী শিক্ষায় নিজেকে সুশিক্ষিত করতে না পেরে সঠিক পথ পায় না। যার কারণে কোনটা হালাল, কোনটা হারাম না বুঝাতে সোনার মানিক যুব সমাজের অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যুব সমাজের অবস্থা আজ পালহীন নৌকার মতো কেন? দেশের অধিকাংশ যুবক-যুবতী অধঃপতনের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর বৈচিত্র্যে ভরা এ দেশ একটি শক্তিশালী, সুস্থ সংস্কৃতিসম্পন্ন দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে বলেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। পশ্চিমা ও আকাশ সংস্কৃতির প্রতি যুব সমাজ আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। ওদের সবকিছুই তারা অন্ধভাবে অনুকরণ করছে, যা আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আমদানি করতে অবশ্য ঠিকাদারের ভূমিকা নিয়েছে একশ্রেণির ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
তাই অসচেতন যুবক-যুবতীর পক্ষে ভালমন্দ বিচার-বিবেচনা করাটা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। তারা যা চোখের সামনে দেখে সেটাকেই ঠিক বলে ধরে নিচ্ছে। এদিকে বিত্তবান ও উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের যুবক-যুবতীরা নিজেদের লাইফ স্টাইল অন্যদের থেকে আলাদা দেখাতে গিয়ে বিদেশি সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরছে। নিজেদের অত্যাধুনিক ভাবলেও আসলে এটা তাদের অজ্ঞতা। সাধারণ অর্থে শিক্ষিত হলেও যারা সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত নয়, তারাই এভাবে নিজেদের ও দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে।
যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য আকাশসংস্কৃতির রগরগে ছবি, পর্নোগ্রাফি, দেশের শাসন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা যতটুকু দায়ী, ততটুকুই দায়ী যুবক-যুবতীদের অভিভাবকগণ। গোটা দেশের কথা বাদ দিয়ে যদি বিভিন্ন শহরের বর্তমান যুব সমাজের উন্মাদনার দিকগুলো তুলে ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, সে চিত্রটা আমাদের ভাবিয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য যে যুবক-যুবতী প্রাণ দিয়েছিল তারা আজ এমন বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে তা ভেবে অবাক হতে হয়। ভাষা আন্দোলনের পিছনে যুব সমাজের অবদানের কথা বর্তমান প্রজন্মের যুব সমাজ জানে না।
সেটা লজ্জার ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকে যেমনি গোটা দেশের যুব সমাজ বিভেদ ভুলে এক ছাতার নিচে এসেছিল, তেমনি ভাষা আন্দোলনও যুব সমাজকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিল। পরিতাপের বিষয় যুব সমাজ আন্দোলনের ব্যাপারটি ভুলে গেছে। এখানে হাজারো সমস্যা থাকা সত্তে¡ও সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ঢালাও ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যম এ কাজকে আরো সহজ করে দিয়েছে।
মিডিয়ার মাধ্যমে নানানরকম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়। বর্তমান যুব সমাজের উন্মাদনার নেতিবাচক দিকটা তুলে ধরলে যা দেখা যাবে, তা সত্যিই ভয়ঙ্কর। এটা একটা স্বাধীন দেশের জন্য মোটেই কাম্য নয়।
সাধারণত খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতিতে যুব সমাজ অগ্রণী ভূমিকা নেয়। যদি বলা হয় যে, আমাদের যুব সমাজ শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকছে না, তাহলে ভুল বলা হবে। যুব সমাজ অবশ্যই শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকছে, তবে সেটা সুস্থ নয়। অসুস্থ সংস্কৃতির ছাপ থাকা সত্তে¡ও যুব সমাজ বেশি করে আগ্রহ দেখাচ্ছে আমদানিকৃত সংস্কৃতির দিকে। এটাকেই একশ্রেণির যুবক-যুবতী সঠিক সংস্কৃতি বলেই ধরে নিচ্ছে এবং সুস্থ মার্জিত সংস্কৃতি ইচ্ছা করে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ করতে গিয়ে সীমানা যে অতিক্রম করা হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল করার কথা তাদের মগজে আসছে না। ধূমপান, মদ্যপান, নীলছবি, চটুলগান, পর্নোগ্রাফি আজকের যুব সমাজের উপভোগের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
লক্ষ্যনীয়, বিভিন্ন শহরের সিনেমা হলগুলোতে অ্যাডাল্ট ছবি চললে দর্শকের অভাব হয় না। এসব ছবি যারা দেখে তাদের বেশিরভাগ যুবক। পর্নো বই কিনে পড়ার মতো যুবক-যুবতী পাঠকের অভাব নেই। চটুল গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অস্বাভাবিকভাবে অশালীন পোশাক গায়ে দিয়ে কোমর দুলিয়ে নেচে বেড়ানো স্বাভাবিক চেহারা নিচ্ছে।
যে যুব সমাজকে দেশের স্বাধীনতার এত বছর পর বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সে যুব সমাজ আজ রগরগে ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে টিকেট নিয়ে মারামারি করে। এটা একটা স্বাধীন দেশের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী হতে পারে? আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে থাকলেও তা এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও পুঁজিবাদীদের জন্য সম্ভব হচ্ছে না। বিদেশি অপসংস্কৃতি আমদানি, ক্যাবল চ্যানেলের ব্যাপক প্রসার, প্রকাশ্যে নীল ছবি প্রদর্শন, পর্নো বই বিক্রি বন্ধ করতে সরকারকে কঠোর হওয়া দরকার।
আমরা অন্যের সংস্কৃতিতে ধাবিত হচ্ছি এই কারণে নিজ সংস্কৃতির ইতিহাস ভুলে আছি বলে। আমরা কি জানি সম্রাট দাকিয়ানুসের শাসনামলের সেই তরুণদের কথা। যখন চারদিকে শিরকের সয়লাব, মানুষ মানুষের পূজায় লিপ্ত, নবিদের শিক্ষা ভুলে পৌত্তলিকতায় নিমজ্জিত পুরো জাতি। গর্জে ওঠলেন সাত যুবক। অস্বীকার করলেন মানুষের উপাসনা।
প্রশ্ন তুললেন সম্রাটের মিথ্যে সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে। গ্রেফতার করা হলো তাদের। ঈমান বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে হিজরত করলেন তারা। আশ্রয় নিলেন এক পাহাড়ি গুহায়। ঘুমালেন ৩০৯ বছর। আল্লাহর রাহে হিজরতকারী সেই সাত যুবকের ব্যাপারটা আল্লাহ খুব পছন্দ করলেন। সমস্ত ঈমানদার যুবকদের শিক্ষার নিমিত্তে আলোচনা করলেন তার পবিত্র কালামে। সুরা কাহফে আল্লাহ তাদের ঘটনা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘নিশ্চয় তারা ছিল তাদের রবের প্রতি ঈমান আনয়নকারী কতিপয় যুবক। (যখন তারা হিজরতের ব্যাপারে মনস্থ করল) আমি তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছিলাম।’
[সুরা কাহফ: ১৩]